×

জাতীয়

মাদকে বুঁদ কিশোর গ্যাং

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০১৯, ১২:১৬ পিএম

মাদকে বুঁদ কিশোর গ্যাং
মাদকে মেতেছে কিশোররা। সারাক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকছে নেশার ঘোরে। হয়ে উঠছে অসহিষ্ণু। ঠুনকো ঘটনা ঘিরেও জড়িয়ে পড়ছে সহিংসতায়। পাড়া-মহল্লায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, স্কুল-কলেজের সামনে আড্ডা, মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া, তরুণীদের উত্ত্যক্ত করা, দল বেঁধে মাদক সেবন, এক স্টাইলে চুল কাটাসহ বিভিন্ন অপকর্ম করতে গড়ে তুলছে ‘কিশোর গ্যাং’। দিন দিন তারা হয়ে উঠছে ভয়াবহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারে এসব গ্রুপ গড়ে উঠছে হরদম। এক গ্রুপের দেখাদেখি জন্ম নিচ্ছে আরেক গ্রুপ। প্রতিটি গ্রুপের কাছে রয়েছে ধারালো অস্ত্র। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে প্রতিপক্ষ ভাবলে ঘটছে খুনোখুনির ঘটনা। সিনিয়র-জুনিয়র বা নারীঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটছে হত্যাকাণ্ড। শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে এমন কিশোর গ্যাংয়ের নেটওয়ার্ক। পুলিশ সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে দেশে কিশোর অপরাধের ঘটনায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ছিল ২১৭৯ জন। ওই সময়ে কিশোর অপরাধ-সংক্রান্ত ১৪২২টি মামলার চার্জশিট দেয়া হয়। এতে মোট আসামির সংখ্যা ১৮৬৭ জন। ২০১৫ সালে কিশোর অপরাধ-সংক্রান্ত ১১৮৪টি মামলায় আসামি ছিল ১ হাজার ৭১৯ জন। ২০১৪ সালে মামলা হয়েছে ৮১৮টি, আসামির সংখ্যা ১২৬৩। সূত্রমতে, গত ২৭ মার্চ রাজধানীর দক্ষিণখান চালাবন হাজীপাড়ায় ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী সোহেল খুনের পিছনে কিশোর গ্যাং জড়িত। রাজধানীর উত্তরায় ২০১৭ সালে নাইন স্টার ও ডিস্কো বয়েজ নামের দুটি কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে ট্রাস্ট স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীর খুন হয়। এর এক বছর ১০ দিন পর ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শহরের জামালখানে খুন হয় আরেক আদনান। আদনান খুনের এক বছর চার মাসের মাথায় কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় লোকমান হোসেন রনি। ২০১৪ সালে ২৮ এপ্রিল রাজধানীর নাখালপাড়ায় ‘ডিসকো বয়েজ গ্যাংয়ের’ প্রধান সুমনের হাতে খুন হন নওরিন নামের এক তরুণী। চলতি বছরের গত ১৫ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কার্জন হলের পাশে আরিফ হোসেন নামে এক কিশোর খুন হয়। এই খুনের পেছনে ছিল ‘মাফিয়া গ্যাং’ নামের চার কিশোর। এর আট দিন পর রাজধানীর চানখাঁরপুলে আরেক কিশোর গ্যাংয়ের হাতে সিজান নামের এক কিশোর খুন হয়। সম্প্রতি কেরানীগঞ্জ ও সাভারে তিন কিশোর রিকশাচালকের হাতে খুন হয় দুই রিকশাচালক। বরগুনায় স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে নয়ন বন্ডের ‘০০৭ গ্যাং’ খুন করার পর কিশোর গ্যাং নিয়ে নতুন করে ভাবছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিশোর গ্যাংয়ের হাতে সবকটি খুনের ঘটনায় ধারালো অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। ঢাকার গেন্ডারিয়ায় গত ৬ জুলাই ছুরিকাঘাতে আহত শাওন (১৮) রবিবার মারা গেছে। এ ঘটনায় দুদু নামে অন্য একজনও আহত হয়। বান্ধবীর সঙ্গে ছবি তোলার জেরে দুই গ্যাং গ্রুপের দ্বন্দ্বে গত ৭ জুলাই টঙ্গী পূর্ব থানা এলাকায় শুভ আহমেদ (১৬) নামে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ১১ জুলাই বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চারজন কিশোরকে আটক করে র‌্যাব-১। আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে টঙ্গীতে গ্যাং কালচারের চিত্র উঠে আসে। আটকরা হলেন মৃদুল হাসান পাপ্পু ওরফে পাপ্পু খান (১৭), সাব্বির আহমেদ (১৬), রাব্বু হোসেন রিয়াদ (১৬) ও নূর মোহাম্মদ রনি (১৬)। আটক সাব্বির হাজি সাইদ ল্যাব স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এছাড়া ভিকটিম শুভ ও আটক বাকি তিনজন ফিউচার ম্যাপ স্কুলের ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। একই ক্লাসের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও শুভ ও আটক চারজন আলাদা দুটি গ্যাং গ্রুপের সদস্য। এ ঘটনায় র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ঘটনার আগের দিন ভিকটিম শুভ ও পাপ্পু, রাব্বু, রনি স্কুলের শিক্ষাসফরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় গ্রন্থাগার ও জাতীয় জাদুঘরে যায়। শিক্ষাসফর শেষে ফেরার পথে পাপ্পু ও তার বান্ধবী একই সিটে বসে। এ সময় শুভ মোবাইলে তাদের ছবি তুলে অন্য সবাইকে দেখিয়ে ঠাট্টা করতে থাকে। ছবি তোলায় পাপ্পু ক্ষুব্ধ হয় এবং একপর্যায়ে শুভর সঙ্গে তার হাতাহাতি হয়। নিজের গ্রুপের সদস্যকে নিয়ে ঠাট্টা করার প্রতিশোধ নিতে পরিকল্পনা করতে থাকে পাপ্পুর গ্রুপের সদস্যরা। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন রাত ১০টার দিকে কৌশলে শুভকে নির্জন স্থানে ডেকে নিয়ে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে সাব্বির ও রাব্বুর কাছে থাকা সুইচ গিয়ার ছুরি দিয়ে শুভর বুকে ও পিঠে উপর্যুপরি আঘাত করে। রনি সাব্বিরের কাছ থেকে ছুরি নিয়ে শুভর মাথায় আঘাত করে পালিয়ে যায়। এরপর খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে শুভর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৫ জুলাই সোমবার রাজধানীর তুরাগ এলাকা থেকে র‌্যাব-১ সদস্যরা ‘নিউ নাইন স্টার’ নামে এক কিশোর গ্রুপের ১১ সদস্যকে অস্ত্র, গুলি, চাইনিজ কুড়াল, চাকুসহ আটক করেছে। তাদের বিরুদ্ধে র‌্যাগিং, মাদক সেবন, উচ্চশব্দে মোটরসাইকেল চালানো, ইভটিজিংসহ এন্তার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে রয়েছে ১৫ কিশোর গ্রুপ। গত এপ্রিলে বাকলিয়া এলাকায় ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সেখানে দুজন খুন হয়। কুমিল্লায় রয়েছে ১০টি কিশোর গ্যাং। কক্সবাজার, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, সাভারে রয়েছে একাধিক কিশোর গ্যাং। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমোনলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, নব্বইয়ের দশকে যখন জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় ছিল, তখন এলাকায় এলাকায় চায়নিজ কুড়াল দিয়ে মানুষকে কুপিয়ে ফেলে রাখার ঘটনা দেখেছি। এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রামের মারামারির সহিংসতা দেখেছি। তবে যেহেতু সময় পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে, তাই সেসব জায়গায় কিছুটা সামাজিকীকরণ হয়েছে। পাশাপাশি কিছু জায়গায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এগুলো নতুনভাবে আবিভর্‚ত হয়েছে। এগুলো পর্নোগ্রাফি, ফেসবুক ও অনলাইনে সারাক্ষণ কাটানোর জের। এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, এখন আমরা মডার্নাইজেশনের দিকে যাচ্ছি। আর এর ফলে অনেক নেতিবাচক ‘গ্লোবাল এলিমেন্ট’ ঢুকছে। যা প্রচণ্ড অস্থিরতা তৈরি করেছে। এটিকে আমরা বলছি ট্রানজিশনাল কেস। না ঘরকা, না ঘাটকা। আমরা না উন্নত বিশ্বের দিকে যেতে পেরেছি, না ট্র্যাডিশনাল সোসাইটির মধ্যে আছি। কাজেই এই সময়টা আমাদের জন্য ক্রান্তিকাল। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, অতীতের অপরাধের বিচার না হওয়া, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রু টি ও পরিবারের ব্যর্থতার কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি, অপরাধ করলে বিচার ও সংশোধনের সুযোগ এবং অভিভাবকরা সচেতন হলে সংকট কেটে যেতে পারে। র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, কিশোর গ্যাংয়ের প্রতিটি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পরিবারের উদাসীনতায় তারা কোনো না কোনোভাবে বখে গেছে এবং কোনো না কোনো ধরনের মাদকাসক্ত। গ্যাং কালচারে শিক্ষিত এবং অল্পশিক্ষিত দুই শ্রেণির কিশোর আসক্ত। তাদের ভেতর নিজেদের জাহির করার একটা প্রবণতা কাজ করে। কিশোর গ্যাং প্রসঙ্গে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার বলেন, কিশোররা যাতে কোনো ধরনের অপরাধে জড়াতে না পারে র‌্যাব সবসময় সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে। কিশোর গ্যাং তৈরি ঠেকাতে সবকটি ইউনিট কাজ করছে। র‌্যাব-১ অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, এসব গ্যাং কালচারগুলো সাধারণত এলাকায় নিজেদের প্রভাব জাহির করতে চায়। এর আগেও এসব গ্রুপের মধ্যে প্রায়ই মারামারির ঘটনা ঘটেছে, তবে মামলা হয়নি। কিশোরদের মধ্যে খুন করার প্রবণতার কারণ সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতা। এছাড়া, মাদকের একটা প্রভাব আছে বলে মনে করছেন তিনি। সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশ্লেষণ করে শুধু টঙ্গি এলাকায় ৫-৬টি গ্রুপ সক্রিয়ে রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। আমরা এসব গ্যাং কালচার গ্রুপের মূলে যাব। আগামী ৫-১০ বছর পর্যন্ত ওই এলাকায় আর গ্যাং কালচার থাকবে না। গ্যাং কালচার সমূলে উৎপাটনের চেষ্টা করছি। কিশোরদের এসব গ্যাং গ্রুপে জড়িয়ে যাওয়া এড়াতে সন্তানদের ফলোআপে রাখতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহাবুব আলম বলেন, একাধিক ঘটনা বিশ্লেষণের পর কিশোর গ্যাং তৈরি এবং বিস্তৃতি ঠেকাতে ডিএমপির সব থানা এবং ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App