×

মুক্তচিন্তা

এরশাদ : ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০১৯, ০৯:২৭ পিএম

ব্যক্তিগতভাবে এরশাদ ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক ও উদার মনের শাসক। অস্বীকার করা যাবে না গদিচ্যুত হওয়ার পরপরই রংপুরের সব ক’টা আসন থেকে বিপুল ভোটে জেতা এরশাদ নির্বাচনে হারেননি কোনোদিন। তার দল থাকবে কি থাকবে না রওশন এরশাদ, জি এম কাদের কে হবেন আগামী নেতা এসব নিয়ে যাই বলি না কেন পার্টি না থাকলেও এরশাদ থেকে যাবেন।

রবীন্দ্রনাথের গানে চরম সব সত্য থাকে। তার একটি গানে আছে, ‘মরণ বলে আমি তোমার জীবন তরী বাই।’ জন্মানোর পর আপনি কি ডাক্তার হবেন, না ইঞ্জিনিয়ার হবেন, না সেনাশাসক হবেন কেউ বলতে পারে না। কিন্তু একটা কথা সবাই জানে জন্মালে মরিতে হয়। রবিবার সেনাশাসক, জাতীয় পার্টির নেতা, ক্যারিশমেটিক সবচেয়ে বিতর্কিত নিন্দিত ও আলোচিত সরকারপ্রধান এরশাদ মারা গেলেন। তিনি যে মারা যাচ্ছেন এটা মোটামুটি সবাই জেনে গেছিল। কিন্তু কবে বা কখন তা নিয়ে ছিল জল্পনা-কল্পনা। একটা কথা সবাই স্বীকার করেন এমন আন প্রেডিক্টেবল লিডার বা এমন রহস্যজনক চরিত্র দেশের রাজনীতির ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি। তার মৃত্যুর আগেও গুজব ছিল তিনি নাকি শুক্রবারে মরতে চেয়েছিলেন। ধর্মীয় বার হিসেবে এর গুরুত্ব আছে বলে হয়তো। তখন শোনা গেছিল সেদিনই তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হবে। আবার শুনলাম সেদিন বাংলাদেশের খেলা বলে তা না কি করা হয়নি। তবে কয়েকদিনের মধ্যে যে হবে বা হতে যাচ্ছে সেটা জানত সবাই। রবিবার সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সাধারণত আমরা পরলোকে পাড়ি দেয়া মানুষদের নিয়ে কোনো কথা বলি না। মানে কোনো কটু কথা বা সমালোচনা করি না। কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের বেলায় প্রযোজ্য হলেও কিছু কিছু মানুষের বেলায় তা খাটে না। তা মানা সম্ভবও না। ইনি তেমন একজন শাসক। আমাদের সোনালি যৌবন কেড়ে নেয়া স্বৈরাচার। মনে আছে তাকে হটানোর আন্দোলন কতটা বেগবান ছিল। আর তার বাহিনীর অত্যাচার ছিল কতটা নির্মম। দেশের এখন মৃতপ্রায় সংস্কৃতি আর শিল্পজগৎ চাঙ্গা রেখেছিলেন এরশাদ। কবিতা, গান, নাটক আর লেখায় তাকে তুলোধুনো করে কী শান্তি ছিল তখন। আমার বয়স তিরিশও পেরোয়নি। সে সময় চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে জমজমাট এক কবিতা আসরে এরশাদ ও তার হঠাৎ পাওয়া পুত্রকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলাম। ধারণা ছিল না সেটি এমন প্রিয়তা পাবে। ব্যস কয়েকদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল। এটা তো কোনো ঘটনাই না। পার্বত্য জনপদের এক স্কুল টিচার লিখেছিলেন ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা’ নামের এক নিরীহ কবিতা। কেমন করে জানি সেটা হয়ে গেল তার। আর সেটা বহাল রাখতে গিয়ে ওই মাস্টারকে দেশছাড়া করেছিল বাহিনী। ভাগ্যিস জানে বেঁচে গিয়েছিলেন মাস্টার। তার নয় বছরের শাসনকালে পজেটিভ কিছু ছিল না- এমন না। যেমন উপজেলার অবকাঠামোর উন্নয়ন। তিনি তোষামোদী আর স্তাবকতার ভেতর ডুবে থাকতে ভালোবাসতেন। আজ যারা ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগ তাদের বেশিরভাগই সেদিন ঘি মাখন নিয়ে তার পদসেবায় ব্যস্ত ছিল। ঢাকায় বন্যা হওয়ার পর এরশাদ জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন আর পয়দা হয়ে গেল এক গান। ‘তোমাদের কাছে আসার চেষ্টা আমার’ এমন এক গান চলত রাতদিন। মনে হতো কোনো এক ত্রাণকর্তা নাজেল হয়েছে দেশে। রুমানিয়ার পতিত কমিউনিস্ট নেতা চসেস্কু গদিচ্যুত হওয়ার ক’দিন আগে এসেছিল ঢাকা। এটা বললাম এই কারণে যে দেশে যত শয়তান একনায়ক আর স্বৈরাচারী সব ছিল তার দোস্ত। ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস তিনি তার আগের সেনাশাসক জেনারেল জিয়ার চাইতে উত্তম। এ কারণে যে ব্যক্তিগতভাবে এরশাদ ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক ও উদার মনের শাসক। নিজে লিখুন আর ফজল শাহাবুদ্দীনের মতো কবি লিখে দিক, কবিতা ভালোবাসতেন। বঙ্গভবনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তোড়েও কবিতার আসর বসাতেন। সে কারণে তার অতিথি হয়ে এসেছিলেন সমরেশ মজুমদার। বুদ্ধদেব গুহ ছিলেন তার প্রিয় লেখক। কিন্তু ওই যে স্বভাব। খাইয়ে-দাইয়ে আর উল্টা-পাল্টা ভিডিও দেখিয়ে সমরেশ মজুমদারকে লিখালেন আজগুবি কাহিনী। যাতে নাকি স্পষ্ট প্রমাণিত, এরশাদ নূর হোসেন হত্যার ব্যাপারে দায়ী ছিলেন না। কতটা সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে তিনি এসব পারতেন। পারতেন আরো অনেক কিছু। আমি তখন চন্দ্রঘোনায় কাজ করতাম। এরশাদ আসবেন বলে হৈ হৈ রব। এলেন, এসে চলেও গেলেন। যাওয়ার পর রটে গেল সেখানকার এক সামান্য দারোয়ান নাকি তার কাণ্ড দেখে মূর্ছা গিয়েছিলেন। কারণ? তখন ছিল রোজার মাস। এরশাদ সেদিন রোজা ছিলেন না। তাকে ডাব কেটে পেঁপে কেটে খাওয়ানো দারোয়ান ভদ্রলোক সভায় গিয়ে শুনলেন তিনি কসম করে বলছেন আজ তিনি উপোস ছিলেন। এমন ঘটনা একটা না। বৃষ্টিহীন খরার সময় আবহাওয়া দপ্তরের আগাম বার্তা সম্বল করে তিনি ঘোষণা দিতেন- প্রার্থনা হবে। যাতে মনে হতে পারে তার প্রার্থনার কারণে বৃষ্টি নেমে আসত। সবচেয়ে মারাত্মক ছিল দুটি কাজ। নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে হঠাৎ করে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে তিনি দেশ ও জাতিকে আজীবনের জন্য এক গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিয়েছেন। যা থেকে মুক্তির উপায় নেই। তেমনি বিতর্কিত বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তন। এতে বিজ্ঞান যতটা, ততটাই দুরভিসন্ধি। যে কারণে আজকাল রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কারো জন্ম-মৃত্যু দিন উভয় বাংলায় একসঙ্গে পালিত হতে পারে না। এরশাদ আমাদের জাতীয় জীবনের আরো একটি মারাত্মক বিপদ টেনে এনেছিলেন। শেষদিকে যখন দেখলেন পরিণাম ভয়াবহ তখন পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা লাগিয়ে দিলেন। সে দাঙ্গাই বাংলাদেশের এখন অবধি একমাত্র দাঙ্গা। আশ্চর্যজনকভাবে এমন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে তিনি গিয়েছিলেন নোয়াখালী গান্ধী আশ্রমে। চরম স্ট্যান্টবাজ এরশাদ ছিলেন রমনী মোহন। এ জায়গাটায় তাকে স্যালুট করতেই হবে। এত নারী তার জন্য কেন পাগল হয়েছিল? তিনি চাইলেই তারা রাজি হবে এটা ঠিক মানা যায় না। বরং তার কথাই সত্য মনে হয় যে তারাই তার কাছে আসত। তিনি যেতেন না। জীবনভর নানা নাটকে নিজেকে লাইম লাইটে রাখতে পারাটা কম কিছু না। আমাদের দেশে বেশকিছু রসিক ভাঁড় নেতা আছেন। এরশাদ এদের নিয়ে খেলেছেন আজীবন। কাজী জাফর থেকে মওদুদ আহমদ বা শাহ মোয়াজ্জেম থেকে আ স ম রব সবাই ছিল তার খেলার পুতুল। সে পুতুলগুলোর কেউ কেউ এখনো পাপেট। এরশাদের আরেকটা দিক ছিল চমক দেয়া। এই সেদিনও নির্বাচনে যাবেন কি যাবেন না নিজে দাঁড়াবেন কি দাঁড়াবেন না এসব বিষয়ে এমন চমক দিতেন যে জাতির পিলে চমকে যেত। বিশেষ করে তার মিত্র বা দুশমন কেউই বুঝত না কী করতে চলেছে জাতীয় পার্টি। নিজেকে হাস্যকর করে হলেও তিনি এসব বজায় রাখতেন। এই বাড়িতে তো এই হাসপাতালে আবার এই কেবিনে তো এই গলফ কোর্সে। এমন চটকদার যে আওয়ামী লীগের নির্ঘুম রাতের সময় ঘোষণা দিলেন মতিঝিলে আসা হেফাজতীদের তার দল পানি সরবরাহ করবে। বড় জটিল আর বড় রহস্যময়। করলেন পাকিস্তানপন্থিদের উপকার আর সারাজীবন শুনলাম তিনি নাকি ছিলেন ইন্ডিয়ান লবিংয়ের লোক। একটা কথা মনে পড়ছে। আমি যেদিন অভিবাসন নিয়ে সিডনি আসি সেদিন দুপুরের খবরে দেখলাম তিনি জেলখানা থেকে বেরিয়ে সংসদে ভাষণ দিচ্ছিলেন। বারবার বলছিলেন জোর দিয়ে বলছিলেন কারো সাধ্য নেই তাকে ফাঁসি দেয়। কারো সাধ্য নেই তার বাহিনী বেঁচে থাকতে তাকে আবার জেলে পোরে। কথাটা কিন্তু সত্য করে দেখিয়েছেন তিনি। উল্টো বেগম জিয়া জেলে যাওয়ার পর বলেছিলেন তিনি যে গাছ পুঁতে এসেছেন তার ফল খেতে। অস্বীকার করা যাবে না গদিচ্যুত হওয়ার পরপরই রংপুরের সব ক’টা আসন থেকে বিপুল ভোটে জেতা এরশাদ নির্বাচনে হারেননি কোনোদিন। তার দল থাকবে কি থাকবে না রওশন এরশাদ, জি এম কাদের কে হবেন আগামী নেতা এসব নিয়ে যাই বলি না কেন পার্টি না থাকলেও এরশাদ থেকে যাবেন। নিন্দিত এরশাদও থাকবেন ইতিহাসে। তার মা জননী ছেলের নাম শুনে ভড়কে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কে? তিনি জানতেন তার এই পুত্র পেয়ারার নাম এরশাদ হুসেইন। এভাবেই নিজেকে একাধারে বিতর্কিত আবার নিজের ক্যারিশমায় উজ্জ্বল ও নিন্দিত এরশাদ চিরবিদায় নিয়েছেন। গুড বাই জেনারেল।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App