×

মুক্তচিন্তা

শান্তনু বিশ্বাস : প্রসেনিয়ামের মন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০১৯, ০৮:৩৬ পিএম

পঁয়ষট্টি বছর বয়সের জীবনের চুয়াল্লিশ বছর নাটক করেছেন। তিনি সব সময় সক্রিয় ছিলেন গানে, নাটকে কিংবা লেখালেখিতে। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে থিয়েটারকে অভিজ্ঞতার জাদুমন্ত্রে পরিণত করেছেন। যোগসূত্র করেছেন মানুষ, জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও মঞ্চকে।

প্রসেনিয়াম। চট্টগ্রামের উঁচু প্রসেনিয়াম ছুঁয়ে হেঁটে যাওয়ার মানুষটিকে নিয়ে দুটি কথা বলতে চাইছি। তিনি আজ আর হাঁটবেন না। তার স্মৃতিটুকু মনে সভা করছে। শিল্পকলা থেকে চেরাগি পাহাড় কিংবা থিয়েটার ইনস্টিটিউটের মঞ্চের আবর্তনে যাকে পেয়েছিলাম। তিনি শান্তনু বিশ্বাস। সব সময় হেসে-খেলে একটু উড়ে উড়ে গান করছেন, কবিতা লিখছেন, নাটক করছেন, নাটক লিখছেন। আড্ডা দিচ্ছেন। সাহস দেখিয়ে টিপটপ ভঙ্গিতে দোল দিয়ে যাওয়ার মানুষ তিনি। যেন খেলছেন, কিন্তু পারফর্ম করছেন। বাস্তব যা, মঞ্চও তাই। এমন তীরন্দাজ সহসায় দেখা যায় না। ছুড়ে দিচ্ছেন শব্দ, গতি, ভঙ্গি। দেখছি, শুনছি, মুগ্ধ হচ্ছি। এই শান্তনু বিশ্বাসের মন ছিল একেবারে অন্য রকম, সাগরের ঢেউ বাহিত মানুষ। মনজুড়ে সৃজনের কায়া। নাটক নিয়ে তার বহু ভাবনা। কত রকমই না হেঁটেছেন। স্কুলজীবন থেকে তার আগ্রহ। ১৯৭৫ সালে নাটকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুক্ত হন। ‘গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়’ থেকে শুরু ‘অঙ্গন থিয়েটার ইউনিট’, এরপর নিজের দল ‘কালপুরুষ নাট্য সম্প্রদায়’। অভিনয় দিয়ে শুরু করলেও তিনি নাটক রচনা, নাটকের গান রচনা, আবহ নির্মাণ ও নাট্য নির্দেশনা করেছেন। নাটক বিষয়ে লিখেছেন বেশ কিছু দিন। ‘কালো গোলাপের দেশ’ তার লেখা প্রথম নাটক, তারপর ‘দপ্তরে রাজদপ্তরী’, এই নাটক দুটিতে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। এর আগে নিজেকে সারা দেশে শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন গণায়ন ও অঙ্গনে নিয়মিত অভিনয় করে। ‘নবজন্ম’-এর পরের নাটক, অভিনীত হয়েছে বহুবার। নির্দেশনা ও আবহ রচনার শুরু এই নাটক দিয়ে। ‘ইনফরমার’ মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি ভিন্ন আঙ্গিকের নাটক, যা বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। এই নাটক নানা থিয়েটার দল দ্বারা সারা দেশে অভিনীত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ‘ভবঘুরে’ কলকাতার শূদ্রক নাট্যপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর ‘থিয়েটার আরামবাগ’ ও ‘অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়’ অভিনয়ের আয়োজন করে। মিউজিক্যালের আঙ্গিক মেশানো এই নাটক সমাদৃত হয় বিপুলভাবে দর্শকের কাছে। এটিও বহুল অভিনীত নাটক। সর্বশেষ ‘নির্ভার’ কালপুরুষ নাট্যদল গত ২৮ জুন ২০১৯ জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চস্থ করে। এতে মূল চরিত্রে শান্তনু বিশ্বাস অভিনয় করেন। অবনঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’ বই আকারে বেরিয়েছে। তার লেখা ‘নবজন্ম’, ‘ইনফরমার’, ‘ভবঘুরে’ ও ‘নির্ভার’ এই চারটি নাটক নিয়ে বই হয়। তিনটি বিদেশি নাটকের অনুবাদ নিয়ে খড়িমাটি থেকে বের হয় ‘নাট্যত্রয়ী’। অ্যালেন আইকবোর্নের ‘মাতৃচরিত’, হ্যারল্ড প্রিন্টারের ‘প্রার্থী’ ও এন এফ সিম্পসনের ‘খোলা হাওয়া’। নাটকের মানুষ, গানেরও। গান রচনা করেন, সুর করেন, গেয়ে শুনান সবাইকে। একসময় গানের বাতাসে তিনি নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যান। কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সর্বকনিষ্ঠ শিল্পী তিনি। তার গায়কী ভঙ্গি অনেকের থেকে আলাদা। আধুনিক গানের চিরায়ত দিকটি নিয়ে তিনি বেশ নিরীক্ষা করতেন। তার গান যাপনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। জীবনের ধার করা জমিনের কথা বলছেন, সময়ের কথা বলছেন। খড়িমাটি থেকে প্রকাশিত একমাত্র গানের বই ‘গানের কবিতা খোলাপিঠ’-এর ভূমিকায় নিজের গান সম্পর্কে শান্তনু বিশ্বাস লিখেছিলেন : ‘আমার গানের জমিটা অনেকটা এই রকম; আমি এবং আমার চারপাশের মানুষ, একক ও যৌথ জীবনের চলমান ও ঘটমান যা কিছু, বেঁচে থাকার আগ্রহ ও লড়াই ও তাকে বাঁচিয়ে রাখার তীব্র ইচ্ছে, আমার ও আমাদের অস্তিত্ব, সংকট ও সংকটমোচন, সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, আলোর মত উত্থান ও অন্ধকারের মত পতন, বিরক্তি, ঘৃণা, লজ্জা, সাহস ও ভীরুতা, ছিটেফোঁটা সাফল্য, ভালোবাসা, প্রেম ও প্রেমহীনতা, আমার যাপিত জীবনের যা কিছু অভিজ্ঞান- তার সবটুকু নিয়ে আমার গান। গানের ভেতর সময়টাকে ধরার চেষ্টা। যা আমাকে নাড়ায়, যা আমাকে ভাবায়, যা আমাকে আলোকিত করে, আলোড়িত অনুরণিত করে, যা আমার ভেতর অপার আনন্দ এবং গভীর দুঃখের সঞ্চার করে, সেই অনুভূতি সমষ্টি নিয়ে আমার গান। হাত ধরার অভিপ্রায়ে তাই হাতটা বাড়ানো থাকে সবসময়।’ কবিতা, গান ও নাটকের কাজগুলোকে তিনি নিরীক্ষার মধ্য থেকে এগিয়ে নিতে চেয়েছেন। চেয়েছেন নাটক নিয়ে ভাবনা হোক, গবেষণা হোক। মানুষের নাটক, মানুষের কাছে নিতে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, তিনি তা করেছেন। নাট্যপ্রেমীদের জন্য করেছেন ‘প্রসেনিয়াম’ নাটকের ছোট পত্রিকা। নানা রকম লেখা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের নাট্যচিন্তকদের দিয়ে এক নান্দনিক ভাবনার পত্রিকা করলেন। গত শতকের আশির দশকে নাট্যকর্মীদের কাছে আলোচিত এক পত্রিকা। ৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯৮৯ সালে বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৯ সালে সপ্তম সংখ্যা বের হয়। প্রাণের শহর চট্টগ্রামে তিনি নাটককে বিশ্বমানের ধারণায় পৌঁছাতে চেয়েছেন। কালপুরুষ নামের নাটকের দলটি নিয়ে তার অনেক ভাবনা। তার জীবনসঙ্গী নাট্যঅভিনেত্রী শুভ্রা বিশ্বাস এই কর্মকাণ্ডের প্রধান পরিপালক। শান্তনু বিশ্বাস ১৯৫৪ সালে ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গত ১২ জুলাই ২০১৯ ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। পঁয়ষট্টি বছর বয়সের জীবনের চুয়াল্লিশ বছর নাটক করেছেন। তিনি সব সময় সক্রিয় ছিলেন গানে, নাটকে কিংবা লেখালেখিতে। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে থিয়েটারকে অভিজ্ঞতার জাদুমন্ত্রে পরিণত করেছেন। যোগসূত্র করেছেন মানুষ, জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও মঞ্চকে। তার সব স্বপ্নকে এই প্রসেনিয়ামে ভাসিয়ে দিয়েছেন। মৃদু সুর ভেসে আসছে, সুর শুনতে শুনতে দর্শক তাকিয়ে আছে শান্তনু বিশ্বাসের দিকে, তিনি কী বলছেন কিংবা বলবেন। তার স্বাভাবিক ভঙ্গিই ছিল অভিনয় ভঙ্গি। আলাদা করে তাকে খুঁজতে হয়নি। যেমন কথা বলেন, তেমনই। এই মুগ্ধ হওয়ার সময়টা তিনি এই প্রসেনিয়ামে ব্যয় করেছেন। অভিজ্ঞতার সবটুকু দর্শক, শ্রোতাদের দিতে চেয়েছেন। তিনি হয়তো আমাদের কাছে প্রিয় হয়ে থাকবেন আরো অনেক বিষয়ে। আমরা তো তাকে স্মৃতিতে রাখব একজন পটু আড্ডারু হিসেবে। আড্ডার ছলে তার সৃজনকর্ম হয়ে যেত। কেননা তার ছিল প্রসেনিয়াম মন।

মনিরুল মনির : কবি ও প্রাবন্ধিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App