×

জাতীয়

এরশাদের শাসন আমল এক কালো অধ্যায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০১৯, ১১:৪৯ এএম

এরশাদের শাসন আমল এক কালো অধ্যায়
বিখ্যাত পটুয়া কামরুল হাসান তুলিতে তাকে চিত্রিত করেছেন ‘বিশ্ব বেহায়া’ হিসেবে। দেশে ‘স্বৈরাচারী’ তকমাটিও কেবল সেঁটে আছে তার নামের সঙ্গেই। জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল, জাফর, দীপালি সাহা, রমিজ, তিতাস, মুনীর, নূর হোসেন, রাউফুন বসুনিয়া, ডা. মিলনসহ অসংখ্য তরুণের রক্ত লেগে আছে তার হাতে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা, রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেয়া, বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বৈধতা দান সবই জায়েজ করেছেন। তিনি ‘বিতর্কের বরপুত্র’ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। গতকাল স্বাভাবিক মৃত্যুর মাধ্যমে অবসান হলো এক স্বৈরশাসকের। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের নায়কদের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবেই আছে এরশাদের স্বৈরশাসন। রক্তের রাজনীতি যেন আর কখনোই ছায়া ফেলতে না পারে এমনটাই চান তারা। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের রাজনীতিবিদদের মতে, রক্তপথেই এরশাদের উত্থান। এক জেনারেলের পতনের মধ্য দিয়ে আরেক জেনারেলের ক্ষমতা দখল। জিয়া হত্যার পর এরশাদের ভূমিকা নিয়ে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। আর্থিক কেলেঙ্কারি, নারী কেলেঙ্কারি, রাজনীতিতে একের পর এক ‘ডিগবাজি’র পরও নিজের সমর্থকদের কাছে ‘নায়ক’ ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন এরশাদ। তার ভাষ্য, তিনি বন্দি হিসেবে সেখানে ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে তার ভ‚মিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই। গণআন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের পর বিভিন্ন অভিযোগে ৪৩টি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এর তিনটিতে নিম্ন আদালতে তার সাজার আদেশ হলেও হাইকোর্টে একটিতে খালাস পান। বাকি দুই মামলায় তিনি সাজা খাটা শেষ করেন। ৩৮ বছর আগে মেজর মঞ্জুর হত্যা মামলা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার গলার কাঁটা হয়েই ছিল। ডা. মিলনের রক্তেই ঘণ্টি বাজে এরশাদ পতনের। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ডা. শামসুল আলম খান মিলনের সঙ্গে একই রিকশায় ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএম) তৎকালীন মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার রিকশাটা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় উপস্থিত হয়েছে তখন মিলন আরেকটি রিকশায় করে আমাকে ক্রস করে সামনে চলে যাচ্ছিল। তখন আমি মিলনকে বললাম, তুমি ওই রিকশা ছেড়ে আমার রিকশায় আসো। এরপর মিলন আমার রিকশায় এসে ডানদিকে বসল। রিকশাওয়ালা ঠিকমতো একটা প্যাডেলও দিতে পারেনি, মনে হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিক থেকে গুলি আসল। গুলিটা মিলনের বুকের পাশে লাগে। তখন মিলন বলল, জালাল ভাই কী হইছে দেখেন। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সে আমার কোলে ঢলে পড়ে। ডা. মিলন ও ছাত্রনেতা নাজির উদ্দিন জেহাদ নিহত হওয়ার পর এরশাদবিরোধী আন্দোলন আরো তুঙ্গে ওঠে। তুমুল আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। তিন জোটের আস্থাভাজন ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন। এ ব্যাপারে জাসদ সাধারণ সম্পাদক ও নব্বইয়ে আন্দোলনের নেত্রী শিরিন আখতার ভোরের কাগজকে বলেন, এরশাদের শাসন আমল দেশের কালো ইতিহাস। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে ওঠে ছাত্ররাই। ১৯৮২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে মজিদ খানের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিলের বিরোধিতা করে ছাত্রসংগঠনগুলো। ওই বছরের নভেম্বরে সব ছাত্র সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ ফোরাম ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। ক্যাম্পাসে ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নামলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল, জাফর ও দীপালি সাহা। এ রক্তের ধারা গড়ায় অনেক দূর। মিশে যায় রাউফুন বসুনিয়া, রমিজ, তিতাস, মুনীর, জুয়েল, ডা. মিলনের রক্তে। তিনি বলেন, ১৯৮৭ সালে মিছিলে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন নিহত হওয়ার ঘটনা আন্দোলনে গতি এনে দেয়। ক্ষমতার শেষের দিকে আবারো সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এরশাদ। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছিল দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল। বর্তমানের প্রধান দুই প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক ঐক্য কেবল এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ই দেশবাসী দেখেছে। এরপর আর কোনো জাতীয় ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঐক্য সম্ভব হয়নি। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নেও নয়। এ ব্যাপারে ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বর্তমানে গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, ক্ষমতায় এসেই সামরিক শাসন জারি করল এরশাদ। গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরেছিল। কণ্ঠরোধ করেছে গণমাধ্যমের। আমরা ছাত্ররাই প্রথম তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেছিলাম। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। তিনি বলেন, তার অতীত নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। মানুষ মরণশীল। তিনি আজ নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সাবেক ভিপি ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ওই সময়ে আমাদেরই সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন-নির্যাতনের সহ্য করতে হয়েছিল। সে সময়ের দিনগুলো স্মরণ করলে এখন শিহরিত হয়ে ওঠি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App