×

জাতীয়

রেলের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০১৯, ১২:৫৯ পিএম

রেলের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ
সারা দেশে রেল নেটওয়ার্কে সর্বমোট ২ হাজার ৫৪১টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ১ হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। এর মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে রেলের স্থায়ী রক্ষী রয়েছে আর ৮২০টিতে রয়েছে চুক্তিভিত্তিক রেলরক্ষী। রক্ষীবিহীন ক্রসিং আছে দেড় হাজার অর্থাৎ ৬০ শতাংশ ক্রসিংয়ে রক্ষী নেই। ফলে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে প্রায়ই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। গত সোমবার রাতে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার বেতকান্দি এলাকায় অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বর-কনেসহ মাইক্রোবাসের ১১ জন নিহত হন। আরো বেশ কয়েকজন আহত হয়ে হাসপাতালে। এ ছাড়া গত বছর রাজধানীর সায়েদাবাদ, কারওয়ান বাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন অবৈধ লেভেল ক্রসিং পার হতে গিয়ে ৬২ জন এবং পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হন। আহন হন ৫ শতাধিক। বাংলাদেশ রেলওয়ের জনসংযোগ শাখা সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে রেল নেটওয়ার্কে ২ হাজার ৫৪১টি লেভেল ক্রসিং আছে। যার মধ্যে অনুমোদিত ক্রসিংয়ের সংখ্যা মাত্র ৭৮০টি। বাকি ১ হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। আবার ৭৮০টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে স্থায়ী রক্ষী বা গেটকিপার আছে, সম্প্রতি ৮২৪ জন চুক্তিভিত্তিক গেট কিপার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আবার গত ২-৩ বছরে রেলকে না জানিয়ে বা অনুমোদন না নিয়ে এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও রেললাইনের ওপর লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করে যাচ্ছে। রাজধানীতে রেলপথের প্রতি ১ থেকে ২০০ গজ পর পর লেভেল ক্রসিং বানাচ্ছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এসবের জন্য রেলের কাছ থেকে তারা কোনো অনুমোদন নেয়নি। রাজধানী ও এর আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টিরই কোনো অনুমোদন নেই, যা রেলওয়ের আইনে নিষিদ্ধ। এ নিয়ে মামলাও করা হয়েছে। কিন্তু অবৈধ ক্রসিং বানানো থামছে না। এসব ক্রসিংয়েই এখন প্রায়ই দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে। এ বিষয়ে রেলের উপ-মহাপরিচালক (এডিজি) অপারেশন মিয়া জাহান জানান, প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথে যে কোনো স্থানে অনুমোদন না নিয়েই লেভেল ক্রসিং বানাচ্ছে স্থানীয় জনসাধারণ। এ কারণে ট্রেনগুলো নির্ধারিত গতিতে চলতে পারে না, যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটেছে, মারা যাচ্ছে মানুষ। ২০১৪ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত রেলের প্রায় হাজার খানেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশই অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে। এসব দুর্ঘটনায় ১২৫ জন মারা গেছে। এর মধ্যে শুধু অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে ১১০ জন (নথিভুক্ত) মারা গেছে। যার মধ্যে ২০১৪ সালে ৫৪ জন, ২০১৫ সালে ১৩ জন, ২০১৬ সালে ১১ জন, ২০১৭ সালে ১৫ জন, ২০১৮ সালে ১৩ জন মারা গেছে বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, বিএনপি সরকার রেললাইনের উন্নয়নে কোনো কাজ করেনি বরং তারা রেললাইন তুলে ফেলেছে। এ ছাড়া এ সময় গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে কর্মী ছাঁটাই করা হয়। সে কারণে দীর্ঘদিন ধরে কর্মী সংকটও রয়েছে। তা ছাড়া অবৈধ লেভেল ক্রসিং তৈরি হয়েছে অনেকগুলো। যার কোনো অনুমোদন নেই। যার ফলে সব ক্রসিংয়ে কর্মী দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে অবৈধ ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে যাতে আর প্রাণহানি না ঘটে সে কারণে আগামীতে ১৩শ’র মতো গেটকিপার নিয়োগ দেয়া হবে। এ নিয়োগ সম্পন্ন হলে গেটের সমস্যা মিটে যাবে। তিনি জানান, অনেক স্থানে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের ফলে রেলের দুর্ঘটনা বাড়ছে, এটা অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক। এসব অবৈধ ক্রসিং যারা বানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। রেলসূত্র জানায়, অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ শতাধিক মামলা করেছে, যেগুলো এখন বিচারাধীন আছে। পক্ষান্তরে লেভেল ক্রসিংগুলো মৃত্যুফাঁদ হয়ে ঠিকই রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোতে রেল কর্তৃপক্ষ ‘সতর্কীকরণ’ সাইনবোর্ড টানিয়ে তাদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে। সড়ক পরিবহন বিভাগের মোটর ভেহিকেল আইনের ২৪ ধারায় বলা আছে, ‘রেললাইনের ওপর দিয়ে পার হওয়ার সময় ধীরে এবং দেখে পার হতে হবে’। এই ধারা কেউ মানে না বলেই দুর্ঘটনা ঘটে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর রাজধানীর সায়েদাবাদে লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন-বাস সংঘর্ষের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটি গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংয়ে উড়াল সেতু নির্মাণের সুপারিশসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ পেশ করে। সুপারিশগুলো হচ্ছে- ক্রসিং গেটের আশপাশে অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলা, লোকবল বাড়ানো, গেটম্যানের স্থায়ী পদ সৃষ্টি ও উড়াল সেতু নির্মিত হলে তার পাশে দেয়াল তুলে দেয়া, ট্রাফিক সার্জেন্ট মোতায়েন, যতদিন গেটম্যান স্থায়ী না হয়, ততদিন গেটম্যানের পারিশ্রমিক বর্তমানের ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ১৬০ টাকা করা। দীর্ঘ এক বছরেও এসব সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App