×

মুক্তচিন্তা

সোসাইটি ৫.০ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০১৯, ০৯:৫৬ পিএম

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মধ্য দিয়ে আমরা কেবল শিল্পবিপ্লব করতে চাই না, একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত-বৈষম্যহীন উন্নত বাংলাদেশকে তার জন্মের ঠিকানায় স্থাপন করতে চাই। ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করে আমরা সারা দুনিয়ার কাছেই একটি সর্বজনীন লক্ষ্য প্রকাশ করেছি। জাপান, ব্রিটেন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা জার্মানি যেমন করে আংশিক ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলছে আমরা তার চাইতে বহু পথ সামনে রয়েছি।

বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি নানা দেশে নানা নামে পরিচিত। আমরা বিশ্বজুড়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা শুনছি। অনেকেই আলাদাভাবে সোসাইটি ৫.০, আইআর ৪.০ ইত্যাদি বলছে। কেউ কেউ বলছে স্মার্ট নেশন। আমাদের কর্মসূচি তো ডিজিটাল বাংলাদেশ আছেই। জাপানের সোসাইটি ৫.০ এবং অন্যান্য বিষয়াদির সঙ্গে আসুন ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করি।

সোসাইটি ৫.০ কেমন করে : জাপানিরা ভাবছে যে, তারা বস্তুত ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেই সোসাইটি ৫.০ গড়ে তুলবে। ফলে যদিও তারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে পাশ কাটিয়ে তাদের গন্তব্য স্থির করেছে বলে মনে করা হচ্ছে তথাপি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূলভিত্তি ডিজিটাল প্রযুক্তিকেই তারা বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছে। তবে জাপানিদের চিন্তায় তাদের মুখ্য সমস্যা-সংকট বা চ্যালেঞ্জগুলো প্রাধান্য পেয়েছে। তাদের ভাবনার দু-চারটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে।

ক) বিগ ডাটার ব্যবহার বিষয়ে তাদের ভাবনা : Big Data collected by IoT will be converted into a new type of intelligence by AI and will reach every corner of society. As we move into Society 5.0 all people’s lives will be more comfortable and sustainable as people are provided with only the products and services in the amounts and at the time needed. স্পষ্টতই বোঝা যায়, জাপান মনে করে যে, বিগ ডাটা বিশ্লেষণ করতে পারার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তাদের সোসাইটি ৫.০ এ পৌঁছে যাওয়ার পথটাকে সুগম করবে। বিগ ডাটার প্রয়োগ বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থাসহ ডিজিটাল রূপান্তরে ব্যাপকভাবে সহায়তা করতে পারে।

খ) উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থা : অন্যদিকে জাপান মনে করে তার বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে বিকাশমান প্রযুক্তিকে সমন্বিত করে তারা সোসাইটি ৫.০ এ পৌঁছে যেতে পারে। বিশেষ করে বিগ ডাটা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ বিষয়ে ব্যাপক সহায়তা করতে পারে।

Japan’s advanced technology cultivated from “monozukuri” (Japan’s excellence in the manufacturing of things) and years of basic research, will work as advantages toward creating products using information technologies like Big Data and AI, which can then be released into our society. বাংলাদেশের জন্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে জাপানের প্রাক-ডিজিটাল যুগে পৌঁছানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যদি জাপানের ধারণাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারি তবে তিনটি শিল্পবিপ্লব মিস করার যে সংকট আমাদের রয়েছে সেটি আমরা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জাপানের মতো উৎপাদন ব্যবস্থার অধিকারী হতে পারি।

গ) বয়স্ক জনগোষ্ঠী : একটি বড় প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, কেমন করে বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যেতে পারে। জাপানিরা এ সমস্যাটির সমাধান এভাবে করবে বলে মনে করে। Connect and share information between medical data users including medical checkup records, as well as treatment and nursing care records. Put remote medical care services into practice. Use AI and robots at nursing-care facilities to support people’ s independence. বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সমস্যাটি জাপানের মতো তীব্র বাংলাদেশে না থাকলেও গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার ফলে আমাদেরও একটি বিশাল বয়স্ক জনগোষ্ঠীর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের সহায়তার জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি অবশ্যই সহায়ক হতে পারে।

ঘ) চলাচল ও প্রযুক্তি : মানুষের জন্য চলাচল বা পরিবহন ব্যবস্থা খুবই জরুরি। সেই বিষয়টি সম্পর্কে তারা মনে করে যে, প্রযুক্তি এখানে বড় সহায়তা করবে। People in underpopulated areas find it difficult to shop and visit hospitals because of a lack of public transportation. However, autonomous vehicles will enable them to travel more easily while delivery drones will make it possible to receive whatever someone needs. A shortage of distribution labor will not be a worry. পরিবহনের এ বিষয়টি আমাদের জন্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের ভাবনা এমন হতে পারে যে চালকবিহীন যানবাহন প্রচলিত হলে আমাদের বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান ক্ষুণ্ন হতে পারে। অন্যদিকে দ্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার আমাদের দ্বীপ, চর, হাওর বা অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব সাধন করতে পারে। এটি একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবাতেও ব্যাপক সহায়ক হতে পারে।

ঙ) জীবনধারার সঙ্গে প্রযুক্তির প্রয়োগ হতে পারে এভাবে : By employing new technologies including Information and Communication Technology (ICT), robots, sensors for inspection and maintenance systems that require specialized skills, detection of places that need repair can be made at an early stage. By doing so, unexpected accidents will be minimized and the time spent in construction work will be reduced, while at the same time safety and productivity will increase.

চ) অর্থব্যবস্থা : সোসাইটি ৫.০ এ আর্থিক ব্যবস্থাপনা কেমন হতে পারে সেটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে : Use blockchain technology for money transfer Introduce open application programming interfaces (API) to FinTech firms and banks. Promote cashless payment. (সূত্র : https://www.japan.go.jp/ abenomics/_userdata/abenomics/pdf/society_5.0.pdf)

ডিজিটাল বাংলাদেশ ও অন্যান্য ডিজিটাল প্রসঙ্গ : যদি ডিজিটাল শিল্পবিপ্লব ৪.০ বা সমাজ ৫.০ সম্পর্কে মতামত দিতে বলা হয় তবে সবিনয়ে আমরা এটি জানাতে চাই যে ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করে আমরা সারা দুনিয়ার কাছেই একটি সর্বজনীন লক্ষ্য প্রকাশ করেছি। কেউ যদি আমার লেখা ২০০৭ সালের ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা ও তার পরবর্তী নিবন্ধগুলো বা ২০১৮ সালে প্রকাশিত (সর্বশেষ সংস্করণ) ডিজিটাল বাংলাদেশ বইটি পাঠ করেন তবে এটি উপলব্ধি করবেন যে, আমরা আর যাই থাকি না কেন চিন্তার দৈন্যদশায় নেই। বরং আমরা সারা বিশ্বের কাছে ডিজিটাল রূপান্তরের ইশতেহারও ঘোষণা করেছি। ২০০৯ সাল থেকে অব্যাহতভাবে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। ২০১৯ সালে আমরা সারা দুনিয়াকে ডিজিটাল রূপান্তরের স্বরূপ রচনা করে দিচ্ছি। এখন অবস্থাটি এ রকম যে, আমাদের মতো দেশগুলো আমাদের কর্মসূচিকে তাদের মতো সাজিয়ে অনুসরণ করতে পারে। জাপান, ব্রিটেন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা জার্মানি যেমন করে আংশিক ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলছে আমরা তার চাইতে বহু পথ সামনে রয়েছি। একটু বাড়াবাড়ি হলেও আমি বলতে চাই যে, জাপানও ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তাদের পরিকল্পনা মোটেই বাংলাদেশের চাইতে আগানো নয়। বরং আমার মনে হয় ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে আমরা যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ছি জাপানের পঞ্চম সমাজ তার চাইতে এগিয়ে থাকা কিছু নয়।

বিশেষত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, পঞ্চম শিল্পবিপ্লব বা সোসাইটি ৫.০ থেকে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল পার্থক্যটা হলো যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মধ্য দিয়ে আমরা কেবল শিল্পবিপ্লব করতে চাই না, একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত-বৈষম্যহীন উন্নত বাংলাদেশকে তার জন্মের ঠিকানায় স্থাপন করতে চাই। এটি মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশ পাকিস্তান-হিন্দুস্থানের মতো ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নয়, বরং এটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র। সে জন্যই বাংলাদেশকে জন্মের ঠিকানায় স্থাপন করাটা কেবল একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা বা উৎপাদন ব্যবস্থা নয়। সে জন্য এটি কেবল ডিজিটাল প্রযুক্তির বিষয় নয়- অনেক বেশি অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক। উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারতে সাম্প্রদায়িকতার অস্বাভাবিক বিকাশের বিপরীতে ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতিসত্তার অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত। ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি তার জাতিসত্তার বিকাশে কৃষিযুগের পরবর্তী কোনো রূপান্তর করতে পারেনি। খুব সঙ্গত কারণেই এখন সমাজটি গড়ে উঠেছে অনেকটাই প্রাচীন বাংলা কৃষিতান্ত্রিক সামন্তবাদের ওপর ভিত্তি করে। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যেভাবে পুঁজির বিকাশ ঘটেছে, এখানে সেটাও ঘটেনি। বিগত এক দশকে শেখ হাসিনা সরকারের অদম্য প্রচেষ্টায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে; জাতীয় পুঁজির বিকাশ এবং বেসরকারি বিনিয়োগও ঘটেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে এই এক দশক বস্তুত কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের জন্য স্বর্ণযুগ। দারিদ্র্য হ্রাস থেকে শুরু করে সব সূচকেই বাংলাদেশের অগ্রগতি অভাবনীয়। বাংলাদেশের স্বপ্নটাও কিন্তু তেমনি বড়। এই বাংলাদেশ ৪১ সালে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ আর উন্নত বাংলাদেশের পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশের রয়েছে স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তির প্রত্যয় এবং ২১০০ সালের বদ্বীপ পরিকল্পনা। যে বিষয়টি আমার কাছে খুবই জরুরি বিবেচ্য বিষয় বলে মনে হয় সেটি কেবল বস্তুগত সমৃদ্ধি নয়, আমাদের দেশটির জন্মের প্রতিজ্ঞায় স্থাপন করা এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দেশের খুব কম নাগরিকই আমাদের সংবিধানের চার নীতির সব এবং তার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম। ব্রিটিশ ভারতের বাকি দুটো রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বিধায় সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের জন্য তাই একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। বিশ্বটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির একচেটিয়া রূপ ধারণ করায় আমাদের সংবিধানের সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জন বা জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। যখনই দারিদ্র্য হ্রাস বা বৈষম্যহীন সমাজ তথা সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয় তখনই শিল্পোন্নত দেশগুলো কল্যাণ রাষ্ট্রকে উদাহরণ হিসেবে স্থাপন করে। কিন্তু তারা অনুভব করে না যে ডিজিটাল যুগে একচেটিয়া পুঁজিবাদ-চরম বৈষম্য বা চরম দারিদ্র্য টিকিয়ে রাখা যাবে না। এমনকি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবেও পুঁজিবাদের অস্তিত্ব বজায় রাখা কঠিন হবে।

একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বা মেধাশ্রমিকের দেশে মেধার বিচারে সমতা আনতে না পারলে তার অবিশ্বাস্য প্রবৃদ্ধিও চরম হুমকির মুখে পড়বে। সর্বোপরি ডিজিটাল রূপান্তরের যুগে নিজের দেশের মানবসম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারা এবং তাদেরকে কায়িক শ্রমিক থেকে মেধা শ্রমিকে পরিণত করাটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রযুক্তি আমাদের সমগ্র রাষ্ট্র কাঠামোর জন্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। আমাদের সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই টিকতে হবে। কোনো দ্বিধা নেই এ কথা বলতে যে আমরা তাতে জয়ী হবো।

মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App