×

জাতীয়

চট্টগ্রামের পাহাড় বাঁচাবে কে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০১৯, ০১:৩৯ পিএম

চট্টগ্রামের পাহাড় বাঁচাবে কে

চট্টগ্রামে লালখানবাজার এলাকায় অবৈধভাবে পাহাড় দখল ও ঘরবাড়ি তৈরি করে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস -ভোরের কাগজ

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, নাকি ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়? রাজনৈতিক দলের নেতারা? নাকি এসবের বাইরে অন্য কেউ? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত। এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের দায় এড়াচ্ছে বার বার। যার কাছে জানতে চাইবেন তিনিই বলেন, বিষয়টি তো আমাদের নয়, অমুকের, তাদের জিজ্ঞেস করুন। এ অবস্থার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষার বিষয়টি। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো রক্ষা, ধসরোধ, পরিবেশ রক্ষাসহ নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’ নামে একটি কমিটিও রয়েছে যাতে বিভিন্ন সরকারি অফিসের কর্মকর্তারা যুক্ত রয়েছেন। কমিটির বৈঠকও হয় যথারীতি। বৈঠক শেষ করে কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে প্রায়ই বলেও থাকেন, যেকোনো মূল্যে পাহাড় রক্ষা করা হবে, অবৈধ দখলদাররা আর থাকতে পারবে না ইত্যাদি। কিন্তু কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে, তা মোটামুটি চট্টগ্রামবাসী ভালোই জানেন। বর্ষা মৌসুমে প্রতিবছরই চট্টগ্রাম নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসরত মানুষদের সরানোর জন্য তোড়জোড় করে জেলা প্রশাসন। কিছু উচ্ছেদ করে কিন্তু তাও কিছুটা সময় বা কয়েকটি দিনের জন্য। আবারো সেই মানুষগুলো ফিরে যায় পাহাড়ের মৃত্যুঝুঁকিতেই। গত শনিবার ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ধসের আশঙ্কায় জেলা প্রশাসন মাইকিং, উচ্ছেদ, ৮টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা এমনকি কিছু ত্রাণসামগ্রীও দিয়েছে। কিন্তু গত রবিবার সেসব এলাকায় গিয়ে জানা গেল, শনিবার রাতে ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার পরপরই যেসব লোক আশ্রয় নিয়েছিল তারা আবার চলে গেছেন। লালখান বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজাদ ইকবাল পারভেজ গতকাল রবিবার এ প্রতিবেদককে জানান, শনিবার রাতে ৫০/৬০ জন নারী-পুরুষ শিশু এসেছিল ঠিকই। কিন্তু জেলা প্রশাসন থেকে কিছু ত্রাণ পাওয়ার পর রাত ১১টার দিকেই তারা চলে গেছেন। এমন চিত্র অন্যন্য অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রেও। গত বছর ২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল তৎকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া চট্টগ্রাম সফরকালে বলেছিলেন, ‘পাহাড় রক্ষা ও পাহাড়ের মাটিধসে প্রাণহানি ঠেকাতে চট্টগ্রাম এলাকায় পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদে কোনো ধরনের ছাড় না দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাহাড় দখলকারীরা যতই প্রভাবশালী, যত বড় নেতাই হোক ও যতই শক্তিশালী হোক কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশ, প্রভাবশালী তো দূরে থাকুক, কারও কোনো হস্তক্ষেপ এখানে চলবে না।’ কিন্তু মন্ত্রীর সেই নির্দেশকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়েছেন লালখানবাজার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুম ও ওই এলাকার সংরক্ষিত কাউন্সিলর বিএনপি নেত্রী মনোয়ারা বেগম মনি গত ১১ এপ্রিল। জেলা প্রশাসনের উচ্ছেদকারী টিম লালখানবাজার এলাকায় অবৈধ উচ্ছেদ করতে গেলে তারা স্থানীয় লোকজনকে উসকে দিয়ে সড়ক অবরোধ এমনকি ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর হামলাও চালিয়েছিল। বাধ্য হয়ে সেই উচ্ছেদকারী টিম সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়। কিন্তু সরকারি কাজে বাধা ও জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি করলেন দুই রাজনৈতিক দলের দুই নেতা, তাদের কিছুই হয়নি আজ পর্যন্ত। প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে ১২৯ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি ২৮টি কারণ নির্ধারণ করে ৩৬টি সুপারিশ প্রণয়ন করলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্তসমূহ কেন বাস্তবায়িত হয়নি, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চউক-এর বোর্ড মেম্বার ও নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান জবাব দিলেন এভাবে- ‘প্রভাবশালী প্রাণী’। প্রভাবশালীর কারণেই কাজ হচ্ছে না। কারণ পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজের বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। যেটির প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। প্রশাসন কিছুই করতে পারবে না যতক্ষণ রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন-হুমকি-ধমকি বন্ধ না হবে। চট্টগ্রামে সরকারি ৬টি সংস্থার মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি পাহাড় আছে। রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, সিডিএ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন এসব পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। কিন্তু এসব পাহাড়ের মালিকরাই অবৈধ স্থাপনা নিয়ে উদাসীন। সরকারি সংস্থাগুলোর নীরবতার পরিপ্রেক্ষিতে এই ৬টি সংস্থাকে নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে পাহাড়গুলো থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে চিঠি দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এসব ব্যাপারে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে, ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরানো হচ্ছে। সরকারি সংস্থার পাহাড়গুলোতে অভিযান চলছে, উচ্ছেদ করা হচ্ছে। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু সুপারিশের আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে, কিছু হয়নি। আগে এগুলো কেন হয়নি, তা আমি জানি না। পাহাড় উচ্ছেদ অভিযানে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বাধা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো ধরনের বাধা আছে বলে মনে করি না। বাধা থাকলেও মানুষের প্রাণ রক্ষায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো বাধায় কাজ হবে না। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের পুনর্বাসনে কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, এই ধরনের কোনো প্রকল্প নেই। পাহাড়ে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন প্রকল্প নিলে দেখা যাবে, সেখানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে থেকে মানুষ এসে ভিড় করবে। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান ভোরের কাগজকে বলেন, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের উচ্ছেদে এখন কোনো বাধা নেই। কিন্তু পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসে মূল জায়গা হচ্ছে রাজনৈতিক। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের পুনর্বাসনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। তারা কী উদ্যোগ নেয়, দেখা যাক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App