×

মুক্তচিন্তা

রোহিঙ্গা সমস্যা এখন আন্তর্জাতিক চরিত্রের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০১৯, ০৯:০১ পিএম

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি নিয়েও বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপে। বিষয়টি অবশ্য জাতিসংঘের এখতিয়ারে, তবু এখানে বড় তরফ ওয়াশিংটন। এক কথায় আর দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় নির্ভর নয়, বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক চরিত্রের। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে সেভাবেই তৎপর থাকতে হবে।

মিয়ানমারের সামরিক সরকার, কার উসকানিতে বলা কঠিন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা গণহত্যার যে আগুনের খেলা শুরু করে, তা গণতন্ত্রের মানসপুত্রী নামে পরিচয় করানো অং সান সু চির কথিত গণতন্ত্রী সামরিক সরকার একইভাবে অনুসরণ করেছে। পরিণামে এখন দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের কাঁধে চেপে রয়েছে। মিয়ানমার নানা রাজনৈতিক-কূটনৈতিক কৌশলে তাদের প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে চলেছে। প্রচেষ্টা অবশ্য জাতিসংঘের। জাতিসংঘ তো অধিকাংশ সময়ই নখদন্তহীন সংগঠন, মার্কিন স্বার্থের বাইরে কদাচিত তাদের সক্রিয় হতে দেখা যায় এবং সেক্ষেত্রেও সর্বদা সফল নয়। এই কিছুদিন আগে জাতিসংঘের স্বনামখ্যাত সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যে একজনের কমিশন গঠন করা হয় তার প্রতিবেদন-পরামর্শও মিয়ানমার সরকার মানেনি। কারণ তার গোড়া শক্ত। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষপট বিচারে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়ার প্রধান কারণ মিয়ানমারের সমর্থনে বড় তরফ হচ্ছে চীন। সেইসঙ্গে তাল মিলাচ্ছে রাশিয়া এবং বাংলাদেশের বড় প্রতিবেশী মিত্র ভারত। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যবর্তী অবস্থানে এক ধরনের ধোঁয়াটে নীতি নিয়ে, রোহিঙ্গা ভারাক্রান্ত বাংলাদেশ অন্তত এ ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ, মিত্ররাও মুখ ফিরিয়ে। রোহিঙ্গা ইস্যু তথা রাখাইন অঞ্চল নিয়ে চলছে নানা আন্তর্জাতিক স্বার্থের খেলা। একটু আগে যে গণহত্যার আগুনের কথা বলা হয়েছে সেই আগুন নানা স্বার্থবাহী হয়ে ছড়িয়ে গেছে বিশ্ব কূটনীতির সবখানে। মনে হচ্ছে এতদিনকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে আপন পাতে টানার কথা ভাবছে নানা পরোক্ষ প্রক্রিয়ায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ শক্তিগুলো এখন বিশ্ব নিয়ে নতুন খেলা শুরু করেছে। কেউ তার সামরিক শক্তির জোরে, কেউ তার অর্থনৈতিক শক্তির জোরে। বিশ্ব রাজনীতিতে এখন বাঘ-সিংহের লড়াইটা নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বে সর্বাধিক প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এর প্রেক্ষাপটে রয়েছে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন এবং বিশ্বশক্তির নতুন মেরুকরণ। এখন বিশ্ব অর্থনৈতিক লড়াইটা প্রধানত চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। তাতে অন্যান্য বিশ্বশক্তি যে যার স্বার্থমাফিক নতুন দুই শিবিরভুক্ত। তবে এ ক্ষেত্রে মিত্র আহরণে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্লাটা ভারী। হলে কি হবে? অর্থের জোর তো কম নয়, তাই চীন এশিয়া-আফ্রিকায় তার রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। সেটা একদিকে যেমন কূটনৈতিক-রাজনৈতিক, তেমনি অন্যদিকে বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ নির্ভর অর্থনৈতিক। অন্যদিকে ভূ-সামুদ্রিক। এখানেই মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত।

দুই. সবাই জানেন, আমরাও জানি- রোহিঙ্গাদের তাদের নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমার যে ধরনের জেদ, প্রতারণা ও বাধার সৃষ্টি করে বছরের পর বছর সময় পার করে দিচ্ছে তার পেছনে সমর্থনের বড় খুঁটি চীন। সঙ্গে অন্যরা। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখেশুনে এবং বঙ্গোপসাগরে ও ভারত মহাসাগরে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভেবে যুক্তরাষ্ট্র মনে হয় নড়েচড়ে বসছে। হয়তো ভাবছে, সব স্বার্থই তো চীনের ভোগে চলে যাচ্ছে। তাই কি হঠাৎ করে সেদিন মার্কিন কংগ্রেসে শেরম্যান বোমা ফাটালেন এই বলে যে, রোহিঙ্গা স্বার্থে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যটিকে কেটে নিয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত করা হোক। স্বভাবতই একে কেউ বলছেন ‘অবাস্তব’ প্রস্তাব, কেউ একে আন্তর্জাতিক বিচারে সঠিক ভাবছেন না, কারো মতে উদ্ভট। আর ক্রুদ্ধ মিয়ানমার তো তা এককথায় উড়িয়ে দিয়েছে। আসলে আমাদের বিচারে এটা মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল। বাংলাদেশের কলামিস্টদের বিরল সংখ্যকই বিষয়টিকে আলোচনায় টেনেছেন। আসলে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ রাখাইন রাজ্যের বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন অবস্থানগত কারণে। চীন তো বেশ কিছুদিন থেকেই সেখানে নিজ আন্তর্জাতিক স্বার্থে নৌবন্দর নির্মাণে ব্যস্ত। মিয়ানমারে তাদের ব্যাপক বিনিয়োগ। তার বৈশ্বিক রাজনীতি ও বাণিজ্য স্বার্থে তারা পুরোপুরি মিয়ানমারকে ব্যবহার করছে। তাই রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারে অন্যায় ও অমানবিক তৎপরতা সম্পর্কে তারা কথা বলছে না, যেমন বলেনি একাত্তরে পাকিস্তানিদের পূর্ববঙ্গে গণহত্যার বিরুদ্ধে। তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ মিয়ানমারকে চটাতে কেউই চায় না তাদের নিজ স্বার্থের কারণে। যেমন আমাদের বড় মিত্র দেশ ভারত। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাদের ভূমিকা নেতিবাচক। একই ভূমিকা রাশিয়ারও, যেকথা ইতোপূর্বে বলা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতো বাংলাদেশের জন্য বড় সংকটের, সমস্যার।

তিন. এমন সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জন্য জরুরি তার ঘনিষ্ঠতম মিত্রদেশ প্রতিবেশী ভারতের ওপর রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপ সৃষ্টি করা। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের হাতে তো একাধিক তাস রয়েছে। তবে যে কথা আগেও বলেছি, আবারো বলছি, এ ক্ষেত্রে বড় তরফ চীন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর উপলক্ষে অনেক লেখা হয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুর চৈনিক গুরুত্ব নিয়ে। আমরাও লিখেছি বাংলাদেশ পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণের কথা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পালাক্রমে চীনের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন এবং চীনারা তাদের ঐতিহ্যমাফিক ইতিবাচক ভাষণে সাড়া দিয়েছেন। ঢাকায় ফিরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা ফেরাতে চীনের কাছে আশ্বাস পেয়েছি।’ কী ধরনের আশ্বাস, কতটা সদিচ্ছার আশ্বাস তা আমরা জানি না, জানে একমাত্র চীনই। মুশকিল হলো, আমরা সহজেই আশ্বাসে ভুলি। ইতোপূর্বে বিভিন্ন ইস্যুতে আশ্বাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। সেসব ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। তিস্তা নদীর পানিচুক্তি নিয়ে ঢাকায় এসে এবং দিল্লি ফিরে গিয়ে পরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের অনেক আশ্বাস আমরা পেয়েছি, কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছু হয়নি। ব্যক্তি মনমোহন সিংয়ের আশ্বাসে হয়তো সদিচ্ছার অভাব ছিল না, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কূট জটিলতায় কিছু করে উঠতে পারেননি। আশ্বাস তো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদিও দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। কই, কিছু হলো? থাক তিস্তা প্রসঙ্গ। ওটা আশ্বাসের উদাহরণমাত্র। এখন গলার কাঁটা রোহিঙ্গা শরণার্থী- যা বাংলাদেশের জন্য আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমস্যাও বটে। তাই এ সমস্যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিরসনের চেষ্টা চালাতে হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চীনের কাছে মিয়ানমার রাজনৈতিক অঙ্গীকার করেছে।’ এসব আশ্বাসবাণীতে ভরসা করে বসে থাকা খুবই ভুল কাজ হবে বলে মনে করি। এই ধীরে চলানীতিও সঠিক হবে বলে মনে করি না। বরং নানা ইস্যুতে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশে চীনা স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে বারবার চীনকে তার আশ্বাসের কথা, তার কমিটমেন্ট রক্ষার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়াও এ বিষয়ে ইঙ্গ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহারের চেষ্টা চালাতে হবে। ওদের হাতে অবরোধের অস্ত্র আছে। মিয়ানমারে তাদের স্বার্থও কম নয়, সে জন্য সু চির অনুপ্রবেশ ঘটানো, কিন্তু সে পরিকল্পনা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি মিয়ানমার সামরিক জান্তার একরোখা অবস্থানের কারণে। স্বভাবতই ওরা চাইবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে চাপের মুখে রেখে সুবিধা আদায় করতে। শেরম্যান প্রস্তাব তেমন আভাস-ইঙ্গিত দেয়। কাজেই বাংলাদেশকে এ সুযোগও কাজে লাগাতে হবে। ভাবতে হবে আর কোন পথে মিয়ানারকে চাপে ফেলা যায়। আর রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি নিয়েও বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপে। বিষয়টি অবশ্য জাতিসংঘের এখতিয়ারে, তবু এখানে বড় তরফ ওয়াশিংটন। এক কথায় আর দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় নির্ভর নয়, বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক চরিত্রের। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে সেভাবেই তৎপর থাকতে হবে।

আহমদ রফিক : কবি, প্রাবন্ধিক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App