×

সাময়িকী

বিশ্বসাহিত্যে এক জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০১৯, ০৭:৫৫ পিএম

বিশ্বসাহিত্যে এক জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারা

কবি আল মাহমুদ। তিতাসপাড়ের কবি। পুরো নাম মীর আবদুস শাকুর আল মাহমুদ। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশে সক্রিয় থেকে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাকভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা আছে। অনেক কবিতা ছড়া লিখেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন প্রবল প্রতিভাধর এ কবি। বিশ্বসাহিত্যের বাঙলার এক জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারা। ১৯৩৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আল মাহমুদের জন্ম। লেখালেখি শুরু করেন পঞ্চাশের দশকে। কবি হিসেবে জনপ্রিয়তা পেতে তাঁর খুব একটা সময় লাগেনি। বাংলা কবিতার জগতে আলোড়ন তুলেছেন এই কবি। ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে সাহিত্যানুরাগীদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এই কবি। কবিতা, গল্প এবং উপন্যাস- সব শাখাতেই তাঁর বিচরণ থাকলেও, আল মাহমুদ কবি হিসেবেই ব্যাপক পরিচিত। প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৭৫ সালে তাঁর প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ পানকৌড়ির রং প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ সালে বের হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল। কবি আল মাহমুদ তাঁর অনবদ্য গল্প ও উপন্যাসের জন্যও খ্যতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৫৪ সাল অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স থেকে তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাস এবং বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তাঁর নাম পরিচিত হয়ে ওঠে এবং তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। ১৯৫০-এর দশকে যে কয়েকজন লেখক বাংলা ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে মাহমুদ একজন। আল মাহমুদের সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম সোনালী কাবিন (১৯৬৬)। বিশ্বসাহিত্যেও ব্যাপক প্রভাব-সাড়া ফেলেছে। মূলত এ কাব্যের মাধ্যমেই প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পান বাঙলা বা বিশ্বসাহিত্যে। এ ছাড়া কবির উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে : লোক লোকান্তর, (১৯৬৩) কালের কলস (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, অদৃশ্যবাদীদের রান্নাবান্না, অষ গধযসঁফ ওহ ঊহমষরংয দিনযাপন, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, একটি পাখি লেজ ঝোলা, পাখির কাছে ফুলের কাছে, আল মাহমুদের গল্প, গল্পসমগ্র, প্রেমের গল্প, যেভাবে বেড়ে উঠি, কিশোর সমগ্র, কবির আত্মবিশ্বাস, কবিতাসমগ্র, কবিতাসমগ্র-২, পানকৌড়ির রং, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধ বণিক, ময়ূরীর মুখ, না কোন শূন্যতা মানি না, নদীর ভেতরের নদী, পাখির কাছে ফুলের কাছে, প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা, প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা, প্রেমের কবিতা সমগ্র, উপমহাদেশ, বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, উপন্যাস সমগ্র-১, উপন্যাস সমগ্র-২, উপন্যাস সমগ্র-৩, তোমার গন্ধে ফুল ফুটেছে (২০১৫), ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথা), ত্রিশেরা, উড়াল কাব্য। শিশু সাহিত্যে আল মাহমুদের অবদান অনেক। কবির অসাধারণ কিছু শিশুতোষ গল্প আছে, বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর ছড়া আছে। পাখির কাছে ফুলের কাছে অন্যতম শিশুতোষ ছড়ার বই। জনপ্রিয় একটি ছড়া- ‘‘নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল/ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা ও গোলগাল।/ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে এলেম ঘর/ঘুমন্ত এই মস্ত শহর করছিলো থরথর।/মিনারটাকে দেখছি যেন দাঁড়িয়ে আছেন কেউ,/পাথরঘাটার গির্জাটা কি লাল পাথরের ঢেউ?/চৌকিদারের হাঁক শুনে যেই মোড় ফিরেছি বায়-(না ঘুমানোর দল -আল মাহমুদ) কবি বাংলার মানুষ আর প্রকৃতিকে তিনি অভিন্ন করে ফেলেছেন- তাই অনায়াসে বলতে আল মাহমুদ পারলেন, ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে, মনের কথা কই’। সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে ১৯৫৪ সালে মাহমুদ ঢাকা আগমন করেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলায় লেখালেখি শুরু করেন। তিনি পাশাপাশি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সাল কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকার বিরোধী সংবাদপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪) পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। আল মাহমুদ ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দা নাদিরা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। দেশমাতৃকার প্রতি, ভাষার প্রতি অকৃত্রিম দরদ ফুটে ওঠেছে এভাবে- ‘‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/ বরকতের রক্ত।/হাজার যুগের সূর্যতাপে/ জ্বলবে এমন লাল যে,/সেই লোহিতেই লাল হয়েছে/কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে।/প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে/ছড়াও ফুলের বন্যা/বিষাদগীতি গাইছে পথে/ -(একুশের কবিতা) অথবা যদি বলি এভাবে- ‘‘মাতৃভাষা সবার আশা/হৃদয় ছুঁয়ে যায়/মানুষদেরই আছে ভাষা/আর কি কারো নাই?/...’’-(মাতৃভাষা, অপ্রকাশিত কবিতা, আল মাহমুদ) ১৯৭১ সালে তিনি ভারত গমন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি পরিচালক হন। পরিচালক হিসেবে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরে- এ সময়ের মাঝে তাঁর মতাদর্শে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। আল মাহমুদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের আগে বাম ধারা দেখা গেলেও ১৯৭৪ সালের পর থেকে তাঁর কবিতায় ইসলামী ভাবধারাও লক্ষ করা যায়। সারা জীবনে কবি আল মাহমুদ অনেক পুরস্কার-পদক পেয়েছেন। ১৯৫০ সালের পর বাংলা সাহিত্যে যত কবির আবির্ভাব হয়েছে, শিল্পমান এবং লেখার বিচারে বিশ্লেষকরা আল মাহমুদকে সন্দেহাতীতভাবে প্রথম সারিতেই রাখা যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App