×

সাময়িকী

আমার হাজারো স্মৃতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৯, ০৮:৩২ পিএম

আমার হাজারো স্মৃতি

আজ ভাবতে অবাক লাগে আমার এত কাছের মানুষ সামুদা হুট করে আমাদের না জানিয়ে কেন চলে গেলেন

শান্তনু বিশ্বাস আমার সামু দা। পরিচয় ১৯৭৭ সালে অঙ্গন থিয়েটার ইউনিটে নাটক করতে এসে। ’৭৫-পরবর্তী বৈরী সময়ে তখন পথ নাটক দেখে চমকে গিয়েছিলাম। পথের মধ্যে নাটক হতে পারে আমি কখনো ভাবতেও পারিনি। একদিন সময়টা সঠিক মনে নেই রাস্তায় ঢোলের আওয়াজ আর মানুষের জটলা দেখে সেদিকে ছুটে গিয়ে দেখি মুখোশ পরা রাজা মন্ত্রী ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর গায়েন শান্তনু বিশ্বাস রাজাকে ব্যঙ্গ করে গান গাইছে সঙ্গে ঢুলি বিনয়বাঁশী। তার গায়কী আর অভিনয় দেখে পথচারীরা সবাই বিস্ময়ে স্থির হয়ে আছে। তার অভিনয় গান আর মিলন চৌধুরী রচিত বাংলাদেশের প্রথম পথ নাটক ‘যায় দিন ফাগুনো দিন’ দেখে আমার নাটকের প্রতি দুর্বলতা জেগে ওঠে। এর পর অঙ্গন থিয়েটার ইউনিটে যোগ দিয়ে শান্তনু বিশ্বাসের সাথে আমার আরো সখ্য। অঙ্গনে রোজই নাটকের মহড়া হতো। তখন বলা যায় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের, চর্চার সুবর্ণকাল ছিল। কলেজ থেকে আসার পথে জুবলি রোডের সামুদার বাসায় চলে আসতাম আমি আর পীযূষ সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে তিনজন হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতাম কবিরাজ বিল্ডিংয়ের ছাদে আমাদের রিহার্সেল রুমে। আজ ফিরিঙ্গি বাজারের সেই স্মৃতিময় কবিরাজ ভবন নেই। বিকেল থেকে রাত দশটা অবধি আড্ডা, গান বাজনা, রিহার্সেল কখনো সাহিত্যের, নাটকের, চলচ্চিত্রের, বলা যায় শিল্প সাহিত্যের সব বিষয়ের আলোচনা চলতো অঙ্গনে। সেখানে দেশ বিদেশের খ্যাত নামা কবি শিল্পী সাহিত্যিক, অভিনেতা, পরিচালক সবাই আসতেন। কখনো অনেক রাত করে আমাদের বাসায় ফেরা হতো। সামুদার ছিল অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতো তার কথা। তখন আমাদের বন্ধু বলতে অঙ্গনের সদস্য ছাড়া আর কেউ ছিল না। নাটক নিয়ে আমাদের দিনরাত্রি। একটা বিশাল সমমনা নাট্যকর্মীদের সমাবেশ আহ কি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক যা আজ কেবলই কাঁদায়। আমরা সবাই ছিলাম একে অপরের আপনজন। নিজ পরিবারকে সময় না দিয়ে অঙ্গনের সবাই হয়ে উঠেছিলাম নতুন অন্য রকম এক পরিবার। মিলন চৌধুরীর হাত ধরেই শান্তনুদার নাটকে আসা। অঙ্গনের প্রারম্ভিক যাত্রায় আমরা একঝাঁক তরুণ চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার চর্চাকে বেগবান করে তুলেছিলাম। সেই দিনগুলোতে মিলন দা, আবদুস সাত্তার, চার্লস ডায়েস, শান্তনু বিশ্বাস, সনজীব বড়ুয়া, শিল্পী ঢালি আল মামুন, লক্ষী বড়ুয়া, ঝর্ণা সেন, শুভ্রা বড়ুয়া, মোস্তাফিজুর রহমান বাদশা, প্রদীপ দাশ, শিমুল বড়ুয়া, পীযূষ দস্তিদার, শিমুল সেন, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, উত্তম সেন, শহীদুজ্জামান, আমি। সবাই ছিলাম সমবয়সের কাছাকাছি। রোজই নাটকের মহড়ায় মিলিত হতাম। সময় পেলেই চলে যেতাম সামুদার বাসায়। সবাই একসাথে প্রদীপদের মদুনা ঘাটের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, কাপ্তাই, সীতাকুণ্ডে রাত জাগা। হৈহুল্লোড় আনন্দ করে আমাদের দীর্ঘ সময় একসাথে চলা। আজ সে দিনগুলোর কথা ভাবলেই কান্না পায়। আমাদের কত স্মৃতি মিশে আছে সামুদার সাথে। সামুদার নাটকেও অভিনয় করেছিলাম। তখনতো শিল্পকলার মঞ্চ হয়নি। পাথরঘাটার সেন্ট প্লাসিড স্কুল, জামাল খানের সেন্ট মেরীস স্কুলের মঞ্চে, মুসলিম ইনস্টিটিউটের মঞ্চে আমাদের নাটক মঞ্চস্থ হতো। অনেক রাত অবধি জেগে নাটকের সেটের কাজ করতাম। মধ্য রাতে কবিরাজ বিল্ডিংয়ের ছাদে নয়তো সামুদার বাসায় গিয়ে ঘুমাতাম। একদিন আমি, পীযূষ, সামুদা ভোর বেলায় টেপ রেকর্ডার নিয়ে ভোরের পাখির গান রেকর্ড করেছিলাম ওয়ার সিমেট্রিতে গিয়ে। শরৎচন্দ্রের মহেশ নাটকের জন্য সম্ভবত। আরেকদিন ভোর বেলায় শান্তনুদা আমার বাসায় এলেন ফিফটি সিসির হোন্ডা নিয়ে। ‘যায় দিন ফাগুনো দিন’ নাটকে বিনয়বাঁশীকে ঢোল বাজাতে হবে। হঠাৎ করে কল শো করতে হবে তাই। সেই সকাল বেলায় দেওয়ানজি পুকুর পাড়ে গিয়ে পীযূষকে নিয়ে রওয়ানা হলাম কালুরঘাটে বিনয়দার বাড়িতে। বিনয়বাঁশীকে আবিষ্কার করেছিলেন সুসাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরী। তিনজন একসাথে অনেক স্মৃতি। একদিন আর্ট কলেজের নাসির ভাই কাপ্তাই তাদের বাগান বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন করেছিলেন। সেদিন চাঁদনি রাতে নদীর পাড়ে বাংলোতে কত আনন্দই না করেছি সবাই মিলে। বাংলোর ঝুল বারান্দাটা নদীর প্রায় দেড়শ ফুট ওপরে। গভীর রাত আমার ঘুম ভেঙে গেছে সামুদার ডাকে। কি ব্যাপার! সামুদা। সামুদা হাসতে হাসতে বলছে দেখ দেখ নিচে। পড়িমরি করে উঠে দেখি নিচে নদীতে নৌকায় কবি জ্যোতির্ময় নন্দী আর ঢালি আল মামুনের ফাটাফাটি চিৎকার আর খুনসুটি। এরকম কত আনন্দ আর উল্লাসে আমাদের দিনগুলো কেটেছে।

একবার অঙ্গন থেকে আমরা পিকনিকে গিয়েছিলাম সহস্রধারায়। বিকেল বেলায় রওয়ানা দিয়ে সন্ধ্যেয় পৌঁছেছিলাম গভীর অরণ্যের মধ্যখানে ঝরনার নিচে। সেখানেই আমরা তাঁবু ফেলেছিলাম। শীতের রাত। তাঁবুর বাইরে হাত রাখলেই মনে হয় বরফের মতো ঠাণ্ডায় হাত জমে যাবে। কিন্তু তাঁবুর ভেতর বেশ গরম। সে রাতে সামুদা হাঁস রান্না করেছিলেন। সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হলেও আমি আর সামুদার মুখে হাসি নেই। ভেতরে ভেতরে আমরা দুজন চিন্তিত ডাকাতের ভয়ে। জায়গাটা আমিই পছন্দ করেছিলাম। সীতাকুণ্ড মিরসরাই বারবকুণ্ড এই পাহাড়ি এলাকায় তখন পলাতক নায়েক সফি নামক এক ডাকাতের রাজত্ব। সে চাঁদাবাজি ডাকাতি খুনোখুনি নানা অপরাধে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ভয়ে অনেকেই সেখানে যেত না। আমি ভেবেছিলাম আমাদের কাছে ডাকাতি করে কি পাবে। ঘরের কাছে এত সুন্দর পিকনিক স্পট ডাকাতের ভয়ে এই স্পট মিস করা ঠিক হবে না। রিস্ক নিয়ে দেখি না। সব কিছু গুছিয়ে রওয়ানা হবার আগের দিন বাজার করতে গিয়ে সামুদাকে বললাম ডাকাতের কথা। তিনি বললেন তুমি বাজার করার আগে বললে না কেন? যাওয়া কি ঠিক হবে? আমি বললাম আপনি ভয় পাচ্ছেন সামুদা। সামুদা মুখে হাসি মেখে বললেন ভয় কিসের। আমরা কি আর টাকা পয়সা নিয়ে যাচ্ছি নাকি। অসুবিধা নেই যাবো। পরদিন বিকেল বেলা সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে সবাই বিমোহিত। সামুদাও ভুলে গেলেন ডাকাতের কথা। কিন্তু আমার মনের ভেতর সারাক্ষণই ডাকাতের ভয়। গভীর রাতে যখন প্রবল বাতাসে শুকনো পাতা উড়ে এসে তাঁবুতে শব্দ তুলতো তখনই মনে হতো এই বুঝি ডাকাত এলো। খেয়াল করলাম সামুদা মুখ ফুটে না বললেও চিন্তিত। শব্দ হলেই পাশে শুয়ে থাকা সামুদা আমার হাত চেপে ধরে রাখতো। আরো ভয় ছিল বন্য শূকরের না জানি কখন এসে হানা দেয়। পিকনিক শেষে এ নিয়ে কত হাসিঠাট্টা আজ সবই মনে পড়ছে। অঙ্গনের প্রায় নাটকেই শান্তনু দা প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতেন। সঞ্জীব বড়ুয়ার ‘বাজলো রাজার বারটা’ নাটকে একটি ছোট্ট চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন প্রহরীর চরিত্রে। এই ছোট্ট চরিত্র মঞ্চে প্রবেশ করলেই দর্শক বেশ উপভোগ করতো। শুভ্রা বড়ুয়া তখন স্কুলে পড়ে মনে হয়। শরৎ চন্দ্রের গল্প মহেশ অবলম্বনে নাটকটিতে শান্তনু বিশ্বাস জমিদারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই জমিদার আর দশটি জমিদারের অভিনয়ের মতো নয় সামুদা জমিদার চরিত্রটিকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সেই নাটকে সনজীব বড়ুয়া গফুর চরিত্রে কিশোরী শুভ্রা আমিনা চরিত্রে নায়েবের চরিত্রে শিমুল সেন দোদুল-এর অভিনয় চিরদিন দর্শকের মনে থাকবে। সেই নাটকে আমি জমিদারের লাঠিয়াল মদনার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। সেই নাটক বিচারকমণ্ডলীর বিবেচনায় সেরা নাটক হওয়ায় আমরা ঢাকায় জাতীয় নাট্য উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। সামুদার ‘দপ্তরি রাজ দপ্তরে’, ‘কালো গোলাপের দেশে’ও ‘নবজন্ম’ নাটকে অভিনয় করেছিলাম। সামুদা নবজন্মে বৃদ্ধ পিতার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। শান্তনু বিশ্বাস শুধু অভিনেতা নয়, অনেক নাটকের নাট্যকার পরিচালক। শান্তনু বিশ্বাস ’৭১ সালের একজন শব্দ সৈনিক। গায়ক গীতিকার হয়ে তিনি দুই বাংলায়ও নন্দিত। গত মাসে তার দল শিল্পকলায় কালপুরুষ নাট্য উৎসব করেছে। কিছুদিন আগেও সামুদা শুভ্রার সাথে আর্ট কলেজের বসন্ত উৎসবে দেখা হয়েছিল। আজ ভাবতে অবাক লাগে আমার এত কাছের মানুষ সামুদা হুট করে আমাদের না জানিয়ে কেন চলে গেলেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App