×

মুক্তচিন্তা

পাবলিক লাইব্রেরি নিয়োগ পরীক্ষার পাঠকক্ষ!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০১৯, ০৯:০০ পিএম

সমস্যাটি এখন আর হালকা নেই, গভীর। পরিস্থিতি ক্রমেই সৃজনশীলতা ও গবেষণাকর্মের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছে, ব্যক্তিমানসের আলোকপ্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এর গভীরতা ধরতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু বিনাশ সাধনে আন্তরিক থাকেননি। নিজস্ব বইপুস্তক, গাইড ইত্যাদি নিয়ে পাঠকক্ষে প্রবেশ ও চেয়ার দখল বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার একটি লিখিত নোটিস দেয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে তারা দায়িত্ব সেরেছেন।

লাইব্রেরিতে গিয়ে সৃজনশীল বই নাড়াচাড়ার অভ্যাস স্কুলজীবন থেকে। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল ছিল তার প্রারম্ভিক উৎস। স্কুলের লাইব্রেরিতে ‘আউট বই’ বা সৃজনশীল বই বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণেই ছিল। টিফিন পিরিয়ড বা অন্য কোনো সময় সুযোগ পেলেই ওখানে গিয়ে বসতাম, মজুদ করা হরেক রকম বইয়ে চোখ বোলাতাম। খুবই আনন্দ পেতাম ওতে। সুযোগটা থেকে যায় মাধ্যমিকের স্তর উত্তীর্ণের পর উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরও। শিক্ষাক্রমের নতুন ঠিকানা আনন্দমোহন কলেজের লাইব্রেরি ছিল আরো অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সৃজনশীল নানা রকম বইয়ে ঠাসা। আমাদের সময়কার কলেজ জীবন ছিল অনেকটা স্বাধীন প্রকৃতির। নিজ তাগিদে পড়াশোনাটা মুখ্য ছিল। নোট নেয়ার জন্য একটিমাত্র খাতা হাতে নিয়ে আমরা কলেজে যেতাম। তাই বলে এমন ধারণা পোষণের অবকাশ নেই যে শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস করাতেন না। করাতেন, তবে কোনো কারণে কেউ অনুপস্থিত থাকলে এ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাধাতেন না। তাদের পড়ানোও ছিল উচ্চমানের, মনোগ্রাহী উপস্থাপনায় সমৃদ্ধ থাকত অধিকাংশের লেকচার। মনোগ্রাহী সেই লেকচারের আকর্ষণে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকলেও সহজে শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দিত না। সুযোগটা ছিল অন্য ক্ষেত্রে। ডাবল শিফটের বিড়ম্বনা সেকালে ছিল না। একটিমাত্র শিফট ছিল; সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। ফাঁকে ফাঁকে থাকত ‘অফ পিরিয়ড’। সেই অফ পিরিয়ডের সময়টা শিক্ষার্থীরা কাটাত গল্পগুজব, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, লাইব্রেরি চর্চা ইত্যাদি উপায়ে। আমিও যুক্ত থাকতাম সেসব কর্মকাণ্ডে। এর মাঝে লাইব্রেরিতে গমন বেশ পছন্দনীয় ছিল। ঘাঁটাঘাঁটি করতাম ‘আউট বই’, বিশেষত উপন্যাস। স্কুল-কলেজের বাইরে আরো দুটি জায়গা ছিল বইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ার। একটি ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট’, অপরটি ‘বাংলাদেশ পরিষদ’ যার পূর্ব নাম ছিল ‘পাকিস্তান কাউন্সিল’। ময়মনসিংহের বইপ্রেমীরা সেখানে যেতেন, বই পড়তেন, আবার পড়ার জন্য বাড়িতে নিয়ে আসতেন সদস্য হলে। আমারও অভ্যাস গড়ে ওঠে লাইব্রেরি দুটিতে যাওয়ার। ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট’ এখনো পূর্ব নামে টিকে আছে, ‘বাংলাদেশ পরিষদ’ বোধকরি পাবলিক লাইব্রেরি বা গণগ্রন্থাগারের পরিচিতি পেয়েছে। পূর্বের অভ্যাস মতো এখনো সুযোগ পেলে ঢাকায় পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুঁ মারি। সেটি করতে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরি ‘সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার’-এর কথা ধরি। সেখানে উপচেপড়া ভিড় থাকে সর্বদা। সকালে লাইব্রেরি খোলার সঙ্গে সঙ্গে বসার সব আসন পূর্ণ হয়ে যায়, শূন্য হয় বন্ধ হওয়ার কালে। আসনগুলো পূর্ণ হয় বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরিতে নিয়োগ প্রার্থীর দ্বারা। শহরের অন্য একটি লাইব্রেরি, ‘শাখা সরকারি গণগ্রন্থাগার’-এ একাধিকবার গিয়ে একই চিত্র প্রত্যক্ষ করেছি। নিয়োগপ্রার্থী ছাড়া অন্য পাঠকদের সেখানে বসার জায়গা পাওয়া খুব দুরূহ ব্যাপার। শাহবাগের জাতীয় গ্রন্থাগারটিতে প্রবীণদের জন্য ‘প্রবীণ কর্নার’ আছে ৫/৭টি চেয়ার বরাদ্দসমেত। সেটিও নিয়োগপ্রার্থীমুক্ত থাকে না। সকাল থেকে এসে আসনগুলো দখলে নিয়ে নেয় তারা, কদাচিৎ এর ব্যতিক্রম হয়। প্রবীণরা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও ভ্রুক্ষেপ করে না নিয়োগের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণকারীরা। লাইব্রেরির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘প্রবীণ কর্নার’ এর এ দুরবস্থা কখনো দূর করার চেষ্টা নেন, আবার কখনো তা দেখেও দেখেন না। কঠোর না হতে হতে এমন অবস্থা হয়েছে যে তাদের এখন কঠোর হতে গিয়েও তর্কে লিপ্ত হতে হয় নির্দেশ-অমান্যকারীদের সঙ্গে যা নিজে প্রত্যক্ষ করেছি কয়েকদিন আগে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো নিয়োগপ্রার্থীরা লাইব্রেরির বই নাড়াচাড়া করেন না, নাড়াচাড়া করেন গাইড কিংবা কোচিংয়ের নোটশিট বা নিজস্ব বই-খাতাপত্র ইত্যাদি। শাহবাগের সেই জাতীয় লাইব্রেরিতে একটি লিখিত নির্দেশনামা আছে, যাতে বলা হয়েছে পাঠকক্ষে নিজস্ব খাতা/কলম ছাড়া নিজস্ব বই/ গাইডবই নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। এ ছাড়া পাঠকক্ষের চেয়ার কোনোভাবেই দখলে রেখে বাইরে অবস্থান করা যাবে না, কোনো চেয়ার আড়াআড়ি/ফোল্ডিং করে রাখা যাবে না ইত্যাদি। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে ওই নির্দেশনামার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নিয়োগপ্রার্থীরা যথারীতি তাদের নিজস্ব বই-খাতাপত্র-গাইড-নোটশিট ইত্যাদি নিয়ে পাঠকক্ষে ঢুকছেন, চেয়ার আগলে রাখছেন সারাদিনের জন্য। তাদের ভিন্ন অন্যরা সেখানে বসার জায়গা পাচ্ছেন না। এ ব্যাপারে গণমাধ্যম নিশ্চুপ নেই, সমস্যাটি নিয়ে প্রতিবেদন হচ্ছে। প্রতিবেদনের অন্তত একটি আমার চোখে পড়েছে। সেটি সম্ভবত ‘ঢাকা ট্রিবিউন’ পত্রিকার। সরেজমিন প্রতিবেদনে পূর্বোক্ত নির্দেশনামা অমান্যের বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদকের ভাষ্যমতে ব্যবহারকারীরা এখন বেশ সংঘবদ্ধ, লাইব্রেরি কর্মীরা সে তুলনায় নিশ্চুপ বা অপারগ। নিয়মাবলী নিয়ে প্রথম থেকে কঠোর হলে হয়তো এ অবস্থা হতো না। পাবলিক লাইব্রেরিসমূহের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে ‘গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর’ নামের সরকারি বিভাগ যারা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। বিভাগটির অফিস শাহবাগের লাইব্রেরি চত্বরেই। সেখানে বড়কর্তাদের অনেকেই বসেন। তাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই সমস্যা গভীর হলো যা বিশেষ পরিতাপের বিষয়। নিয়োগপ্রার্থী যারা পাবলিক লাইব্রেরিকে বেছে নিচ্ছেন নিয়োগ পরীক্ষার অনুশীলন কক্ষ হিসেবে; হতে পারে তারা নিরিবিলি পড়াশোনার সুযোগ নিতে গিয়ে এমনটি করছেন, অথবা করছেন গ্রুপ স্টাডির প্রয়োজনে। এটি এক ধরনের বাস্তবতা। বিপরীতক্রমে আছে আরেক বাস্তবতা। সেটি হলো : সৃজনশীল বইপুস্তকের অনেক পাঠক পাবলিক লাইব্রেরিতে যান কাক্সিক্ষত বইয়ের খোঁজে, কিংবা যান অনেক লেখক-গবেষক তথ্য সংগ্রহের জন্য; তাদের সে সুযোগ রহিত হচ্ছে সেখানে জায়গা না পাওয়ায়। মনে রাখা আবশ্যক যে পাবলিক লাইব্রেরি হচ্ছে সৃজনশীল, মননশীল ও নানারকম গবেষণামূলক গ্রন্থের সংগ্রহকারক। জ্ঞানবিজ্ঞানের পুরনো-নতুন মিলিয়ে মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য সব গ্রন্থ থাকার কথা সেখানে যেগুলোর অর্থমূল্যও সাধারণত বেশি। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশে হয়তো সুযোগ এতটা নেই, কিন্তু যতটা আছে তাও যদি ব্যবহার করতে না পারেন জ্ঞানপিপাসু ও লেখক-গবেষকরা তাহলে নিঃসন্দেহে সেটি দুঃখজনক প্রতীয়মান হবে এবং হচ্ছেও সেরকম। এ ছাড়া এসব ব্যবহারকারীর প্রয়োজন মনোযোগ দেয়ার মতো একটু সুনসান শান্ত পরিবেশ। বলাবাহুল্য, বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো, নিয়োগপ্রার্থীর অস্বাভাবিক চাপে গিজগিজে অবস্থা সেখানে, বসারও জায়গা থাকে না। এর প্রতিকার প্রয়োজন। নয়তো জ্ঞানের আলো দীপ্তি না ছড়িয়ে ম্রিয়মাণ হবে দিন দিন। আরেকটি বিষয় এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে শাহবাগের জাতীয় পাবলিক লাইব্রেরি বাদে অন্যত্র বই শ্রেণিবিন্যস্ত করে রাখা হয় না, অন্তত আমি ঢাকার অন্য যে শাখা গণগ্রন্থাগারের কথা উল্লেখ করেছি পূর্বে সেখানে তো নয়ই। যার দরুন ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনীয় বই খুঁজে পেতে প্রচণ্ড দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের বই অনলাইনে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সে জন্য ডাটাএন্ট্রির প্রয়োজনে ‘তাক’ খালি করে সব বই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। একযোগে সরিয়ে না ফেলে ধীরে-ধীরে তা করা হলে লাইব্রেরিটি ব্যবহারযোগ্য থাকত। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভেবে দেখবেন আশা করি। বলছিলাম পাবলিক লাইব্রেরির পাঠকক্ষে নিয়োগপ্রার্থীদের দিনব্যাপী ভিড়ে বোদ্ধা পাঠক ও লেখক-গবেষকদের জায়গা না পাওয়ার কথা। দিন যত যাচ্ছে সমস্যা প্রকট হচ্ছে, আরো প্রকট হওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে ভাবা দরকার। কেন্দ্রের ‘প্রবীণ কর্নার’-এর কথা উল্লেখ করেছিলাম। এ প্রসঙ্গে ক’দিন আগে দেখা একটি ঘটনার কথা বলি। খুবই স্বল্প আসনের এই কর্নারে জায়গা না পেয়ে ২/৩ জন প্রবীণ, সম্ভবত গবেষণার প্রয়োজনে, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছিলেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সেটি দেখে এগিয়ে এলেন লাইব্রেরির এক মহিলাকর্মী, আসন খালি করতে বললেন এক তরুণীকে প্রবীণের জন্য। সে জন্য ওই কর্মীকে কটু কথা শুনতে হয়েছিল তরুণীটির। ঢাকার অভিজ্ঞতার আলোকে নিবন্ধটি রচিত। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের আওতায় বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে, এমনকি কোনো কোনো উপজেলায়ও পাবলিক লাইব্রেরি আছে। আছে কয়েকটি শাখাও। সেগুলোও নিয়োগপ্রার্থীদের পদভারে ভারী কিনা অধিদপ্তর তা তলিয়ে দেখলে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। সমস্যাটি এখন আর হালকা নেই, গভীর। পরিস্থিতি ক্রমেই সৃজনশীলতা ও গবেষণাকর্মের প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছে, ব্যক্তিমানসের আলোকপ্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এর গভীরতা ধরতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু বিনাশ সাধনে আন্তরিক থাকেননি। নিজস্ব বইপুস্তক, গাইড ইত্যাদি নিয়ে পাঠকক্ষে প্রবেশ ও চেয়ার দখল বিষয়ে নিষেধাজ্ঞার একটি লিখিত নোটিস দেয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে তারা দায়িত্ব সেরেছেন। বাস্তবায়নে উদ্যোগী হননি। সমস্যা পাশ কাটানোর সুযোগ এখন আর অবশিষ্ট নেই, এবার সমাধানে সচেষ্ট হতে হবে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, কিংবা তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে। যে কোনো মূল্যে প্রকৃত ব্যবহারকারীদের পাবলিক লাইব্রেরিতে গমন ও পাঠকক্ষ ব্যবহার নিষ্কণ্টক করতে হবে। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর ‘জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি’ প্রণয়ন করেছিল ২০০১ সালে। এর পরিমার্জন দরকার। ওই গ্রন্থাগার নীতিতে পাঠকক্ষ ব্যবহার সম্পর্কিত নির্দেশনা নেই, তার সংযোজন সময়ের দাবি।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App