×

মুক্তচিন্তা

দায়-ব্যর্থতা কার?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০১৯, ০৭:৫১ পিএম

তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ নয়, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে আন্তরিক করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। অপরাধীদের বিচারবহির্ভূত হত্যার চেয়ে অপরাধপ্রবণতা রোধ করতে গবেষণা করে তার উপায় খুঁজে বের করা উচিত। অপরাধী নয়, মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি থেকে বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাসহ সমসাময়িক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে একটু চিন্তা করলে অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য মূলত কে দায়ী? রাষ্ট্র, নাকি রাষ্ট্রযন্ত্র? রাষ্ট্রযন্ত্র যেহেতু রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত, তাই রাষ্ট্র নিজেও এই দায় এড়াতে পারে না। অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে স্যোশাল মিডিয়া থেকে সামাজিক সংগঠন যখন একের পর এক সমালোচনায়, আন্দোলনে ওই অপরাধের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেছে, তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়েছে। আর তখনই রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলার খতিয়ানও প্রকাশ পেয়েছে। শুধু প্রকাশই নয়, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় কর্তাব্যক্তির অবহেলার পাশাপাশি কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে- এটিও সরকারপ্রধানসহ জনগণের সামনে উঠে এসেছে। আর এটা যে শুধু ফেনীর সোনাগাজীর সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়- তা সরকারপ্রধানসহ দেশের জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়েছে বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার দৃশ্যপট ভাইরাল হওয়ার মাধ্যমে। এই দুটি ঘটনা বিচ্ছিন্ন বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মূল অপরাধীদের আড়াল করার দায় নিতে পারি না। এসব অপরাধীকে একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতাসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য আশ্রয়-প্রশ্রয় কিংবা পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে জনগণের জানমালের ক্ষতি করছে না, সরকারপ্রধানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নুসরাত হত্যার পিবিআইয়ের তদন্ত রিপোর্ট, গণমাধ্যমের অনুসন্ধান প্রতিবেদন এবং সর্বোপরি স্থানীয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের গ্রহণযোগ্য মতামত, ছবি, কয়েক মিনিটের ভিডিও যেভাবে ভাইরাল হয়েছে, তাতে ফেনী জেলার পুলিশ সুপারসহ সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), তদন্ত কর্মকর্তাসহ (তদন্ত ওসি) স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতারা নুসরাত হত্যার মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ওই কর্মকর্তারা তাদের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য একদিকে তাদের সদর দপ্তরকে লিখিতভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুরো পুলিশ বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র করেছে, অন্যদিকে মূল অপরাধীদের বাঁচানোর সব ধরনের চেষ্টাও করেছে। এদিকে বরগুনার নয়ন বন্ডের বিরুদ্ধে একদিনে বা এক সপ্তাহে কিংবা এক মাসেই দশ দশটি মামলা হয়নি। আবার নয়ন বন্ড রাতারাতি ছিঁচকে চোর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীও হয়ে ওঠেনি। তাকে শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে রিফাতের খুনি বানানো হয়েছে। বরগুনার কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যখন বেসরকারি টেলিভিশন টকশোতে বলে, ইয়াবার চালানটি ছোট ছিল! তখন বুঝতে হয়, নয়ন বন্ড কার দ্বারা পৃষ্ঠপোষক পেয়ে আসছে। কারা নয়ন বন্ডের মাদক ব্যবসার টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। আবার অন্যদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান যখন নয়ন বন্ডের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খতিয়ান জানার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্বারা স্থানীয় জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে উল্টো স্থানীয় লোক কর্তৃক অভিযুক্ত হয়, তখন বোঝা যায় ছিঁচকে চোর থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার পেছনে মূলত কারা কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এখানে ভাগ্য ভালো ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যার প্রধান আসামি তথাকথিত অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা। তাকে বাঁচানোর জন্য স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা তদবির-লবিংসহ অবশেষে কতিপয় নষ্ট সংবাদকর্মীদের দিয়েও অগ্রহণযোগ্য মিডিয়া ও স্যোশাল মিডিয়ায় প্রচার-প্রকাশ করিয়েছে ‘নুসরাত আত্মহত্যা করেছে’ বলে। কিন্তু তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে সিরাজ উদদৌলা নিহত হয়নি। সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে চায়ের টেবিলে কথা হলে সবাই নয়ন বন্ডকে দুর্ভাগা বলে। সেও কারাগারে থাকা অবস্থায় রিফাতকে হত্যা করলে হয়তো সিরাজ উদদৌলার মতো প্রাণে বেঁচে যেত। গ্রেপ্তারের অভিযানের নামে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণহীন নীরব-নিথর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকার দৃশ্যটি ভাইরাল হতো না। আমিও অন্য সবার মতো এ হত্যার মহোৎসবে স্যোশাল মিডিয়ায় মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। একেকবার আমিও খুনিদের খুন করে সমাজ-রাষ্ট্রকে অপরাধমুক্ত করতে শিউরে উঠি। কিন্তু পরক্ষণেই যখন দেখি, মানুষ আকারে বস্ত্রহীন যে প্রাণীটি জন্মলাভ করে ধীরে ধীরে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় এক অজানা যুদ্ধের পথে নিজেকে নিয়োজিত রাখে, যখন দেখি সেই পথে কতিপয় ভণ্ড রাজনীতিবিদ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন আমিও সেই খুন করার দিবাস্বপ্ন থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসি। মানুষ থেকে অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে রাষ্ট্রযন্ত্রের কতিপয় কর্তাব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা দেখে আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। আমি সত্যিই আতঙ্কিত আমার বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে। কার ভরসায় তাদের ধীরে ধীরে বড় করব? কোন নিশ্চয়তায় এ সমাজ-রাষ্ট্রে নিরাপত্তাবোধ করব? তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে সাময়িকভাবে একটি অপরাধীকে এ পৃথিবী থেকে বিদায় করতে পারলেও অপরাধপ্রবণতা কি চিরতরের জন্য বিদায় করা সম্ভব হয়েছে বা সম্ভব? রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করার সময় কেন সাধারণ মানুষ সহযোগিতা করেনি কিংবা রিফাতের স্ত্রীর সাহায্যের আবেদনেও কেন সাড়া দেয়নি- এটি দেশের অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে খোদ আদালত পর্যন্ত অবাক হয়েছেন। শুধু তাই নয়, মানুষ তো আগে এমন ছিল না- এমন মন্তব্যও আদালত করেছেন। কিন্তু যারা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে খুনিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, সত্যের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছে- এ রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র ওইসব সাহসী মানুষের জন্য কী করেছে? ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার সময় তৃতীয় লিঙ্গের লাবণ্য নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে ঝাপটে ধরেছিল খুনিকে। কী রকমভাবে জীবনযাপন করছে ওই লাবণ্য- এই রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র একবারও খোঁজখবর নিয়েছে? লাবণ্য এখন মিডিয়াতে মুখ ঢেকেও কথা বলতে চায় না। সাংবাদিকদের অনুরোধ করে, আমাকে আর ভাইরাল করবেন না। কারণ এই সাহসী লাবণ্য নিজের নাম-পরিচয় লুকিয়ে ঠিকানা বদল করে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছে। কখন যে তার মাথার ওপর খুনিদের কোপ পড়ে সেই দুশ্চিন্তায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে তার। আমি দেখেছি ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল) রাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা চেয়েও পায়নি। রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিরা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বরং পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আর পুলিশের ওই পরামর্শ অনুযায়ী নিলয় পালিয়ে না গিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের চাপাতির কোপে মৃত্যুর কাছে তার জীবন পরাজিত হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। যোগ্য লোক দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্র সাজানোর পাশাপাশি সরকারকেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর অসাধু রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া, আইনের আওতায় এনে অপরাধ অনুযায়ী শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র বা সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট তৈরি হলে সেটা সরকারকে বহন করতে হয়, সরকারের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়। সরকারের ভালো কাজগুলোও ম্লান হয়ে পড়ে। তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ নয়, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে আন্তরিক করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। অপরাধীদের বিচারবহির্ভূত হত্যার চেয়ে অপরাধপ্রবণতা রোধ করতে গবেষণা করে তার উপায় খুঁজে বের করা উচিত। অপরাধী নয়, মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

কবীর চৌধুরী তন্ময় : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App