×

জাতীয়

স্বস্তি নাকি ভোগান্তি দোলাচলে জনগণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০১৯, ১২:৪০ পিএম

যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনার অজুহাতে আজ রবিবার থেকে রাজধানীর তিনটি প্রধান সড়কের প্রায় ২৩ কিলোমিটার অংশে রিকশা নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কন্ট্রোল অথোরিটি (ডিটিসিএ)। কিন্তু এই দীর্ঘপথে চলাচলের জন্য বিকল্প যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই ধারণা করা হচ্ছে, আজ সকালে রাস্তায় নেমেই যান সংকটে চরম ভোগান্তিতে পড়বেন কর্মজীবী মানুষ ও শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে জীবিকায় টান পড়বে কয়েক লাখ রিকশা চালকের। গত ৩ জুলাই ডিএসসিসির নগর ভবনে ডিটিসিএর এক বৈঠকে গাবতলী থেকে আসাদগেট হয়ে আজিমপুর (৮.৫ কি.মি.), সাইন্সল্যাব থেকে শাহবাগ (১.৫ কি.মি.) এবং কুড়িল থেকে রামপুরা ও খিলগাঁও হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত (১৩ কি.মি.) সড়কে রিকশা নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেইসঙ্গে জানানো হয়, ৩ দিন পর অর্থাৎ আজ ৭ জুলাই থেকে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসাধারণের চলাচল ও রিকশা চালকদের উপার্জনের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না করে এমন সিদ্ধান্তে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে নগরবাসী। প্রধান রাস্তায় চলাচলরত রিকশাগুলো ঢুকে পড়বে গলির রাস্তায়। এতে গলির সরু রাস্তায় যানজটে বাড়তি চাপের মুখে পড়বে এলাকাবাসী। এছাড়া দীর্ঘ দূরত্বের ‘খ্যাপ’ না পাওয়ায় আয় কমে যাবে কয়েক লাখ রিকশা চালকের। বাধ্য হয়েই এদের কেউ কেউ হয়তো জড়িয়ে যাবেন বিভিন্ন অপরাধে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নগরের রাজপথে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত লোকাল বাস নেই। আগে রিকশা থাকার পরও অফিস/স্কুল টাইমে বাসে উঠতে-নামতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যেত। রিকশা বন্ধের পর ২০/৫০টি বাস নামিয়ে অতিরিক্ত চাপ সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ পরিস্থিতিতে স্বল্প দূরত্বের পথটুকু স্বস্তিতে হেঁটে যাওয়ার মতোও পরিস্থিতি নেই। কেননা ফুটপাতে গড়ে উঠেছে দোকানপাট, আছে ময়লার ভাগাড় এবং অগণিত বৈদ্যুতিক খুঁটি। অন্যদিকে সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। মোটরসাইকেল রাইডেও চড়া যায় মাত্র একজন যাত্রী। ফলে শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থদের নিয়ে চলাচলে চরম ভোগান্তিতে পড়বেন নগরবাসী। সাইন্সল্যাবে অফিস হওয়ার কারণে আজিমপুরবাসী শিহাবের প্রতিদিন সকালে জ্যাম পেরিয়ে অফিসে যেতে হয় রিকশাতেই। এমন অবস্থায় হুট করে রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তকে কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি। বললেন, এই রুটগুলোতে রিকশা বন্ধের আগে পর্যাপ্ত বাস বা গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা না হলে আমাদের মতো যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। তিনি মনে করেন, রিকশা নয় প্রাইভেটকারের মতো ছোট গাড়িই যানজটের মূল কারণ। তাই বিষয়টি নিয়ে সরকারের পুনরায় ভাবা উচিত। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকা শহরের সড়কে যানবাহনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ডিটিসিএ কমিটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সড়কগুলোতে রিকশা চলাচল বন্ধ হওয়ার পর নাগরিকদের যেন চলাচলে সমস্যা না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। পরিবহন মালিক সমিতি এবং বিআরটিসির পর্যাপ্ত বাস সেবার ব্যবস্থা করা হবে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীর রিকশা চালকদের জীবন-সংগ্রাম, দেশের পণ্য ও নাগরিক পরিবহনে তাদের প্রয়োজনীয়তা, অবদান এবং সংগঠিতকরণ বিষয়ে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনের প্রকাশ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। সেখানে বলা হয়, ঢাকা শহরের অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষ রিকশায় চড়ে। রাজধানীতে দুই সিটি করপোরেশন একমাত্র রিকশা লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ, যা ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ৭৯,৫৫৪ রিকশা লাইসেন্স ইস্যু করেছে। তবে বর্তমানে ঢাকা শহরের রিকশার প্রকৃত সংখ্যা ১০ লাখেরও অধিক। আনুমানিক ১৫ লাখ রিকশাচালক ও তাদের পরিবার ঢাকা শহরে রিকশার আয়ের উপর নির্ভরশীল। ঢাকা শহরের সকল রিকশাচালক অদক্ষ এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে স্থানান্তরিত। তাদের অধিকাংশই পরিবার ছাড়াই ঢাকায় বাস করে এবং গ্রামের বসতবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করে। তাই ঢাকা শহরে রিকশার সংখ্যা সীমিত করলে তাদের জীবিকার ঝুঁকি বাড়বে এবং এইসব দুর্বল মানুষকে আরও দুর্বল করে তুলবে। এ ব্যাপারে উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসির) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, একটি সড়কে ম্যানুয়াল এবং মেকানিক্যাল সিস্টেম একসঙ্গে চলতে পারে না। এ জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেসব সড়কে যান্ত্রিক পরিবহন চলে সেসব সড়কে রিকশা চলতে দেয়া হবে না। এর কারণে শুধু যে যানজট হচ্ছে তা নয়, দুর্ঘটনারও শঙ্কা থাকছে। তিনি বলেন, আমরা পুরো শহর থেকে রিকশা তুলে দিচ্ছি তা কিন্তু নয়। আমরা শুধু বলছি শহরের প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা যেন না চলে। শহর থেকেই রিকশা তুলে দেয়া হচ্ছে না। তাই এটা নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। জনগণের চলাচলে বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে বলেও জানান মেয়র আতিক। এদিকে রাজধানীতে রিকশা ও হকার উচ্ছেদে ক্ষোভে ফুঁসছেন চালক ও হকার সংগঠনগুলো। হকার সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়ক আবুল হোসেন বলেন, বিকল্প ব্যবস্থা না করে রিকশা বন্ধ ও উচ্ছেদ করা আদালতের নির্দেশনা অমান্যের শামিল। সিটি করপোরেশনকে বলতে চাই, আগে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিন, বিকল্প বন্দোবস্ত করুন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ফুটপাতে কোনো রিকশা-হকার থাকবে না এই ঘোষণা দেয়ার আগে বিকল্প কোনো উদ্যোগ নেয়া হলো না। তাহলে হকার আর রিকশাওয়ালারা যাবে কোথায়? প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদনÑ প্রয়োজনে নীতিমালা, আইন করুন, আমরা ভেসে আসিনি। আমাদের পেটে লাথি মারা হলে আমরা প্রতিহত করব। অন্যদিকে, রিকশা তুলে দেয়ায় সিদ্ধান্তের খবরে উপার্জনের বিকল্প চিন্তায় দিশেহারা চালকরা। গতকাল রামপুরা এলাকার রিকশা চালক সাজ্জাদ হোসেন হতাশ কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘কাল থ্যাইকা তো আর রেকসা চালাইবার পারুম না। পেট মারা সব নিয়ম খালি আমাগো বেলায়ই’। তিনি বলেন, ‘গলির রাস্তায় চালাইতে পারুম তয় কয় টাকা আর ভাড়া পামু? এখন যে টাকা উপার্জন করি দুবেলা খাইতে পারি, এটা বন্ধ হইলে না খাইয়া মরুম আরকি। সারাদিন আয় হয় ৩শ থেকে ৪শ টাকা। গ্যারেজে জমা দিতে হয় ১২০ টাকা। জমা কি দিমু আর খামু কি।’ সড়কে রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, স্বল্প দূরত্বে রিকশায় চলাচল করেন একটি বড় অংশের যাত্রী। পর্যাপ্ত গণপরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারলেই রিকশা বন্ধের এই উদ্যোগ স্বার্থক হবে। তা না হলে ব্যাপক বিড়ম্বনায় পড়বেন স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতকারী যাত্রীরা। তিনি আরও বলেন, রিকশা চালকদের পুনর্বাসনের জন্যও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো এটা গণবিরোধী সিদ্ধান্ত হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App