×

সাময়িকী

শান্তনু বিশ্বাসের নাট্যভুবন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৯, ০৮:৩১ পিএম

শান্তনু বিশ্বাসের নাট্যভুবন

শান্তনু বিশ্বাসের নাট্যচিন্তার মূলে ছিল দেশ ও মানুষ। সারাজীবন তিনি মানুষের কাছাকাছি থেকে মানুষের কথা ভেবেছেন। মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের কথা বলেছেন।

শান্তনু বিশ্বাস চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের উন্মেষকালের কর্মী। এ আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল নিজস্বকালের সংকট ও সম্ভাবনাকে মঞ্চালোকে উন্মোচন করা। সে সূত্রে এ কালখণ্ডে সৃষ্টি হয়েছে মৌলিক নাটকের একটি সমৃদ্ধ ধারা। চট্টগ্রামে এ ধারাকে যারা সমৃদ্ধ করেছেন শান্তনু বিশ্বাস তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সমকালীন সময় ও সমাজকে তিনি তুলে ধরেছেন নাটকে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা, অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের তুমুল উত্থান, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধে বিপক্ষীয় শক্তির আস্ফালন আর স্বাধীনতার সপক্ষীয় শক্তির প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বিস্তর ব্যবধানজনিত কারণে সৃষ্ট ক্ষোভ, পরিবার ও নর-নারীর সম্পর্ক প্রভৃতি শান্তনু বিশ্বাসকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে। এ সব বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি রচনা করেছেন ‘কালো গোলাপের দেশ’, ‘দপ্তরী রাজ দপ্তরে’, ‘নবজন্ম’, ‘ভবঘুরে’, ‘ইনফরমার’, ‘নির্ভার’, ‘মৃণালের চিঠি’ (মূলগল্প : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘স্ত্রীর পত্র’) প্রভৃতি নাটক। বিদেশি নাটকের অনুবাদেও তার পারঙ্গম প্রতিভার পরিচয় মেলে। তার অনূদিত নাটকগুলো হলো- ‘খোলা হাওয়া’ (এন এফ সিম্পসনের ‘হাউ আর ইউর হ্যান্ডলস’), ‘প্রার্থী’ (হ্যারল পিন্টারের ‘এপ্লিক্যান্ট’) ‘মাতৃচরিত’ (এ্যালেন আইকবোর্নের ‘মাদার ফিগার’) প্রভৃতি। উপর্যুক্ত ছয়টি মৌলিক নাটকের মধ্যে ‘ইনফরমার’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক। এটি শান্তনু বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্বশীল নাটক। ১৯৮২ সালে নাটকটি কালপুরুষের প্রযোজনায় প্রথম মঞ্চস্থ হয়। ‘কালপুরুষ’ ছাড়াও একাধিক দল দেশে ও পশ্চিমবঙ্গে নাটকটির শতাধিক মঞ্চায়ন করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ধারায় নাটকটি অনন্য সংযোজন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকসেনাদের বিভিন্ন সংবাদ সরবরাহ করে সহযোগিতা করার জন্য নিয়োগ করা হয় এ দেশজ পাকিস্তানি সহচরদের। তেমনি উদ্দেশ্যে একজন নিয়োগপ্রাপ্ত সংবাদ সরবরাহকারীকে নিয়ে রচিত হয়েছে শান্তনু কায়সারের ‘ইনফরমার’ নাটকটি। নাটকে দেখা যায়, এ নাটকের চরিত্র শেখ জামান পাকসেনাদের ইনফরমার হিসেবে নিযুক্ত হলেও সে গোপনে কাজ করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সপক্ষে। ‘ইনফরমার’ নাটকে পাকসেনাদের অত্যাচারের চিত্র ফুটে উঠেছে জীবন্তভাবে। নাটকে রমজুর সংলাপে পাই সে চিত্র- ‘গেরামে ইজ্জত বাঁচায়ে আর থাকন যাচ্ছে না। মাস্টার, গোটা গেরামটারে আগুনে পুইড়ে দিয়েছে। এক গেরামে আগুন নিবে তো আর এক গেরামে জইলে ওঠে। আগুন আর নিবে না। সব পুইড়ে শেষ।’ পাকসেনাদের এই অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে ইনফরমার শেখ জামান অবলম্বন করে ভিন্ন এক কৌশল। নারী সম্ভোগের প্রলোভন দেখিয়ে পাক অফিসারকে সে নিয়ে আসে গ্রামে। মদ আর সংগীতে নেশাগ্রস্ত করে তাকে হত্যা করে জামান। অবশ্য এর জন্য জামানকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। নাটকের শেষে আমরা লক্ষ্য করি, পাকসেনারা নির্মমভাবে তাকে হত্যা করছে আর অন্যদিকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে স্বদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তার নাটকের প্রিয় অনুষঙ্গ। তার কাছে মুক্তিযুদ্ধ যুগপৎ বিপুল আনন্দ ও অপরিমেয় বেদনার মহাকাব্য। কেননা মুক্তিযুদ্ধে তিনি হারিয়েছেন অগ্রজ অতনু বিশ্বাসকে। হারানোর এ বেদনাকে তিনি একাকী বহন করেছেন আমৃত্যু- সে সাথে মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি ও দৃপ্ত চেতনাকে তিনি আমৃত্যু লালন করেছেন। শান্তনু বিশ্বাসের নাট্যচিন্তার মূলে ছিল দেশ ও মানুষ। সারাজীবন তিনি মানুষের কাছাকাছি থেকে মানুষের কথা ভেবেছেন। মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের কথা বলেছেন। মৃত্যুর পর দেহটিও দিয়ে গেলেন মানুষের কল্যাণে। এমন দেশ ও মানবদরদি বিশ্বস্ত বন্ধু আজকের যুগে বিরল। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App