×

জাতীয়

দুধে প্রাণঘাতী সিসা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০১৯, ১২:৪৫ পিএম

দুধে প্রাণঘাতী সিসা
সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই যে ১৪ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধকে জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বলছে, তার ১১টির নমুনায় সিসা পাওয়া গেছে। পাশাপাশি বাজারে বিক্রি হওয়া খোলা দুধের নমুনায় ক্যাডিমিয়াম রয়েছে। হাইকোর্টে জমা দেয়া নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে এসব তথ্যা পাওয়া গেছে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছে সে বিষয়ে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল মঙ্গলবার এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বিসিএসআইআর, প্লাজমা প্লাস, ওয়াফেন রিসার্চ, পারমাণু শক্তি কমিশন ও আইসিডিডিআরবির ল্যাবে পাস্তুরিত দুধ, খোলা দুধ ও গো-খাদ্য পরীক্ষা করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। সেই পরীক্ষায় বিএসটিআইর অনুমোদিত ১৪টি কোম্পানির মধ্যে ১১টির পাস্তুরিত দুধে সিসা পাওয়া গেছে। কোম্পানিগুলো হলো- মিল্কভিটা, ডেইরি ফ্রেশ, ইগলু, ফার্ম ফ্রেশ, আফতাব মিল্ক, আল্ট্রা মিল্ক, আড়ং ডেইরি, প্রাণ মিল্ক, আইরান, পিউরা ও সেইফ মিল্ক। আদালতের আদেশে বলা হয়, ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে বিষয়ে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দিতে হবে। এ ছাড়া পশু চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো ফার্মেসি এনিমেল অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বা বিতরণ করতে পারবে না। কোনো খামারি বা কেউ প্রেসক্রিপশন ছাড়া গবাদিপশুকে অ্যান্টিবায়োটিক দিতেও পারবে না। আদেশের পাশাপাশি একটি রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। জনস্বার্থে দুধের দূষণ পরীক্ষা ও গবেষণায় বিএসটিআই নিবন্ধিত দুধ কোম্পানিগুলোকে একটি তহবিল গঠন করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। বিএসটিআই এবং দুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ওই প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম। বিএসটিআইর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার সরকার এম আর হাসান। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। আদেশের পর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল ইসলাম বলেন, বিএসটিআই ২০০২ সালে পাস্তুরিত দুধের যে মান নির্ধারণ করেছিল তার ভিত্তিতেই বাজারে থাকা দুধের নমুনা পরীক্ষা করে এই প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। তবে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক বা ডিটারজেন্টের উপস্থিতি সেখানে পরীক্ষা করা হয়নি। সিসা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক, অনেকটা ‘ স্লো পয়জনিংয়ের’ মতো। দুধসহ যে কোনো ভোগ্যপণ্যে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক এ বিষয়ে ভোরের কাগজকে বলেন, প্রথমত, সিসা মানবদেহের নার্ভের ক্ষতি সাধন করে। দেহের অঙ্গপ্রতঙ্গেরও জন্যও এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে। সবচেয়ে বড় বিষয়, এটি মানবদেহে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করতে পারে এবং বছরের পর বছর ধরে ক্ষতি করতে থাকে। ফলে মানুষের কার্যক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে। একপর্যায়ে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দেয় এই সিসা। সিসাকে স্লো-পয়জনের সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ভোরের কাগজকে বলেন, সিসা কখনো হজম হয় না। এটি দুধসহ যে কোনো খাবারের মাধ্যমে শরীরের প্রবেশ করে জমা হতে থাকে। একটা পর্যায় নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় সিসা। কিডনি থেকে শুরু করে শরীরের অনেক অর্গান অকার্যকর করে দিতে পারে এ সিসা। বিএসটিআইর উপপরিচালক রিয়াজুল হক এ প্রতিবেদককে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনানুযায়ী ৪টি ল্যাবে দুধ পরীক্ষার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। আমাদের কার্যক্রম চলছে। নমুনা সংগ্রহ করে যত দ্রæত সম্ভব আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে। প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় গো-খাদ্য, দুধ, দই ও বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ নিয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ চালায় জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগার (এনএফএসএল)। তাতে দুধে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসা পাওয়া যায়। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর দেখে গত ১১ ফেব্রুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেয় হাইকোর্টের এই বেঞ্চ। আদেশে বলা হয়, ১৫ দিনের মধ্যে জরিপ চালিয়ে বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটিকে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে। এরপর ২৩ জুন বিএসটিআইর আইনজীবী আদালতকে বলেন, বিএসটিআই যেসব প্রতিষ্ঠানকে পাস্তুরিত দুধ বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে, কেবল তাদের মান ঠিক থাকছে কিনা তা দেখভাল করার দায়িত্ব বিএসটিআইর। আদালত তখন আদেশ দেন, বিএসটিআইর নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কতগুলো কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ ঢাকার বাজারে আছে দুই সপ্তাহের মধ্যে তার তালিকা দিতে হবে। এদিকে আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় বাজারে থাকা ৭৫ শতাংশ পাস্তুরিত দুধে ভেজাল থাকার তথ্য এলে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করে বাজারের পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সচিব এবং বিএসটিআইর মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের পর বিএসটিআই গত ২৫ জুন যে প্রতিবেদন দেয়, সেখানে ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান না থাকার কথা আদালতকে জানানো হয়। এদিকে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ বাজারে জরিপ চালিয়ে যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার তা জমা দেয়। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতির কথা জানিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ওই গবেষকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন। তিনি বলেন, এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশে প্রটোকল মানা হয়নি। পিয়ার রিভিউড জার্নালে যদি প্রকাশ করে থাকেন তাহলে অবশ্যই আগামী সাত দিনের মধ্যে তা মন্ত্রণালয়ে হাজির করুন। যদি না করেন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আপনাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক গত ২৫ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাতটি প্যাকেটজাত (পাস্তুরিত) দুধের নমুনা পরীক্ষা করে সেগুলোতে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App