×

সাময়িকী

জীবন হল নদী আমি ভাসমান খড়কুটো

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৯, ০৮:৩৯ পিএম

জীবন হল নদী আমি ভাসমান খড়কুটো

শান্তনু বিশ্বাসের প্রয়াণ পরবর্তীতে ফেসবুকে এই গানটি আমি প্রথম শুনি : ‘সামনে পেছনে ডায়ে তার বাঁয়ে/ যেদিক থেকে দেখো/ জীবন তোমার একটাই/ গেলে আর খুঁজে পাবে নাকো/ ঘুমে জাগরণে কেন প্রাণপণে/ কিসের পেছনে ছোটো/ একটাই শুধু জীবন/ তা হবে না কখনো দুটো/ একটাই শুধু তুমি/ যেদিন করলে আমায় দুটো/ জীবন হল নদী আমি ভাসমান খড়কুটো।’ জীবন ট্র্যাজেডির কী অমোঘ ভাষ্য শান্তনু তার জীবদ্দশায় গানের মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৭১-পরবর্তী স্বাধীনতার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের রৌদ্রকরোজ্জ্বল মাহেন্দ্রক্ষণে শান্তনু বিশ্বাসের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (১৯৬৮) তখন যেটাকে নিউ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ বলা হতো। কারণ এই কলেজের মুখোমুখি পাহাড় চূড়োয় ছিল ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (১৯২৭)। এর একটা স্কুল সেকশন ছিল (১৯১৮)। এটা বুড়া মাদ্রাসা নামে অধিক খ্যাত ছিল। ১৯৭৯ সালে দুটো ইন্টারমিডিয়েট কলেজ একীভূত হয়ে সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসীন কলেজ হয়ে যায়। আমি এই কলেজের আর্টসের ছাত্র ছিলাম, আর শান্তনু বিশ্বাস সায়েন্সের ছাত্র ছিল। ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়াকালীন শান্তনুর পলিটিক্স এবং কালচারে তেমন সম্পৃক্ততা ছিল না। সতীর্থরা তথ্য দিচ্ছেন, শান্তনু প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন করতেন। তার বাবা চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অনুসারী ছিলেন। তিনি চা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। বোস ব্রাদার্সের অপজিটে লিভস এন্ড বাডস নামে একটি চা-পাতার দোকান ছিল। এতে বুঝতে পারি শান্তনু একটি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবারের সন্তান ছিল। একাত্তর পূর্ববর্তীতে চট্টগ্রামের কালচারাল গলি রুমঘাটা সে বেড়ে উঠেছে।

‘বাজে বাংলাদেশের ঢাক’ নাটকের শিল্পিত চেতনার জীবন সত্য প্রকাশে প্রত্যয়ী হয়ে ১৯৭৬ সালে গণায়ন নাট্য সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করেছে। শিল্পিত প্রকাশ ভঙ্গিমায় বলিষ্ঠতম মাধ্যমে নাটকে জনারণ্যের জীবনায়নের সত্য ও সুন্দর সংবাদ বহনের ঝুঁকি নিয়ে সৃষ্টির ফসল ফলনে গণায়ন প্রয়াসী। এই নাট্যাঙ্গনে গণায়নের অস্তিত্ব শুধু পোশাকী বাহারেই নয়। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় জীবন সত্যের অমোঘ ফল লাভের শিল্প উপকরণ আহরণ করে নাটক নির্মাণ ও আন্দোলনে গণায়ন সংযুক্ত হয়েছে। নিরপেক্ষ সংস্কৃতিতে আস্থাহীন গণায়ন বিশ্বাস করে নাটক শোষিত শ্রেণি চেতনা দান করবে আর শ্রেণি চেতনায় অধিকারীদের বিদ্রোহ, আন্দোলন, শ্রেণি সংগ্রাম ও বিপ্লবের মর্মবস্তু বুঝতে সহায়তা করবে। শিল্পের জন্য শিল্প পূজার নামে জীবনচ্যুত পলায়নী স্ববিরোধীতা অথবা নৈরাজ্যবাদী অপসংস্কৃতি উলঙ্গ প্রকাশে গণায়ন বিশ্বাসী নয়। বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক “যায় দিন ফাগুনো দিন” রচয়িতা মিলন চৌধুরী ছিলেন আমাদের গুরু। আমাদের শুধু নয় চট্টগ্রামের শ্যামা কবিরাজ বিল্ডিং, সাধু’র চা দোকানের আড্ডা, স্টেশন রোডের ‘বাংলা’ সব জায়গায় গুরু মিলন চৌধুরী। শিবনাথ দাশ অর্থাৎ শিবুদা আমাদের লোগো করেছিলেন। আসতেন আমাদের চাইতে ম্যাচিউরড দেবব্রত দেওয়ানজী ওরফে মন্টুদা। বিত্তবান ঘরের স্মার্ট ছেলে শক্তিমান অভিনেতা শান্তনু বিশ্বাস। দক্ষ অভিনেতা রঞ্জিৎ রক্ষিত, প্রণব দাশ, শিশির সেন, কালাম চৌধুরী, শুভ্রা বিশ্বাস, গায়ত্রী সেন, সঞ্জীব বড়ুয়া, তপন আচার্য। আসতেন প্রয়াত কবি ত্রিদিব দস্তিদার। মূলত ত্রিবেণী সঙ্গমে এসে গণায়ন মিলিত হয়েছিল। এটি সর্বজন বিদিত যে, গণায়ন নাট্য সম্প্রদায় (১৯৭৬) মিলন চৌধুরী রচিত বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক ‘যায় দিন ফাগুন দিন’ মঞ্চস্থ করে। এই ইতিহাসের অন্যতম অংশ হচ্ছে শান্তনু বিশ্বাস। এই নাটকে গায়েন চরিত্রে শান্তনু বিশ্বাস অভিনয় করে। তার গীত ‘বাজে তাক ধুমা ধুম ধুম/বাজে বাংলাদেশের ঢাক/কালরাত্রি পাড়ি দেব/ প্রাণ যদি যায় যাক।’ ‘ও বাজে..., ও বাজে...’ চমৎকার একটি হামিং শান্তনু বিশ্বাস দিতেন। এই গানের মধ্য দিয়ে যেন একাত্তর পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ আবার জেগে উঠেছে। এই নাটকে ৭-৮টি গান সবগুলোই শান্তনু বিশ্বাস গেয়েছে। এই নাটকে রাজা চরিত্রে রণজিৎ রক্ষিত, মন্ত্রী চরিত্রে মনতোষ ধর ও সনজীব বড়ুয়া, পাগল (বিদ্রোহী) চরিত্রে সনজীব বড়ুয়া অভিনয় করেন। পরে অঙ্গন থিয়েটার থেকে এই নাটকটি পুনর্বার মঞ্চস্থ করে, তখন বিনয় বাঁশি জলদাস বায়েনের চরিত্রে সংযুক্ত হন। গণায়ন প্রযোজিত ‘গফুর-আমিনা সংবাদ’ নাটকে শান্তনু বিশ্বাস সূত্রধরের ভূমিকায় অভিনয় করেন। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পের যেখানে শেষ। সেখান থেকে একটি নাট্যকাহিনী গড়ে ওঠে- চির রঞ্জন দাশ রচিত ‘গফুর-আমিনা সংবাদ’। সামন্তদাস গফুর পরবর্তীতে নগরের জুট মিলের দাস হয়ে যায়। দাস প্রথার নিরন্তর ধারাবাহিকতার ভাষ্য এই নাটকে পাওয়া যায়। নাটকটির শেষ দৃশ্যের চরিত্র সমূহের জিজ্ঞাসা ছিল : ‘তাহলে এখন কি করবো।’ সম্মিলিত কোরাস হচ্ছে করার পথ একটিই- ‘লড়াই’। প্রসেনিয়ামে লাল আলোর ঝলকানি সমস্ত দর্শক উত্তেজিত, আমাদের তরুণ বয়সের প্রতিফলন করার পথ একটিই- লড়াই। পরবর্তীতে আমাদের নিখিল জীবনে ও নাটকে আমরা প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করেই গেছি। এই নাটকের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শান্তনু বিশ্বাস বাংলাদেশের নাটকের একজন আর্টিজান হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি ‘অবাস্তব গল্প’ নামে একটি নাটকে শান্তনু বিশ্বাস জেলর-এর ভূমিকায় অভিনয় করে। এর কাহিনী হচ্ছে, ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছে পান্তা ভাত খাওয়ার। এই পান্তা ভাত জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া এক জেলর ছিল শান্তনু। কর্ডের কাপড়ের কোর্ট ও একই রকমের ক্যাপ পরা, হাতে বেটনের মতো একটা লাঠি নিয়ে শান্তনু বিশ্বাস যে অভিনয়শৈলী উপহার দিয়েছেন, তা গত শতাব্দীর বা এই শতাব্দীর এই পর্যন্ত সদরুল পাশার পর শক্তিমান অভিনেতা শান্তনু বিশ্বাস। এই নাটকে আমি কারারক্ষীর ভূমিকায় অভিনয় করেছি। বাংলাদেশের নাটককে সঙ্গীত প্রধান করেছেন দুজন। একজন এস এম সোলায়মান ও অন্যজন শান্তনু বিশ্বাস।

ট্রেডবডি লিডার শান্তনু বিশ্বাসের সাথে আমার সাযুজ্য হচ্ছে আমি কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করেছি। আমি চিটাগাং চেম্বারের সচিব ও প্রধান নির্বাহী যখন ছিলাম, তখন সে ইস্পাহানী টি-এর জেনারেল ম্যানেজার। ইস্পাহানী ম্যানেজমেন্ট তাকে এতই পছন্দ করতেন যে, সে টি ট্রেডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ছিল। টি অকশন যখন শ্রীমঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আমরা উভয়ে যার যার অবস্থান থেকে ফাইট করেছি। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ হিসেবে কর্পোরেট, ট্রেড ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সে একজন সফল মানুষ।

নির্ভার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেখল মঞ্চ কাঁপানো অভিনেতা শান্তনু বিশ্বাস অনেকদিন পর মঞ্চে আসছেন। তার ঈর্ষণীয় অভিনয় দেখার জন্য কবি মনিরুল মনিরসহ আমি শিল্পকলায় যাই। ‘নির্ভার’ নাটকের স্ক্রিপটি ছিল একটু ধীরগতিসম্পন্ন। কিন্তু মাতার সন্তানাক্সক্ষার, ওর স্বামীর সেই ইচ্ছে পূরণের ছলচাতুরী, সৎ প্রচেষ্টা একটি ভালো থিম রচনা করেছিলেন শান্তনু বিশ্বাস। ক্লাইমেক্সে গিয়ে এই দম্পতি নির্ভার করে মধুরেণু সমাপয়েত (হ্যাপিলি এন্ডিলি) এই নাটকের সমাপ্তি ঘটে। শুধুমাত্র শান্তনু ও শুভ্রার অভিনয় গুণে বোদ্ধা দর্শক ইমপ্রেসড হয়ে হল থেকে বেরিয়ে যায়। সংস্কৃতি অঙ্গনে ইনট্রবার্ট, সদা হাস্যময়, সুদর্শন, বহুমাত্রিক এই অভিনেতা, তার সফল জীবন সমাপ্ত করে আমাদের নির্ভার করে চলে গেলেন। নিখিল বাংলাদেশে এত প্রিয়তা ছিল, ভাবায় যায় না। অসম্ভব বর্ষার দিনে কেঁদেছে শহীদ মিনার, কেঁদেছে শিল্পকলা প্রাঙ্গণ, কেঁদেছে মেডিকেল কলেজ, ক্রন্দশী বাংলাদেশ কেঁদেছে তার সঙ্গীতের রাজপুত্রের জন্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App