×

সাময়িকী

যাওয়ার জন্যই হয়তো ফিরে আসা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৯, ০৬:৩১ পিএম

যাওয়ার জন্যই হয়তো ফিরে আসা
যাওয়ার জন্যই হয়তো ফিরে আসা
যাওয়ার জন্যই হয়তো ফিরে আসা

তাঁর গানগুলো শুনলে গান, পড়লে কবিতা। কাজটা কঠিন, কিন্তু তিনি তা করে উঠতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর গানের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তাঁর শহর চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিষয় তুলে এনেছেন গানে।

উনিশ বছর পর মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন শান্তনু বিশ্বাস। নিজের লেখা নাটক নির্ভার-এ। তিন চরিত্রের নাটক। একমাত্র নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তাঁর যোগ্য সহধর্মিণী সু-অভিনেত্রী শুভ্রা বিশ্বাস। নাটকটি নিয়ে চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনের সবারই আগ্রহ ছিল। বলা বাহুল্য, তার পিছনে প্রধান কারণ শান্তনু বিশ্বাসের মঞ্চে ফেরা। আমার মনে হয় নিয়মিত অভিনয় করতে চাইতেন তিনি। নির্দেশনার কাজেও দক্ষ ছিলেন, হয়তো সেই কাজটাও করতে চাইতেন। কিন্তু অনেকগুলো বছর তিনি তা করতে চাননি বা করার মতো সুযোগ তৈরি হয়নি। কোনোটা সত্যি তা আমি জানি না, কিন্তু এটা বুঝি গত উনিশ বছরে নাটকে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন তাঁরা একজন উঁচু মানের অভিনেতার অভিনয় দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অভিনয় দেখে, শুনে, করে শিখতে হয়। শুধু পড়াশোনা বা আলাপ-আলোচনা করে শেখা যায় চলনসই বা মাঝারি মাপের অভিনয়, ভালো অভিনয় নয়। দীর্ঘদিন অভিনয় না করলে একজন অভিনেতার অভিনয় ক্ষমতার প্রধান অবলম্বন আত্মবিশ্বাসে খানিকটা চিড় ধরতে বাধ্য। সেটা কাটিয়ে উঠে আবার মঞ্চে আলো ছড়াতে শুরু করেছিলেন শান্তনু বিশ্বাস। শুরু করেছিলেন, কিন্তু পুরো দম নিয়ে ছোটার আগেই চলে যেতে হলো না ফেরার দেশে। অনেক বড় ক্ষতি হলো নাট্যাঙ্গনের। শুধু চট্টগ্রাম নয়, সমগ্র বাংলাদেশের। এটা ঠিক এবং স্বাভাবিক, সবাই সবকিছু পারেন না। কিন্তু কিছু মানুষ ভিন্ন প্রতিভা নিয়ে জন্ম নেন। তাঁরা অনেক কিছু পারেন। শান্তনু বিশ্বাস সেই জাতের মানুষ। তিনি শিল্পকলার অনেক শাখায় সহজে এবং দাপটে চলাফেরা করতে পারতেন। নাটক লেখা, নির্দেশনা, অভিনয়, গান গাওয়া, গান রচনা, সুরারোপ, নাটকের আবহ সঙ্গীত রচনা, নাট্যপত্রিকা সম্পাদনা- সব শাখাতেই তিনি নিষ্ঠা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। শান্তনু বিশ্বাস ছিলেন শিল্পী। আপাদমস্তক। তাই তিনি কখনো থেমে থাকেননি। ঠিকঠাকভাবে বললে বলতে হয়, থেমে থাকতে পারেননি। সৃষ্টি ও প্রকাশের তাড়না শিল্পীকে থেমে থাকতে দেয় না। শান্তনুকেও দেয়নি। তাঁর নিজের হাতে গড়া নাট্যসংগঠন কালপুরুষ থেকে তিনি যখন নিজের মনের মতো নাটক করতে নানারকম সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলেন তখন তিনি মঞ্চে বিরতি দিয়ে গানে মনোযোগ দেন। খুব অল্প সময়েই তিনি দর্শক-শ্রোতাদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন নতুন ধারার গান গেয়ে। তিনি গান রচনা করেছেন প্রথাগত ধারার বাইরে। তাঁর গানগুলো শুনলে গান, পড়লে কবিতা। কাজটা কঠিন, কিন্তু তিনি তা করে উঠতে পেরেছিলেন। তিনি তাঁর গানের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি তাঁর শহর চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিষয় তুলে এনেছেন গানে। এককথায় অসাধারণ। স্মৃতিজাগানিয়া। কিন্তু গানে তাঁর যতই সাফল্য আসুক, শেষ পর্যন্ত তাঁকে ফিরতে হয়েছিল মঞ্চে। সম্ভবত সেটাই ছিল তাঁর আসল জায়গা। একজন প্রচার বিমুখ নেপথ্য শিল্পীর কথা এই সুযোগে না বললে শান্তনুর কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি হলেন পীযূষ দস্তিদার। তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শান্তনুর প্রতিটি কাজে প্রকৃত শিল্পবন্ধু ছিলেন। তাঁদের মধ্যে যে বোঝাপড়া ছিল ভালো কাজের জন্য সেটা খুবই জরুরি। পীযূষ দস্তিদারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার সূত্রে শান্তনু বিশ্বাসের মঞ্চের প্রতি ভালোবাসার মাত্রা আমি বুঝতে পেরেছিলাম আশির দশকেই। শান্তনু বিশ্বাসের যে ক্ষমতাটি আমাকে বিশেষভাবে তাঁর প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল সেটি হলো নাটকে গানের ব্যবহার। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিখ্যাত নাটক ‘ইনফরমার’এ গানের প্রয়োগ নাট্যশিল্পীদের কাছে শিক্ষণীয় বিষয়। এই ক্ষেত্রটিতে তাঁর আরো অনেক দেয়ার ছিল। যদিও আরো দুয়েকটি নাটকে তিনি গানের ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তাঁর ক্ষমতার তুলনায় তা যথেষ্ট নয়।

তাঁর আসল জায়গাতেই হয়তো ফিরে এসেছিলেন তিনি। পরম ভালোবাসায় মঞ্চকে আলোকিত করেছিলেন। আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে-যাক, শান্তনু আবার পুরো নাট্যাঙ্গনে আলো ছড়াবেন, যে আলোতে আমরাও আলোকিত হবো। কিন্তু জানি না, কীভাবে কী হয়ে গেল, মঞ্চে ফিরে আসার এক সপ্তাহ পরই তিনি চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আমার বারবার মনে হয় তাঁর প্রথম ভালোবাসা মঞ্চকে শেষ আলিঙ্গন করতেই তিনি উনিশ বছর পর আবার অভিনয়ে ফিরেছিলেন। জানি বিষয়টা কাকতালীয়, কিন্তু তারপরও এই কথাটা বারবার মনে আসে কেন জানি না!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App