×

জাতীয়

নিয়ন্ত্রণের বাইরে ডেঙ্গু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০১৯, ১২:৫১ পিএম

নিয়ন্ত্রণের বাইরে ডেঙ্গু
রাজধানীতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ানো এ রোগে প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। ঢাকা নগরীতেই এ বছর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। যা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব রেকর্ড। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মশার উৎপাতও। অতিষ্ঠ নগরবাসীর অভিযোগ, মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কখনোই দেখা যায়নি। মশক নিধনে বিদ্যমান ওষুধের কার্যকারিতা খুব একটা নেই স্বীকার করলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আছে এমন দাবি ঢাকার দুই মেয়রের। যদিও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অভিজ্ঞজন বলছেন, মশার হাত থেকে রক্ষায় দুই সিটি কখনোই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। জরুরি ভিত্তিতে নতুন ওষুধ আনার তাগিদ তাদের। এদিকে নতুন ওষুধ না আসা পর্যন্ত বিদ্যমান ওষুধই ব্যবহার করার কথা বলছেন ঢাকার দুই মেয়র। তবে এডিস মশার বংশবিস্তার যেন আর না হয়, সে জন্য জনসচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। এ জন্য লিফলেট ও প্রচারপত্র তৈরি করে সাধারণ মানুষের কাছে বিতরণ করা হচ্ছে। মসজিদের ইমামের মাধ্যমে মুসল্লি ও নগরীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক র‌্যালি ও সমাবেশও করছেন দুই মেয়র। এদিকে মশার উপদ্রব ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দুই মেয়রের উদাসীনতাকে দায়ী করে দুই করপোরেশনের ওপর ক্ষোভ জানিয়েছেন নগরবাসী। শ্যামলীর বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদের মতে, এ বছর মাত্রাতিরিক্ত হারে মশার উৎপাত বেড়েছে। কয়েল ও মশারিতেও কোনো কাজ হয় না। মশার কামড়ে টেকা দায়। অথচ টেলিভিশনের পর্দায় মশক নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় বড় কথা বলছেন কর্মকর্তারা। এসব বন্ধ করে তাদের উচিত দ্রুত নগরবাসীকে মশার হাত থেকে রক্ষার উপায় বের করা। আজিমপুরের গৃহিণী শাহানা বেগম বলেন, মশার কামড়ে ঘরে থাকা মুশকিল। গত সপ্তাহে সিটি করপোরেশন থেকে মশার ওষুধ ছিটিয়ে গেলেও মশা কমেনি। উল্টো বৃষ্টি হওয়ায় মশার উপদ্রব বেড়েছে। ছেলেমেয়েরা এরই মধ্যে পড়াশোনা করছে। প্রতিদিন যে হারে মশার কামড় খেতে হচ্ছে, তাতে ডেঙ্গু আতঙ্কে রয়েছেন তিনি। মশার উপদ্রবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সেগুনবাগিচার বাসিন্দা সজল মাহমুদ, লিমন, আজিমপুরের বাসিন্দা শামীম, মোহাম্মদপুরের মেহেদী হাসান, রামপুরার হাবিবুর রহমান, দক্ষিণ বনশ্রীর তানভীর সৈকত। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আশিক ইকবাল গত তিন দিন ধরে জ¦রে আক্রান্ত। জ¦র কমা-বাড়ার মধ্যেই আছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত তার শরীরের তাপমাত্রা ছিল ১০৪ ডিগ্রি। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেলেও কমার কোনো লক্ষণ দেখছেন না। ১৩ জুন সংসদে বাজেট পেশ করার কথা থাকলেও তিন দিন আগেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ১৩ জুন সংসদে সম্পূর্ণ বাজেট ঘোষণা করতে পারেননি তিনি। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজেট পেশ করেন। ৭ জুলাই ডেঙ্গু কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার বর্ণনা দেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। তার বর্ণনা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন সংসদ সদস্যরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার জুন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ১৭শ জন। যা বিগত বছরের তুলনায় ৫ গুণ। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আক্রান্ত হয়েছে ৩৫৮ জন। পরের সপ্তাহে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এ বছর এ রোগে এখন পর্যন্ত ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন চিকিৎসকও রয়েছেন। আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়তে পারে, এমনই আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর সূত্রে জানা গেছে, এখন এডিস মশার প্রজনন মৌসুম। এখনই এই মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। বর্তমান আবহাওয়াও এই মশা প্রজননে অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি করছে। তবে সংস্থাটির মতে, এ থেকে রক্ষায় জ্বর হলেই সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। এদিকে দীর্ঘ বছর ধরে মশক নিধনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে যে ওষুধ ছিটানো হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, তার খুব একটা কার্যকারিতা নেই। সম্প্রতি দুই মেয়র সাঈদ খোকন ও আতিকুল ইসলামও তা স্বীকার করেছেন। উত্তরে দীর্ঘদিন যাবত মশা নিধনের ওষুধ সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্তিও করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা মশক নিধনের ওষুধ পরিবর্তনের দিকেই যাচ্ছি। তবে এ জন্য বিভিন্ন গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ও গবেষক দিয়ে একটি কমিটি করেছি। তারা ওষুধ নিয়ে গবেষণা করার পর আমাদের ওষুধ পরিবর্তনের বিষয়ে যে পরামর্শ দেবেন, সেভাবেই কাজ করা হবে। জানা গেছে, প্রতি বছর সাধারণত আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাসে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। কিন্তু এবার জুন থেকে শুরু করে জুলাই মাসের ১১ তারিখ পর্যন্তই প্রায় আড়াই হাজার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। যা বিগত ৬-৭ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় এ সমস্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন নগরবিদরা। তাদের মতে, এরপরও তা বিপজ্জনক নয় বলে দুই মেয়রের বক্তব্য দায়িত্বহীনতারই পরিচয়। দুই সিটি করপোরেশন ও নগরীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, ওষুধ কার্যকর হচ্ছে না, এটা এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। রোগত্বত্ত, কীটত্বত্ত বিভাগ ও আইসিডিডিআরবিসহ কিছু সংস্থা গত ৩ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই বিষয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। দুই মেয়রের কাছে তারা তুলে ধরেছে, মশক নিধনের ওষুধ এখন আর কার্যকর নয়। তারপরও তিন বছরে বিকল্প ওষুধ বা বিদ্যমান ওষুধ কার্যকর আছে কিনা, তা অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নগরবাসীকে রক্ষার বাস্তবিক প্রয়াস দুই মেয়র নেননি। তারা প্রচার-প্রচারণার মধ্যেই ডেঙ্গু ও মশকবিরোধী কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছেন। ‘বিদ্যমান ওষুধই ব্যবহার করতে হবে’ সম্প্রতি ডিএসসিসি মেয়রের এমন বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, এমন বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। জনস্বার্থের হুমকির কোনো পরিস্থিতি যদি হয়ে থাকে, তিন সপ্তাহের মধ্যে নতুন ওষুধ বিদেশ থেকে এনে জরুরি অনুমোদন করে তা প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণকে বাঁচানো পুরো দায়িত্ব মেয়র বা সরকারের রয়েছে। কিন্তু তারা সেটা করছেন না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App