×

মুক্তচিন্তা

দীক্ষাগুরুর বিদায় চাই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০১৯, ০৯:৪৭ পিএম

শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেদের গৃহে আনন্দ নেই, আনন্দ নেই বিদ্যালয়েও। ওদিকে ছুটির ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই তাদের ছুটতে হয় কোচিং সেন্টারে। গত ২৭ বছর পর যে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে- এই ঘটনা সাক্ষ্য দেয় এর মূলে কেবল কর্তাদের উদাসীনতা নয়, এও একটা রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ বটে। জ্ঞান গ্রহণে ছাত্রদের সক্ষমতাকে খর্ব করা, তাদের জ্ঞানী হতে না দেয়ার পুঁজিবাদী নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এটি একটি কর্মপন্থা বটে।

শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষার কথাটাও আসে, ‘শিক্ষাদীক্ষা’ প্রায়শ একই সঙ্গে চলাফেরা করে। এই যোগাযোগটা কিন্তু অকারণে ঘটেনি; শিক্ষা ও দীক্ষা একই সঙ্গে থাকে, তা যতই আমরা না দেখার চেষ্টা করি না কেন। আসলে দীক্ষাই শিক্ষাকে পরিচালনা করে থাকে; ভেতর থেকে এবং অনেকটা অদৃশ্য পন্থায়। শিক্ষার পক্ষে ওই পরিচালনা না মেনে উপায় নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক গলদ, ফাঁক, ফাঁকি ইত্যাদি রয়েছে। সে নিয়ে কথাবার্তা হয়, হওয়া খুবই প্রয়োজন। কিন্তু যে অন্তর্যামী অনালোচিত থেকে যায় সে হলো দীক্ষাগুরু, নাম যার পুঁজিবাদ। ওই গুরুকে বিদায় না করতে পারলে ত্রুটিগুলো শুধরানো অসম্ভব। শুধরানো অসম্ভব যে সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। সংস্কারের উদ্যোগ তো কম নেয়া হয়নি, হামেশাই নেয়া হচ্ছে। একের পর এক কমিটি, কমিশন আসছে-যাচ্ছে, সুচিন্তিত নানা ধরনের সুপারিশ পাওয়া যাচ্ছে, আরো পাওয়া যাবে, থামবে না। কিন্তু যতই যা করা হোক শিক্ষা ব্যবস্থাটা মোটেই সবল হচ্ছে না, উল্টো ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে। এর কারণ দীক্ষাগুরুর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। অব্যাহত রয়েছে বললে সবটা বলা হবে না, তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রবল হচ্ছে। আর ওই প্রবলতাই হচ্ছে মূল কারণ, যে জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাটা বিপদগ্রস্ত হতে হতে এখন প্রায় ধ্বংসের প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। পুঁজিবাদের নিয়ম এই যে, অন্য সবকিছুকে হটিয়ে দিয়ে সে মুনাফা খুঁজবে এবং যত মুনাফা পাবে ততই মুনাফালোভী হয়ে উঠবে। মুনাফার উন্নতিকেই প্রচার করতে থাকবে দেশের ও দশের উন্নতি বলে। যদিও উন্নতিটা দেশের নয়, ব্যক্তির; দশের নয় একের। আমাদের দেশে শিক্ষার স্বীকৃত উদ্দেশ্যটা কী? এ প্রশ্নের জবাবে নানা কথা বলা যায় এবং বলা হয়, কিন্তু মূল উদ্দেশ্যটা যে মুনাফা-গুরুগম্ভীর আলোচনাতে সেই সত্য কথাটা বেরিয়ে আসে না; যদিও লোককথায় সেটা বহুকাল ধরে স্বীকৃত হয়ে আছে। লোককথায় পরিষ্কারভাবেই বলা আছে যে, লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া। আমি লেখাপড়া শিখব, কারণ না শিখলে আমার গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া হবে না। গাড়িতে নিজে চড়ে অন্যদের চাকার তলায় চেপে মারব, এই কথাটা অবশ্য বলা হয় না, তবে সেটা না বললেও চলে, কেননা কে না জানে যে কান টানলে মাথাও আসবে। একজনই যদি শুধু ওঠে, তবে নয়জন অবশ্যই নামবে। নিজের উন্নতির এই আগ্রহটাই শিক্ষার পেছনের আসল কথা, তা যে আচ্ছাদনেই তাকে উপস্থিত করা হোক না কেন। দীক্ষাগুরুই প্রধান শিক্ষক। আর এই শিক্ষকের প্রধান শিক্ষা হচ্ছে ধনী হও, বড় হও। এটা সে ঘরে শেখায়, বাইরে শেখায়। শিক্ষার বেলাতেও ওই শিক্ষার কোনো ব্যতিক্রম ঘটে না। ব্যতিক্রম ঘটা সম্ভবও নয়। তাই তো দেখা যায় শিক্ষা নয়, শিক্ষার ছাপই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। ছাপটা থাকে পরীক্ষার রেজাল্ট। পরীক্ষায় কে কেমন রেজাল্ট করল, কতটা উজ্জ্বল হলো, স্বর্ণের মতো নাকি তারকার, সেটাই হয়ে পড়ে জ্ঞান নিরূপণের মানদণ্ড। শিক্ষা পেছনে পড়ে থাকে, ছোটাছুটি চলে পরীক্ষাগৃহে। চলতে থাকে মুখস্থ করা, নকল করা, ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ক্রয় করার মতো কাজগুলো। অভিভাবকরা লজ্জা পায় না ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র কিনতে। সবকিছুর পেছনে প্রণোদনা ওই একটিই, পরীক্ষায় ভালো করা। ক্লাসরুমে যে শিক্ষা নেই, শিক্ষা সে যে চলে গেছে কোচিং সেন্টার, গাইড বুক, প্রাইভেট টিউশন ইত্যাদির নির্ভরযোগ্য জায়গাতে তার কারণও ওই একটাই; পরীক্ষায় ভালো ফল করার অস্থির আকাক্সক্ষা। চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো অতি জরুরি প্রয়োজনগুলো মেটানোর দায়িত্ব নেয়ার কথা রাষ্ট্রের। আমাদের দেশে এক সময়ে রাষ্ট্র ছিল ঔপনিবেশিক; চিকিৎসা ও শিক্ষার দায়িত্ব সে রাষ্ট্রের নেয়ার কথা ছিল না, কিন্তু তবুও তাদের শাসন-শোষণ ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই দায়িত্ব কিছুটা নিত। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যেত; সরকারি স্কুলে বেতন ছিল যৎসামান্য, স্কুলের শিক্ষকরা হতেন দক্ষ। এখন স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীলতা কমতে কমতে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। স্কুলে বিনা বেতনে মেয়েদের শিক্ষা, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে বটে, কিন্তু পরীক্ষা পাসের জন্য ক্লাসরুমের শিক্ষার ওপর নির্ভর করার ইতিহাস বিলুপ্তির পথে, ভরসা এখন প্রাইভেট ব্যবস্থা। চিকিৎসা যেমন কেনাবেচার সামগ্রী হয়ে গেছে, শিক্ষারও সেই একই দশা। কিনতে হয়, নইলে পাওয়া যায় না। শিক্ষা ও চিকিৎসার অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্র দুটির দিকে তাকালেই বুঝতে পারা যায় উন্নতিটা কোন ধারায় ঘটছে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বিদায় নিয়েছে, এসেছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রকে দেশের সব মানুষ মিলে, যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এই রাষ্ট্র পুঁজিবাদী, যার অর্থ এটি দশজনের নয়, একজনের। এটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রেরই ‘উন্নত’ সংস্করণ মাত্র। এটি আরো বেশি পুঁজিবাদী, আরো বেশি নিপীড়নকারী। পুঁজিবাদী দীক্ষাগুরুর অমোঘ নির্দেশে পরিচালিত এই রাষ্ট্র তাই আরো উন্নতির বিজ্ঞাপন প্রচার করে। চক্ষু তার উপরমুখো, তাই সে দেখতে পায় না যে উন্নতির যাঁতাকলে পড়ে সৃষ্টিশীলতা কাবু হয়েছে এবং দশজনের মধ্যে নয়জনই শিকার হচ্ছে নিষ্ঠুর বঞ্চনার। পুঁজিবাদের এই জঙ্গলে সে-ই টিকবে যার টাকা আছে এবং এখানে টাকা শ্রমজীবীর হাতে থাকবে না, থাকবে পরশ্রমজীবীদের হাতে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভোগবিলাস সবকিছুই পরশ্রমজীবীদের করতলগত। শ্রমজীবী শ্রম করবে, করতেই থাকবে। উন্নতি যা ঘটবে সেটা তাদেরই শ্রমে, কিন্তু তারা ফল পাবে না, পাবে কেবল দুর্ভোগ। উন্নতির পথ লুণ্ঠন ও দুর্নীতিতে আকীর্ণ। আমাদের এই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরীক্ষার ব্যাপারে শাসকশ্রেণির ভীষণ উৎসাহ। কারণ জ্ঞানের প্রকৃত চর্চা তারা চায় না। ব্রিটিশ শাসকরা চায়নি, পাকিস্তানি শাসকরা চায়নি, বাঙালি শাসকরাও চায় না। জ্ঞানকে তারা খুবই ভয় করে। তাদের আশঙ্কা জ্ঞানের চর্চা হলে লোকে তাদের চিনে ফেলবে, মানবে না এবং বিদ্যমান ব্যবস্থাটাকে ভেঙে ফেলতে চাইবে। তাই বিদ্যাবুদ্ধির ততটুকু চর্চাই যথেষ্ট মনে করে যতটুকু চর্চা ব্যবস্থাটাকে চালু রাখার এবং ব্যবস্থার সুবিধাভোগী শাসকদের সেবা করার জন্য অত্যাবশ্যক; তার বাইরে নয়। তারা চায় লোকে শিক্ষা ভুলে পরীক্ষা নিয়ে মত্ত থাকুক এবং পরীক্ষায় কী করে ভালো ফল করা যায় তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বিদ্যাবুদ্ধি অর্জনের কথা ভুলে যাক। বর্তমান সরকার আবার এক কাঠি সরেস। কিছুদিন আগ পর্যন্ত তারা ভাবত ভালো নম্বরের ছড়াছড়ি ঘটিয়ে দেখিয়ে দেবে যে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে গেছে। কিন্তু একটা অসুবিধা দেখা দিয়েছে। এখন এটা প্রকাশ্য হয়ে গেছে যে, পরীক্ষায় ভালো গ্রেড পেয়ে যারা বের হচ্ছে তারা ভেতরে মোটামুটি অন্তঃসারশূন্য। ফলে ভালো ফল করার স্রোতে কিছুটা ভাটার টান পড়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত রাখার ইচ্ছায় কোনো ঘাটতি নেই। সেই অভিপ্রায় থেকে বর্তমান সরকার একটি পাবলিক পরীক্ষার জায়গায় আরো দুটি পরীক্ষা যোগ করেছে এবং শিক্ষার ব্যাপারে অভিজ্ঞরা যদিও বলছেন যে, এতে শিক্ষার্থীদের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হবে, তবুও সে কথা শুনতে চাইছে না। স্বার্থ সবকিছুই করতে পারে, বধির এবং অন্ধ করাসহ। পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও নানা রকমের উল্টাপাল্টা কাজকর্ম চলে। এমসিকিউ আনা হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে ওটা ভালো নয়। প্রশ্ন ফাঁসে সুবিধা করে দেয়া হয়, মোবাইলে প্রশ্নের উত্তর সরবরাহতেও ভারি সুবিধা ঘটে। ওটা বাদ যাক। তবে সৃজনশীল থাকছে। সৃজনশীল প্রশ্নের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। প্রশ্ন নয় উত্তর যাতে সৃজনশীল হয় চোখ রাখা উচিত ছিল সেদিকে। অথচ করা হয়েছে ঠিক উল্টাটা। প্রশ্ন নিজেই সৃজনশীল হয়ে গেছে। তবে এই সৃজনশীলতা জিনিসটা যে কী সেটা ছাত্র বোঝে না, অভিভাবক বোঝেন না, বোঝেন না শিক্ষকও। শিক্ষকের না বোঝার ব্যাপারটা রীতিমতো ভয়াবহ। প্রশ্নের জন্য তারা ছোটেন গাইড বইয়ের কাছে। ফলে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক উভয়ের গন্তব্য অভিন্ন হয়ে পড়ছে। দুহাতে মুনাফা করছে গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা। কোচিং বাণিজ্য তো আছেই। যত বেশি পরীক্ষা তত বেশি কোচিং বাণিজ্য। সবকিছুই কিন্তু ঘটছে দীক্ষাগুরুর শিক্ষামাফিক। একেবারে নির্ভুলভাবে। বলা হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি ঢুকেছে। তা ব্যবসা-বাণিজ্যের কোন ক্ষেত্রটি আজ দুর্নীতিমুক্ত শুনি? দোষ কি কেবল শিক্ষার? ভালো কথা, জানা যায় সৃজনশীল নাকি এসেছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকায়। বোঝাই যাচ্ছে ওই ব্যাংক আমাদের কত বড় বন্ধু। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরিত্রগত স্বভাবটাই হচ্ছে বৈষম্য তৈরি করা। অল্প ক’জন সুবিধাভোগী থাকবে ওপরে, সুবিধাবঞ্চিত বিপুল বাহিনী নিচে। এই ব্যবস্থা শিক্ষা ক্ষেত্রে তিন ধারা তৈরি করেছে। অর্থনীতিতে ও সামাজিক জীবনে পুঁজিবাদ যতই উন্নত হচ্ছে তিন ধারার গভীরতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপকতা বাড়িয়ে গরিব মানুষকে দারিদ্র্যের বন্ধনে স্থায়ীভাবে আটকে রাখার ষড়যন্ত্রটা খুবই সফল হয়েছে। গরিবের এই বিপদে ধনীদের কোনো ক্ষতি নেই; লাভ আছে ষোল আনা। পাশাপাশি মাধ্যমিক ব্যবস্থাটা যে ভেঙে পড়ার উপক্রম ধনীরা তা নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন নয়, কারণ তাদের সন্তানদের পদধূলি ওই ব্যবস্থার অঙ্গনে পড়ে না। সৌভাগ্যবান ওই সন্তানদের আসা-যাওয়া যে ইংরেজি মাধ্যমে সেখানে কোনো দুর্যোগ নেই- প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় না, ভালো রেজাল্টের অস্বাভাবিক স্ফীতিও ঘটে না। সব কিছু সহিসালামতে চলে। কেবল বেতনই যা বৃদ্ধি পায়। তা তো পাবেই। মাধ্যমিকের দুর্দশা বৃদ্ধি শুধু যে পরীক্ষার মাধ্যমে ঘটানো হচ্ছে তা নয়। পাঠ্যসূচিকেও দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। ধর্মীয় শিক্ষা শিক্ষার্থীর ঘরেই হওয়ার কথা, তাকে নিয়ে আসা হয়েছে বিদ্যালয়ে। অথচ এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ই ঘটেছিল ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার আশা নিয়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেটা এমনকি পাকিস্তান আমলেও ছিল না। ওদিকে কমিয়ে দেয়া হয়েছে ইতিহাসের পাঠ। বাংলাদেশের অভ্যুদয় যে হঠাৎ করে ঘটেনি, তাকে যে আসতে হয়েছে কঠিন সংগ্রামের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এবং এর বাইরেও যে এ দেশের মানুষের সুদীর্ঘ এক ইতিহাস রয়েছে তার সঙ্গে পরিচয় না থাকলে কোনো ব্যক্তিকেই যে শিক্ষিত বলা চলে না, এই সামান্য জ্ঞানটি মনে হয় শিক্ষা পরিকল্পনাকারী জ্ঞানী ব্যক্তিদের নেই। এ ধরনের হস্তীমূর্খদের আর যেখানেই স্থান হোক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় স্থান হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারাই তো শিক্ষার হর্তাকর্তা। সবই গুরুর ইচ্ছায়। গুরু এমনটাই চায়। হেফাজতে ইসলাম নাম দিয়ে যে রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে দেখতে পাচ্ছি তার সবিশেষ লালন-পালন মাদ্রাসাগুলোতে। শিক্ষা সংস্কারকরা বলেন, তারা চেষ্টা করছেন মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার স্তরে টেনে তুলতে; ওদিকে হেফাজতিরা চায় বাংলা মাধ্যমিক শিক্ষাকে মাদ্রাসার স্তরে টেনে নামাতে। টানাটানির এই ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে হেফাজতিদের জোরটাই বেশি। বাংলা পাঠ্যপুস্তকের ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক যে অল্পস্বল্প উপাদান ছিল সেটুকুও তাদের পছন্দ হয়নি। হুঙ্কার দিয়েছে, বাদ দিতে হবে। সেই হুঙ্কারে নত হয়েছে শিক্ষা প্রশাসন; হেফাজতিদের আপত্তির অংশগুলো মেপে মেপে ছেঁটে ফেলে দিয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে, কিন্তু আন্দাজ করা গিয়েছিল যে- যে রচনাগুলো ফেলে দেয়া হয়েছে তা আর ফেরত নেয়া হবে না। নেয়া হয়নি। বেচারা প্রতিবাদকারীদের স্টিম শেষ হয়ে গেছে অল্প পরেই। এটা একটা ঘটনা বটে, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয় আবার প্রতীকও। এটি পরীক্ষার ভারে কাবু মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপারে কর্তাদের উদাসীনতার প্রতীক। আবারো বলতে হয় যে, উদাসীনতার মূল কারণ বাংলা মাধ্যম থেকে বিত্তবান গৃহের সন্তানদের দূরবর্তিতা। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা ধ্বংস হয়ে গেলে ধনীদের কী আসে যায়। তাদের বরং লাভই হওয়ার কথা। প্রতিযোগীর সংখ্যা হ্রাস পাবে। শিক্ষা তো কেবল দিলেই চলে না, শিক্ষার্থীরা তা গ্রহণ করতে পারছে কিনা সেটাও দেখতে হয়। দেখাদেখির এই ব্যাপারেও শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ভীষণ উদাসীন। শিশু শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সব স্তরের শিক্ষাই এখন আনন্দহীন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনন্দ লাভের জন্য প্রয়োজনীয় পরিসরের মারাত্মক অভাব। খোলা জায়গা নেই, খেলার মাঠ নেই; গ্রন্থাগার আছে কি নেই বোঝা যায় না; সাংস্কৃতিক কাজকর্ম প্রায় অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেদের গৃহে আনন্দ নেই, আনন্দ নেই বিদ্যালয়েও। ওদিকে ছুটির ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই তাদের ছুটতে হয় কোচিং সেন্টারে। গত ২৭ বছর পর যে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে- এই ঘটনা সাক্ষ্য দেয় এর মূলে কেবল কর্তাদের উদাসীনতা নয়, এও একটা রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ বটে। জ্ঞান গ্রহণে ছাত্রদের সক্ষমতাকে খর্ব করা, তাদের জ্ঞানী হতে না দেয়ার পুঁজিবাদী নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এটি একটি কর্মপন্থা বটে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App