×

মুক্তচিন্তা

সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিক শিক্ষা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০১৯, ০৮:০১ পিএম

আদিকালে বহু মানুষ তার জৈবিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য নানা ধরনের পৈশাচিক কাজ করত। সভ্যতা এবং কালের বিবর্তনে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। শিক্ষার মাধ্যমে এসেছে এর নানা পরিবর্তন, যা সভ্যতার জন্য ইতিবাচক। আইনের মাধ্যমে অনেক কিছু দমন করা যায়, তবে মানবিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা কতটা সৃষ্টি হয় সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সারাদেশে অপরাধ প্রবণতাটা বাড়ছে। বিশেষ করে আগেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে যৌন অপরাধ। খবরের কাগজ খুলেই দেখা যায় নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কিছু কিছু সমাজবিজ্ঞানী এবং অপরাধবিদ্যা বিশেষজ্ঞ এই অপরাধ প্রবণতা বাড়ার পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতাটাকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন। আসলে কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতার কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ বেড়েছে।

পুলিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে কি ধর্ষণের মতো অপরাধ কমানো যাবে? এখানে একটা প্রশ্ন চলে আসে, তা হলো আইন দ্বারা কি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো দমন করা যায়? আইন দ্বারা মানুষের মনে ভয় ঢুকানো যায় আর ভয়ের কারণে মানুষ কতটা সৎ হয়, সৎ হতে হলে তার প্রয়োজন সুশিক্ষার। ঘুষ এই সমাজে একটি মারাত্মক ব্যাধি।

সারাদেশে ঘুষ বন্ধ করার জন্য সরকারে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। দুর্নীতি দমন সংস্থা কাজ করার ফলে কি দেশের অফিস-আদালতে ঘুষ গ্রহণ করাটা বন্ধ হয়েছে। ঘুষ খাওয়ার অপরাধে বহু সরকারি চাকরিজীবী চাকরি হারিয়েছেন। এই চাকরি হারানোর বিষয়টাকে কি দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়ে এ দেশের সরকারি চাকরিজীবীরা ঘুষ গ্রহণ থেকে বিরত আছেন।

শোনা যায়, ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের জনৈক নেতা প্রতিদিন বাসর সাজিয়ে একজন করে ওই বিশ্বদ্যিালয়ের পড়–য়াকে ধর্ষণ করতেন এবং ওই নেতার একশটি ধর্ষণ পূর্ণ হওয়ার পর তিনি ক্যাম্পাসে উৎসব করেছিলেন। ধর্ষক ছাত্র নেতার বিচার হয়েছিল, সেই বিচারটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিয়ে এ সমাজে ধর্ষণের মতো অপরাধ প্রবণতা কতটা হ্রাস পেয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটিকে মনস্তাত্ত্বিক বিবেচনায় নিলে ওই নেতার যে মানসিকতার বিকৃতি ঘটেছিল তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। ধর্ষণকর্মটি বিকৃত রুচিসম্পন্ন মানুষ দ্বারাই সংঘটিত হয়। এ সমাজে এ পর্যন্ত সংঘটিত হওয়া প্রতিটি ধর্ষণের সঙ্গে যারা জড়িত তারা প্রত্যেকেই বিকৃত রুচিবোধসম্পন্ন মানুষ।

যৌনকর্ম বা যৌনাচার বিষয়টি সম্পূর্ণ জৈবিক হলেও এখানে মনস্তাত্ত্বিকতার একটি বিষয় সুস্পষ্ট লক্ষণীয়। প্রতিটি মানুষের যৌনাচরণের বহিঃপ্রকাশটা ঘটে তার রুচিবোধের মধ্য দিয়ে। মানুষের রুচিবোধ এবং তার প্রয়োগের বিষয়টির উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায় শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষা মানুষকে মননশীল করে গড়ে তোলে। শিক্ষার আভিধানিক অর্থ যাই হোক না কেন, বাস্তবার্থে মানুষের মানবিক উৎকর্ষতা সাধন ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির অন্যতম উপাদান হলো শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের মানবিকতার উৎকর্ষিত হয়।

দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় কতটুকু মানিবকতা উৎকর্ষতা ঘটায় তা পরিমাপ করাটা কঠিন। তবে এ দেশে শিক্ষার মাধ্যমে মানবিকতার তেমন একটা বৃদ্ধি করতে পারে না তা বুঝা যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি থেকে।

১৯৯৮ সালের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ধর্ষণ অপরাধের মতো বহু অপরাধ ঘটছে এ দেশের শিক্ষালয়গুলোতে। এই অপরাধগুলোর সঙ্গে শুধু শিক্ষার্থীরাই জড়িত নয়, পণ্ডিত শিক্ষকরাও জড়িত। তাই প্রশ্ন করা যায়, এ দেশে শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের সভ্যতার কতটা বিকাশ ঘটেছে? মূলত শিক্ষাই মানুষের সুকোমল বৃত্তিচর্চার বিকাশ ঘটায়। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার অভাব রয়েছে পাঠ্যক্রমে। দেশের নৈতিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। যদিও ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার নামে একটি আবশ্যিক বিষয় চালু আছে দেশের বিদ্যালয়গুলোতে। তবে নৈতিক এবং ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে শিক্ষণের যে বিষয়াবলি আছে তাতে শিক্ষার্থীদের মনে জন্ম দেয় সাম্প্রদায়িক মানসিকতার। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়েই চলছে।

২০১৮ সালে দেশে ধর্ষণের শিকার হয় ১ হাজার ৩৭ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ৩ হাজার ৯৮০ জন ধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৯ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪০৮ জন। আর এদের মধ্যে ২০৪ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। যাদের দেশের প্রচলিত আইনে শিশু বলা হয়। এ ধরনের শিশু ধর্ষণের হার ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একজন মানুষের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের কতটা অবক্ষয় ঘটলে কাম লিপ্সা পূরণ করতে জোরপূর্বক একজন শিশুকে ধর্ষণ করে। তাই মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার বিকাশ ঘটানোটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জৈবিক বিষয়ক শিক্ষাটাও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে যৌনবিষয়ক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু নেই। তাই বাংলাদেশে যৌনবিষয়ক শিক্ষার অভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে অনেকেই ধারণা করেন।

এ ছাড়া কিছু পুরুষের ধারণা একজন সতী নারীর সঙ্গে সঙ্গম করলে তার দেহের শক্তি অটুট থাকবে সারা জীবন। মনস্তাত্ত্বিকবিদরা মনে করেন এ ধরনের ধারণা পোষণকারী নরপশুরা শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটায়। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে যৌনবিষয়ক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। বয়ঃসন্ধিকালে একজন শিক্ষার্থী যে শ্রেণিতে পড়বে সেই হিসাবে উল্লিখিত শ্রেণিতে যৌন শিক্ষা বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা দরকার। তবে এ দেশে পাঠ্যসূচিতে যৌনবিষয়ক শিক্ষার প্রচলন ঘটাতে চাইলে প্রথমে প্রতিবাদ করবে মৌলভীরা। এইডস এবং নারীদের বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কিত বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিছু মৌলভী।

সাম্প্রতিকালের ধর্ষণের ঘটনাপ্রবাহ দেখলে দেখা যায় মাদ্রাসার শিক্ষক কর্তৃক বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যতই প্রতিবাদ হোক না কেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বয়ঃসন্ধিকালে প্রতিটি নারী-পুরুষকে যৌনবিষয়ক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার প্রয়োজন। যৌনতা বা কাম মানুষের জৈবিক চাহিদা। খাদ্য গ্রহণও মানুষের জৈবিক চাহিদ। পেটে খাবার না থাকলে মানুষ ক্ষুর্ধাত হয়। তাই বলে কি মানুষ তার ক্ষুধা নিবারণের জন্য অন্যের খাদ্য কেড়ে খায়।

দেশের প্রতিটি ক্ষুধার্ত মানুষ কি ডাকাতি করে। ক্ষুধা নিবারণের জন্য মানুষ ডাকাতি করে না। একজন ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক তার ক্ষুধা নিবারণের জন্য দ্বারে দ্বারে হাত পেতে খাবার সাহায্য নিয়ে তার জৈবিক চাহিদা ক্ষুধা নিবারণ করে। যিনি ভিক্ষা দেন সেই দাতা ভিক্ষুকের আকুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে খাবার সাহায্য করেন। যৌন চাহিদা বা কাম প্রতিটি মানুষের একটি জৈবিক চাহিদা। ক্ষুধা নিবারিত হলে একটি মানুষ তৃপ্ত হন, ঠিক তেমনি কাম সম্পন্ন হলে একটি মানুষ তৃপ্তি পায়। কাম বা ক্ষুধার তৃপ্তির বিষয়টি নির্ভর করে সম্মতির সম্পন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াটির ওপর। তাই ধর্ষণ কখনো যৌনতা বা কামের অন্তর্ভুক্ত ঘটনা নয়। এটা একটা অপরাধ। আর ধর্ষণের মতো অপরাধ যারা ঘটায় তারা জ্ঞানহীন পশু।

মানুষের পশুত্বটা বাড়ে জ্ঞানের অভাবে। যৌন সম্পর্কিত এই বিষয়াবলি সম্পর্কে কতটা জ্ঞান আছে এ দেশের মানুষের। যৌন শব্দটি শুনলে অনেকেই মনে করে তা উচ্চারণ করাটাও পাপ। তবে যৌনবিষয়ক শিক্ষা প্রচলন করলেই যে ধর্ষণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে এটাও ঠিক না, কারণ ভিক্ষুকের মতো অনাহারী না হয়েও খাদ্যে পরিতৃপ্ত কিছু মানুষ ডাকাতি করতে দ্বিধাবোধ করে না। তাই যৌন শিক্ষার মাধ্যমে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে এটা বলা যাবে না। কিন্তু ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ইভটিজিংসহ নানা হয়রানি বন্ধ হয়ে যাবে বহুলাংশে। আদিকালে বহু মানুষ তার জৈবিক চাহিদাগুলো পূরণের জন্য নানা ধরনের পৈশাচিক কাজ করত। সভ্যতা এবং কালের বিবর্তনে শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। শিক্ষার মাধ্যমে এর এসেছে নানা পরিবর্তন, যা সভ্যতার জন্য ইতিবাচক। আইনের মাধ্যমে অনেক কিছু দমন করা যায়, তবে মানবিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা কতটা সৃষ্টি হয় সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির বিষয়ে দেশে নানা আইন রয়েছে তার প্রয়োগও হচ্ছে। তারপরও দিন দিন বেড়ে চলেছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। সরকার এ ধরনের অপরাধ দমনে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দেশে দেশে নারী এবং শিশু নির্যাতন দমন করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। দেশের এই ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা এ ধরনের ঘটনাগুলোর দ্রুত সব বিচারকাজ সম্পন্ন করছেন। তারপরও নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনা কমেনি।

সুতরাং আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করাটাও জরুরি। ধর্ষণের মতো ঘটনা দমন করতে মৃত্যুদণ্ডের মতো আইনের প্রয়োজন রয়েছে। যৌনবিষয়ক অপরাধ দমন করতে হলে আইনের পাশাপশি মানুষকে যৌন শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া এ দেশে নৈতিক শিক্ষাটা আবশ্যিক করা প্রয়োজন, যা ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে থাকবে। এই বিষয়টি শুধু শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শেখাবে।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App