×

অর্থনীতি

বাড়ছে তারল্য সংকট কমছে আমানত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০১৯, ১১:৪৮ এএম

বাড়ছে তারল্য সংকট কমছে আমানত
অনিয়ম, দুর্নীতি ও নানা অব্যবস্থাপনায় লাগামহীন বাড়ছে খেলাপি ঋণ। প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থও নেই কয়েকটি ব্যাংকের। কমে গেছে অধিকাংশ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ। মূলত চাহিদা অনুযায়ী আমানত সংগ্রহ করতে না পারায় বেশিরভাগ ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে তারল্য সংকট রয়েছে অনেক ব্যাংকে। ধারাবাহিকভাবে কমছে ঋণ প্রবৃদ্ধি। আমানত ও ঋণের সুদহারেও নেই শৃঙ্খলা, অস্থির ডলারের বাজারও। ফলে নানামুখী সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। সংকট মোকাবেলায় অনেক ব্যাংক ১০ শতাংশের বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করতে চাইছে। কিন্তু সাড়া মিলছে না গ্রাহকদের। ফলে, ব্যাংকের সুদের হার ১৬-১৭ শতাংশে পৌঁছে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও চাহিদামতো ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ করতে না পারায় ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে দেখা দিয়েছে মূলধন ঘাটতিও। এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধনের ঘাটতি মেটাতে সরকার প্রায় ১২ বছর একটানা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করে আসছে। তবে এক যুগ পর এবারই প্রথম মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারি ব্যাংকগুলো কোনো অর্থ পেল না। ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকারের কাছে ১৯ হাজার কোটি টাকা চেয়েছিল। কিন্তু প্রকট মূলধন ঘাটতিতে থাকা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে সদ্য গত বাজেট থেকে এক টাকাও দেয়নি সরকার। সম্প্রতি শেষ হওয়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট থেকে দুটি ব্যাংকের জন্য মাত্র ১৫১ কোটি ১২ লাখ টাকা ছাড় করা হয়েছে। তবে এ অর্থ মূলধন ঘাটতি পূরণে দেয়া হয়নি। দেয়া হয়েছে ভর্তুকি হিসেবে এবং একটি ব্যাংকের সরকারি অংশের শেয়ার টিকিয়ে রাখার জন্য। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির মূল কারণ দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। এ ঘাটতি মেটানোর জন্য জনগণের করের টাকায় প্রতিবছর ব্যাংকগুলোকে শত শত কোটি টাকা দেয়া হয়। অর্থ দেয়ার পরও এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে জনতা ও বেসিক ব্যাংকের অবস্থা আগের চেয়ে আরো খারাপ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এ ব্যাংকগুলোকে আদৌ অর্থ দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তাই এবার তাদের কোনো অর্থ দেয়া হয়নি। জানা গেছে, দুই বছর আগেও ব্যাংকগুলোর কাছে অলস অর্থ ছিল দেড় লাখ কোটি টাকা। এখন তা নেমে এসেছে ৬৩ হাজার কোটি টাকায়- সেগুলো আবার বিভিন্ন বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ হিসেবে রয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে দেয়ার মতো নগদ অর্থ নেই অধিকাংশ ব্যাংকের হাতে। শিল্প ও বাণিজ্য খাতে ঋণের চাহিদা বাড়ছে; কিন্তু অর্থ দিতে পারছে না ব্যাংক। এ সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় আমানত বাড়ানো। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী আমানত সংগ্রহ করতে না পারায় বেশিরভাগ ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট মোকাবেলায় অনেক ব্যাংক ১০ শতাংশের বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করতে চাইলেও গ্রাহকদের সাড়া মিলছে না। প্রায় সব ব্যাংকই এখন নতুন নতুন স্কিম চালু করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চে ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২৩ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। আগের বছরের মার্চে যা ছিল ৯ লাখ ২৫ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে মাত্র ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অথচ বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। আমানত সংগ্রহ তুলনামূলক কম হওয়ায় ব্যাংকের তারল্য ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ কমে গেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে তরল সম্পদ (লিকুইড অ্যাসেট) দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। গত বছরের মার্চে যা ছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। এক বছরে তারল্য কমেছে ১৬ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। ব্যাংকিং পদ্ধতি অনুসারে, ঋণের টাকা নগদ হিসেবে গ্রাহকের হাতে তুলে দেয়া হয় না। অ্যাকাউন্টে প্রদান করা হয়। অর্থাৎ যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়, ওই পরিমাণ অর্থ আমানত হিসেবে যোগ হয়। আবার ব্যাংকগুলো নতুন নতুন গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে। ফলে স্বাভাবিকভাবে ঋণের তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি বেশি থাকার কথা। কিন্তু এখন উল্টো ঘটছে। ঋণের তুলনায় আমানত কম বাড়ছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে নতুন আমানত সংগ্রহ আনতে পারছে না। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে গেছে। ফলে আমানত রাখতে ভয় পাচ্ছে। এতে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধিও প্রতি মাসে কমছে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ও ব্যাংকের সুদে পার্থক্য এবং নানা কেলেঙ্কারির কারণে ডিপোজিট (আমানত) কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় উপায় হচ্ছে, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ উদ্ধার করা। এতে মানুষের আস্থা ফিরবে এবং আমানত সংগ্রহ বাড়বে। তা না করতে পারলে কোনো লাভ হবে না। সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা আরো বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়তো সম্ভব হবে না। তবে বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রির যে লক্ষ্যমাত্রা থাকে, তা পূরণ হলে বিক্রি বন্ধ করে দিতে হবে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত জনসাধারণ ৬৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। অন্যদিকে এই সময়ে ব্যাংক জমা রেখেছেন ৫৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখার পরিমাণ ১৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো আমানতের তুলনায় বেশি ঋণ দিয়ে তা আদায় করতে পারছে না। এতে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। তারল্য সংকটের কথা স্বীকার করে নেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট রয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকের টাকা আটকে গেছে। খেলাপি ঋণ উদ্ধার না হওয়া একটা বড় সমস্যা। এবিবি চেয়ারম্যান আরো বলেন, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আমানতের ওপর নির্ভরশীল। এটার পাশাপাশি বন্ড মার্কেট, ক্যাপিটাল মার্কেটও দরকার। এ ছাড়াও স্থানীয় মুদ্রা দিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে। এসব কারণে নানা ঝামেলা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App