×

জাতীয়

কুড়িগ্রামে ধান-চাল-গম ক্রয়ে সীমাহীন দুর্নীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০১৯, ০৩:০৮ পিএম

কুড়িগ্রামে ধান-চাল-গম ক্রয়ে সীমাহীন দুর্নীতি
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ধান-চাল ও গম ক্রয়ে খাদ্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি এসব পণ্য ক্রয়ের কথা থাকলেও তা কেনা হচ্ছে না। ভারপ্রাপ্ত খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা (ওসি এলএসডি) মনোয়ারুল ইসলামের একটি আস্থাভাজন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে, বিভিন্ন প্রকল্পের ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) সমন্বয় করে এসব পণ্য ক্রয় করা হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও ২ সপ্তাহ আগে ওই গুদাম কর্মকর্তার পছন্দের ৩টি পরিত্যক্ত রাইস মিলের সঙ্গে জেলা খাদ্য কর্মকর্তা ধান ছাঁটাইয়ের চুক্তি করেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ২ জন মিল মালিক চুক্তির ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানা গেছে। এমন লাগামহীন দুর্নীতির কারণে সরকারের ক্রয় অভিযান ভেস্তে যেতে বসেছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক ফজলুল হক একমত না হওয়ায় তাকে নানাভাবে হেনস্তা করে জরুরিভিত্তিতে বদলি করা হয়। ওই সিন্ডিকেট গত ১ জুলাই ফজলুল হককে তার অফিসে দীর্ঘ সময় তালাবদ্ধ করে রাখে। এ ঘটনায় উপজেলার ধানচাষি ও সাধারণ মিল মালিকদের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়েছে। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে প্রথম দফায় উপজেলায় ৬শ ৩৭ টন ধান ক্রয়ে বরাদ্দ আসে। প্রশাসন ও শাসক দলের টানাপড়েনে বেশ বিলম্বে দুই দফায় লটারি হয়। তত দিনে প্রকৃত কৃষকরা তাদের কষ্টার্জিত ফসল, বাজারে পানির দরে বিক্রি করে দেন। এদিকে, লটারি অনুষ্ঠানের পর পর খাদ্য গুদামকেন্দ্রিক সরকারি দলের পরিচয়ে গড়ে ওঠা একটি সক্রিয় সিন্ডিকেট নির্বাচিত কৃষকদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও কৃষি কার্ড সংগ্রহ করে গুদামে ধান ঢুকানোর ব্যাপারে সক্রিয় হয়। অন্যদিকে জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মহিবুল হক গোপনে নিয়মবহিভর্‚তভাবে ১শ টন ধান ছাঁটাইয়ের জন্য তিন চাল কলের সঙ্গে চুক্তি করেন। এর মধ্যে ‘রাজা-রানা’ চাল কল ৩০ টন, ‘রিফাত’ চাল কল ৩০ টন ও ‘আজাদ’ চাল কলের সঙ্গে ৪০ টন ধান ছাঁটাইয়ের চুক্তি হয়। কিন্তু চুক্তির ২ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও গত শনিবার সরজমিনে ‘রিফাত’ চাল কল ও ‘আজাদ’ চাল কলে গিয়ে দেখা যায় এসব মিলে বয়লার, হাউস, চাতাল, গুদামঘর দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আজাদ চালকলের মালিক আবুল কালাম আজাদ অবাক হয়ে বলেন, ধান ছাঁটাইয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছি- এমন খবর আপনাদের মাধ্যমে জানলাম। রিফাত চাল কলে গিয়ে দেখা যায় মিলটি দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত রয়েছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি মিল মালিক মাহাবুবার রহমান তার ছোট ভাই সালু মিয়ার কাছে মিলটি বিক্রি করে দিয়েছেন। রাজা-রানা চাউল কলটিতে ছাঁটাইয়ের কোনো ধান পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য বিভাগের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, উলিপুর খাদ্যগুদামে সক্রিয় সিন্ডিকেটটির সঙ্গে গুদাম কর্মকর্তা অবৈধ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছে। ছাঁটাইয়ের বিষয়টি গোপন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওই কর্মকর্তা নির্বাচিত কৃষকদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কাগজ কলমে ধান ক্রয় দেখিয়ে ডবি্লউকিউএসসির মাধ্যমে সিন্ডিকেটের হাতে টাকা তুলে দেয়। এরপর তারা ধান না কিনে ১৬ থেকে ১৭ টাকা কেজি দরে পুরাতন চাল বাজার থেকে কিনে এবং কিছু প্রকল্পের ডিও সমন্বয়ের মাধ্যমে সরবরাহ দেখিয়ে মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এভাবে প্রতি মণ ধানের ১ হাজার ৪০ টাকা ও ছাঁটাই বাবদ ৩০ টাকাসহ মোট ১ হাজার ৭০ টাকার বিনিময়ে সিন্ডিকেটটি নিম্নমানের চাল খাদ্য গুদামে দিচ্ছে। এতে প্রতি মণে তাদের লাভ হচ্ছে ৬২৮ টাকা। ১শ ৩১ টন গম ক্রয়ের জন্য লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচিত করা হয়। গত ২৬ জুন পর্যন্ত কৃষকদের কাছ থেকে মাত্র ৫৪ টন গম সংগ্রহ দেখানো হয়। পরে মাত্র ৩ দিনে অবশিষ্ট ৭৭ টন ক্রয় দেখানো হয়। খাদ্যগুদাম সংশ্লিষ্ট অভিযোগ, বর্তমানে সংরক্ষণ করা গমের বস্তার মাঝখানে পুরাতন গম, আর চতুর্দিকে নতুন গমের বস্তা দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কাগজ কলমে ১শ ৩১ টন গম ক্রয় দেখানো হলেও বাস্তবে সেখানে মজুদ কম। এভাবে লাগামহীন এ দুর্নীতির হিস্যা পাচ্ছেন উপজেলা ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা আবদুস সালাম, জেলা খাদ্য কর্মকর্তা মহিবুল হক, বিভাগীয় খাদ্য কর্মকর্তা রায়হানুল কবির। ভারপ্রাপ্ত খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমার এখানে কোনো অনিয়ম হয় না। ৫৪ টন গম গত ২৬ জুন পর্যন্ত সংগ্রহ হলেও মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে ৩০ জুন অবশিষ্ট ৭৭ টন গম কিভাবে সংগ্রহ হলো জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুস সালাম মিয়া অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করে ধান ছাঁটাইয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ মিলের তালিকা দিতে অপারগতা জানান। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মহিবুল হকের সঙ্গে কথা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আগে বললে এসব ব্যাপারে খতিয়ে দেখা যেত। তবে তিনি এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশ না করার জন্য বলেন। রংপুর বিভাগীয় আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক রায়হানুল কবিরের সঙ্গে এসব অনিয়মের বিষয়ে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি দুর্নীতির বিষয় এড়িয়ে যান। খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুমের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, নীতিমালা অনুযায়ী মিল পরিদর্শনের পর ছাঁটাইয়ের জন্য মিল মালিকদের সঙ্গে চুক্তি হবে। এখানে নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App