×

সাময়িকী

গানের ফেরিওয়ালা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৯, ০৮:৩৮ পিএম

গানের ফেরিওয়ালা

শুধু নিজের লেখা ও সুর করা গান কণ্ঠে নিয়ে মঞ্চে ওঠার সাহস তিনি দেখাতে পারেন অনায়াসে। মঞ্চের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অথবা টিভি চ্যানেলে আমরা দেখেছি শুধু নিজের গানের মন্ত্রজালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারার এক অসাধারণ ক্ষমতা শান্তনু বিশ্বাসের রয়েছে। নিজের লেখা গান গেয়েই তাঁর শিল্প পরিচয়টা জানিয়ে দিতে পারেন সুনিপুণ দক্ষতায়। আমরা তাঁর অনুরাগীরা সহজেই বুঝে যাই কোথায় তিনি অন্যদের চেয়ে একটু হলেও ব্যতিক্রম।

গানের শিল্পীরা অনেকেই কম-বেশি গাইতে পারেন। তবে আদ্যোপান্ত একজন গানের মানুষ হয়ে ওঠাটা একটু কষ্ট ও শ্রমসাধ্যই বটে। এই দুঃসাধ্য কাজটি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সফলভাবে করতে পেরেছেন যে কয়জন তাঁদের মধ্যে শান্তনু বিশ্বাস একজন। গানের মানুষ হয়ে গানের ভেলা ভাসানোর এই কাজটিও যে খুব অনায়াসসাধ্য ছিল তাঁর জন্য, তাও কিন্তু নয়। অন্ধকার পথে নিজের লণ্ঠনটি বারবার নিজেকে জ্বালিয়েই দুর্গম এই পথে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। ঝড়ের মুখে প্রায় নিভন্ত প্রদীপের আলোকে বাঁচিয়ে রাখতে কেউ এগিয়ে এসে দু’হাত দিয়ে আগলে রাখেনি তাঁর প্রদীপটাকে অথবা তাঁকে কিছুটা পথ হাত ধরে এগিয়েও দেয়নি। গান ভালোবেসে অন্তরের তাগিদেই গানকে অঙ্গাঙ্গি সযত্নে জড়িয়ে নিয়েছেন নিজের যাপিত জীবনের সাথে। ছোটবেলা থেকে মনের আনন্দে গান গেয়ে বেড়ে ওঠা এই শিল্পী ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী হিসেবে কণ্ঠে গান নিয়ে যুদ্ধে শামিল হয়েছেন। এরপর স্বাধীন দেশে গান নিয়ে তাঁর পথ চলার যুদ্ধটা আরো কঠিন, কিছুটা অভিমান-ভরা গল্প। আজ শান্তনু বিশ্বাস যেখানে এসে পৌঁছেছেন সেখানে পৌঁছানোর লড়াই তিনি একাই লড়ে গেছেন। নিঃস্বার্থভাবে সমর্পিত হয়েছেন নিজের সৃষ্টির কাছে... কিন্তু একটিবারের জন্যও নতজানু হননি প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকতার কাছে। প্রতিকূলতার তীব্র বিপরীত স্রোত ঠেলেই বহমান রেখেছেন তাঁর গানের ভেলাটি। গান লিখে তাতে নিজে সুর বসিয়ে গান গাওয়া এই মহান শিল্প স্রষ্টার প্রতি আমার অভিনন্দন। গানে গানে এই মানুষটা আকাশ ছুঁতে চান! আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন বুনেন। গানের ভেলা ভাসানো এই গানের মানুষটির সাথে গানে গানেই আমার পরিচয় ‘দেখেছি সাদা কালো শাড়ি, একুশে ফেব্রুয়ারি...’ এই গানটিই প্রথম শুনেছিলাম তাঁর কণ্ঠে, তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম চিরকুট প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই। শান্তনু বিশ্বাসের গানের ব্যতিক্রমী কথা অন্য ধারার সুর আর অনন্য বৈশিষ্ট্যের গায়কীর কল্যাণে গানটি মনে গেঁথে গিয়েছিল প্রথমবার শুনেই। তারপর তাঁর অন্য অ্যালবামের গানগুলো শুনে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান এবং গানের সাথে তাঁর গানের মানুষ হয়ে ওঠা আর গানের পেছনের গল্প শুনতে শুনতে এক সময় প্রিয় শিল্পীর তালিকায় তাঁর নামটি চলে এলো। বিভিন্ন ধারার বিভিন্ন শিল্পীর গান আমরা সকলেই সব সময়ই শুনি, তাদের অনেকেই জগদ্বিখ্যাত...সুরের আকাশে এক-একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু যে ঘটনাটি আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক ও মুগ্ধ করে সেটি হলো আমরা খুবই অল্পসংখ্যক শিল্পীকে জানি যাঁরা নিজে গান লিখেন, সুর করেন এবং নিজের কণ্ঠ সুধায় সেই গানগুলো দিয়ে শ্রোতাকে মুগ্ধ করতে পারেন। বাংলা গানের ইতিহাসে একটু পেছন ফিরে দেখলে এই তালিকায় যাঁদের মুখটি সমুজ্জ্বল ভেসে ওঠে তাঁদের মধ্যে ভুপেন হাজারিকা, সুমন চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা অন্যতম। এদের সাথে বাংলাদেশের যে শিল্পীর নামটি সগৌরবে যুক্ত হতে পারে সেই নামটি শান্তনু বিশ্বাস। শুধু নিজের লেখা ও সুর করা গান কণ্ঠে নিয়ে মঞ্চে ওঠার সাহস তিনি দেখাতে পারেন অনায়াসে। মঞ্চের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অথবা টিভি চ্যানেলে আমরা দেখেছি শুধু নিজের গানের মন্ত্রজালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারার এক অসাধারণ ক্ষমতা শান্তনু বিশ্বাসের রয়েছে। নিজের লেখা গান গেয়েই তাঁর শিল্প পরিচয়টা জানিয়ে দিতে পারেন সুনিপুণ দক্ষতায়। আমরা তাঁর অনুরাগীরা সহজেই বুঝে যাই কোথায় তিনি অন্যদের চেয়ে একটু হলেও ব্যতিক্রম। শুধু জীবনমুখী নয় তাঁর গান জীবনস্পর্শী। জীবনকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করে। কী গভীর মমতায় তিনি তাঁর গানে মানুষের কথা বলেন, জীবনের কথা বলেন, জানিয়ে দেন স্বপ্নের কথা ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের টুকরোগুলোকে জোড়া লাগিয়ে আবার নতুন স্বপ্ন দেখার সাহসও পাই আমরা তাঁর গানে। ‘যে মেয়েটি বুড়িগঙ্গার ধারে একা একা বসে আছে তাকে তুমি ঘরে ফেরাও’ এমন গান শুনে যে কেউই নতুন করে বেঁচে ওঠার সাহস পায়। শান্তনু বিশ্বাসের গানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাঁর গান ছবির মতো, তাঁর গান গল্প বলে যায়, কবিতাও শুনিয়ে যায়। ‘পোস্টম্যান’ গানটি যখন আমরা শুনি চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরো একটি জীবনের ছবি। সমসাময়িক চলমান জীবনের কাহিনীচিত্র। গানটি শুনতে শুনতে আপনি-আমি যে কেউই চোখ বুজে এঁকে নিতে পারি একটি কাহিনীর দৃশ্যকল্প। ‘মুজিবর মুজিবর গলা ভেঙ্গে আসে, দেশ আজ গেছে দীর্ঘশ্বাসে...’ অথবা ‘সাইরেন ধ্বনি শুনি আকাশে...’ যখন শুনি তখন কি সত্যিই সেখানে আমরা রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপন্ন সময়ের সেই অসহায়ত্বের সাইরেন প্রতিধ্বনির হচ্ছে শুনি না? আবার একইসঙ্গে বহমান গানটিতে তিনি নতুন আশায় উদ্দীপ্ত করেছেন এই গেছে- ‘আমার মরছে পড়া এই দেশটা যদি সূর্যের আলো খুঁজে পেতো, দেখার মতো এক দৃশ্য হতো’। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত অ্যালবাম খড়কুটোতে বলিখেলা নামে যে গানটা গেয়েছেন চট্টগ্রামের শতবর্ষী প্রাচীন ঐতিহ্য সেই বলিখেলার মেলাকে সুনিপুণ রঙে রাঙিয়ে তুলেছেন। নিকট-অতীতে বলিখেলার রূপ নিয়ে বিষয়ভিত্তিক এমন একটি গান আমরা শুনেছি বলে মনে করতে পারি না। কিংবা ‘শোন গল্পটা এখানেই শেষ নয়’ গানটিতে আমাদের ঘিরে থাকা, ভেঙে পড়া সময়টাকে কী মানবিক ছায়ায় মেলে ধরেছেন। ‘যে শিশু জন্মেছে, কাল কী হবে তার... ক্ষোভে বিক্ষোভে দোলে মানুষের সংসার...’ এই লাইনে আমাদের সামাজিক অসহায়ত্ব করুণ সুরে আর স্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। যে কোনো সৃষ্টির জন্য শিল্পীর একটি বিস্তৃত জীবনের সঙ্গে একটি গভীর জীবনবোধ থাকা আবশ্যক। শান্তনু বিশ্বাসের গানের কথাগুলো সেই গভীরতায় জন্ম নেয় বলেই তাঁর গান শুধু শ্রোতার আবেগকে স্পর্শ করে তা নয় একই সঙ্গে সেই গান আমাদের চেতনাবোধকে জাগ্রত করে এব সম্প্রসারিত করে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App