×

সাময়িকী

ট্রেট অথচ চিত্রল এক কাব্যগাথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৯, ০৮:২৬ পিএম

ট্রেট অথচ চিত্রল এক কাব্যগাথা

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতে, কবিতা একটি ঘোর। ঠিক নেশার মতো। আমাদের কবি ফজল শাহাবুদ্দীনও এ কথাই বলতেন প্রতিদিন। তিনি বলতেন, একবার এর ফাঁদে পা দিলে বেরিয়ে আসা অসম্ভব। সম্ভবত এ কারণেই এই বৃত্তে যারা একবার প্রবেশ করেন তারা এরই মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকেন। নিরন্তর এই ঘুরপাকের মধ্য দিয়ে কেউ কেউ প্রকৃত কবি হয়ে বেরিয়ে আসেন আর অন্যরা কবি না হয়েও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে এক সময় হারিয়ে যান অন্ধকারে। বৃত্তের প্রসঙ্গটা এলো মিলু শামস-এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নিরুপায় বৃত্ত’ পাঠ করতে করতে। খুব বেশিদিন কবিতাঙ্গনে হাঁটাহাঁটি না করেও যিনি কবিতা দিয়ে বোদ্ধাদের চমকে দিয়েছেন, তিনি মিলু শামস; একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক এবং গল্পকারও। মিলু শামস-এর কবিতার একটি নিজস্ব ভাষা আছে। প্রথম পাঠেই বোঝা যায়, এ কবি জীবনের প্রকৃত নির্যাসটুকুকে কবিতায় তুলে আনতে আগ্রহী। তার বলার স্টাইলটা অনেকটা তারই মতো, স্ট্রেট অথচ চিত্রল। যারা কবিতা চর্চা করেন তারা নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন কবিতায় এ বিষয়টি কতটা দুরূহ এবং কষ্টসাধ্য। ঠিক যেন আকাশভাঙা কাঠপোড়া মধ্য দুপুরকে রোমান্টিকতায় প্রেমিকার আলিঙ্গনের সাথে তুলনা করে মধুরতার খামে পুরে পরিবেশন করা। মিলু শামস অবলীলায় এ কাজটাই করে দেখিয়েছেন তার কবিতায়। মিলু শামস-এর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, তিনি কবিতায় একটি নিজস্ব ভাষা নির্মাণ করতে পেরেছেন। একজন নবীন কবির পক্ষে নিঃসন্দেহে এটি একটি বিরল অর্জন। ‘নিরুপায় বৃত্ত’ গ্রন্থের একটি কবিতার শিরোনাম, ‘শূন্য চেয়ার’। কবিতাটি শব্দময়তায় যেমন ভা¯¦র ঠিক তেমনি রূপকতায়ও। তিনি লিখেছেন-

‘চেয়ারটি হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে সকালের রোদে নির্বিরোধী মানুষটি শুধু নেই মানুষবিহীন চেয়ার কী অর্থহীন’! এই যে চেয়ারের হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকা এর মধ্যে যে অরূপ চিত্রলতা দৃশ্যমান তার সাথে সংযুক্ত হয়েছে সেই নিবিড় সত্যটি, মানুষবিহীন চেয়ার কি অর্থহীন! চিত্রলতার মধ্য দিয়ে নিবিড় নিরেট বাস্তবতাকে উপস্থাপনের এই জাদুকরী কৌশল মিলু শামস-এর একান্তই নিজস্ব ভঙ্গি এবং তাতে তিনি যে সফল তা বলাই বাহুল্য। তার আরো একটি কবিতা ‘অজ্ঞাতনামা কষ্ট’।

‘ঘরগুলো ভেসে যায়- যে যার মতো, একটি উঠোন পুকুর হয় বুকে নিয়ে অজ্ঞাতনামা কষ্টের স্রোত’। অজ্ঞাতনামা কষ্টের স্রোত বুকে নিয়ে উঠোনের পুকুর হওয়ার দৃশ্যকল্পটি যে কোনো পাঠককে শুধু চমকিত নয়, ভাবিত এবং তাড়িত করে । ‘হৃদয়ের সুইসাইড নোট’-এ এ্যারোপ্লেনের আওয়াজকে বিসমিল্লাহ খাঁর সানাইয়ের মতো ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারা এ কবি ডোরাকাটা স্বপ্ন বুকে নিয়ে থেকে যেতে চান একাকী সবার অলক্ষ্যে লালরঙা বগিটিতে- হয়তো সেটিই তার কবিতার ঘর, যেখানে নিবিড় বুননে একে একে ভেসে ওঠে ইলেকট্রিক তারে ঝুলে থাকা মৃত শালিকের শরীর আর অরণ্যের শিখর ছুঁয়ে অস্পষ্ট বেরিয়ে থাকা বিষণ্ন মঠের চূড়া এবং কেবলি স্বপ্নিল হয়ে দুলে ওঠে ছোপ ছোপ অন্ধকারে লোকালয়ের পথে যাত্রা করা উৎসুক জনস্রোত। ‘নিরুপায় বৃত্ত’ পড়তে পড়তে একজন পাঠক অনায়াসে স্পর্শ করতে পারেন উজানের স্রোতে ভেসে আসা পদ্মফুল, সফেদ জ্যোৎস্নায় রাবারের স্যান্ডেল পায়ে ঘুরে আসতে পারেন এবড়োথেবড়ো দুঃখের দুর্গগুলো নিঃসীম নিসঙ্গতায়, আর দেখতে পারেন লজ্জার শেষ পালকটি শরীর থেকে খসিয়ে কীভাবে ধূর্ত শেয়াল লিপিবদ্ধ করে ইতিহাসকে বর্তমানের খেরোখাতায়। মিলু শামস জীবনঘনিষ্ঠ, তার উচ্চারণ দৃঢ় অথচ সংবেদনশীল। তিনি কবিতায় আশ্বিনের আকাশে নিষিদ্ধ মেঘের প্রসব প্রত্যাশী। কালবোশেখি মেঘ থেকে অবিরাম ঝরে পড়া রক্তবৃষ্টি দেখে কবিতার ভাবে দুলে ওঠা মিলু শামস-এর কবিতা পাঠককে দুলিয়ে দেয় বুনো বৃষ্টিতে ধানের শীষে একাকি ফড়িংয়ের আনন্দদোলের মতো। একজন কবি মিলু শামস্-এর কৃতিত্ব এখানেই। ‘নিরুপায় বৃত্ত’-এর কবিতা সংখ্যা ৩৪। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই কবিতাগুলোর মতোই ছন্দময় কবিতার শিরোনামগুলোও। পড়ার আগেই শিরোনাম পাঠ করে পাঠক অনায়াসে হৃদয়ে অনুভব করতে পারেন একটি একান্ত কবিতার অনুরণন। যেমন- ব্যক্তিগত শীত, গল্পটি মেঘাচ্ছন্ন থাকে, মুহূর্তগুলো ঝরে পড়ে, গরম চায়ে টোস্ট, হৃদয়ের সুইসাইড নোট, ধূর্ত শেয়াল এবং ইতিহাসের আপডেট, পালকখসা পায়রা, বিকল্প ভালোবাসা, দুপুরের নূপুর প্রভৃতি। নামগুলোও যে এক একটি কবিতার নোট হয়ে উঠতে পারে নিরুপায় বৃত্ত না পড়লে তা বোঝার উপায় নেই। গ্রন্থটির অপূর্ব সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছেন প্রতিশ্রুতিশীল চিত্রশিল্পী চারুপিন্টু, প্রকাশনার দায়িতে¦ ছিলেন আনোয়ার কামালের ‘এবং মানুষ’ প্রকাশনী। অক্ষর বিন্যাস, মুদ্রণ এবং বাইন্ডিং সবক্ষেত্রেই সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন প্রকাশক। তিন ফর্মার গ্রন্থটির দাম রাখা হয়েছে ১২০ টাকা, যা পাঠকের আয়ত্তের মধ্যেই। কবিতায় নতুন চিত্রকল্প এবং অচিন্তনীয় দৃশ্যপট রচনায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মিলু শামস-এর কবিতাযাত্রা শুভ হোক সেই সাথে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করুক ‘নিরুপায় বৃত্ত’- এই প্রত্যাশা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App