×

মুক্তচিন্তা

ফেরার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০১৯, ০৯:৪৬ পিএম

যে বাংলাদেশ ছিল নৈতিকতার দেশ, ছিল সামাজিক সংহতি আর মূল্যবোধের তার পেছনে শুধুমাত্র ধর্মচর্চা ছিল না। ছিল সংস্কৃতি আর মানুষের বিশ্বাস। সেটাই আজ নেই। তাই পিতা, সন্তান, মা বা শিক্ষক কেউই কারো কাছে নিরাপদ না। এ পরিবেশ যদি না বদলায় আপনি উন্নয়ন টেকাতে পারবেন না। দেশের ভেতরেও মানুষ অনিরাপদ। আবার গরিব বা পিছিয়ে পড়া দেশেও মানুষ আছে আনন্দে, শান্তিতে। কোনটা আমরা চাই?

কোথাও কিছু মারাত্মক ধরনের ভুল হচ্ছে। তা না হলে আমাদের যে সমাজ বা দেশ তাতে এমন সব ঘটনা নিয়মিত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল না। কী কী নিয়মমাফিক হচ্ছে? হত্যা, ধর্ষণ, অরাজকতার পাশাপাশি এখন আমরা দেখছি গুরু-শিষ্যের যে মধুর সম্পর্ক সেটাও পড়েছে তোপের মুখে। আমরা সে দেশের মানুষ যে দেশে আমেরিকান কায়দায় শিক্ষককে নাম ধরে ডাকা হয় না। ভিক্টোরিয়া যুগের আদলে স্যার-ম্যাম ডাকি আমরা। তার আগেও যখন টোল ছিল তখন আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন গুরু। এই গুরু কিন্তু পিতার চাইতেও বড়। যারা আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াতেন তাদের আমরা কখনো পায়ে ধরা ছাড়া প্রণাম বা সালাম করিনি। মনে আছে আমাদের হাইস্কুলের একজন শিক্ষক মাঝে মাঝে ছাত্রদের বাড়িতে যেতে চাইতেন। যাদের বাড়ি কাছে সেখানে গিয়ে রেডিওতে ক্রিকেট ভাষ্য শুনবেন বলে। তখন আকাশবাণী বা বাংলাদেশ বেতার ছাড়া আর কোনো মাধ্যম ছিল না। ওই শিক্ষককে নিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা ছিল দেখার মতো। শুধু কি তাই? তিনি যাবেন বলে আমাদের মায়েরাও কত আদর যত্ন আর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করতেন। ইংরেজির সেই শিক্ষককে আমরা ভয় পেলেও পিতার চেয়ে বেশি সম্মান করতাম। তিনি আমাদের মায়েদের ডাকতেন মা-জননী বলে। এমন দেশে এমন সমাজে স্বাধীন বাঙালির সে সম্পর্ক এখন সুতোর ওপর ঝুলছে। অভিযোগগুলো কিন্তু গুরুতর। বিশেষত সবকিছু ছাপিয়ে সন্দেহ আর অভিযোগের কারণ শরীর। মা-বোন-ভগ্নি-কন্যা কাউকে ছাড় না দেয়ার এই প্রবণতা কেন এমনভাবে নেগেটিভ প্রভাব বিস্তার করল? বিশেষত শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের বিষয়ে এ ধরনের অভিযোগ পাপ বা গুনাহ মানার পরও সমাজে আজ এর ছড়াছড়ি। ছাত্রীরা বলছে তারা আতঙ্কিত। তাদের ভাষায় কু প্রস্তাবে রাজি না হলে ভালো মার্কস মেলে না। কেউ বলছেন শিক্ষকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না হলে আরাধ্য ফলাফল অসম্ভব। অন্যদিকে ছাত্রদের বেলায় দেখছি উত্তেজনা আর হাত তোলার প্রবণতা। এখন তো এমন এক সময় এসে গেছে যখন কেউ কারো কাছে নিরাপদ নয়। এখন এগুলো এড়িয়ে বা চোখ বুজে থাকার সময় নেই। সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি কিন্তু ক্রমেই হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন এই দেশে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। এখন এগুলোর অনেকগুলো সংবাদ হওয়ার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। ভয়াবহতা এমন, একবার যদি তা দানা বাঁধে আর ঘটতে থাকে তখন চরমে না যাওয়া পর্যন্ত আপনি আর চমকাবেন না। এটাই কি আমরা চাই? মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র এক নৈরাজ্য। এক ধরনের উত্তেজনা। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের মফস্বলের এক মাস্টার আমাকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন একটি বিষয় নিয়ে লিখতে। গল্পটা জানার পর অপমান আর নৈরাশ্যে আমি ক’দিন স্তব্ধ ছিলাম। কিন্তু লিখতে পারিনি। নাইন-টেনের ছাত্রছাত্রীদের হাতে হাতে যে মোবাইল সেখানে তারা কী দেখে, কেন দেখে তার খবর কি কেউ রাখেন? অভিভাবকরা চোখ বন্ধ রাখলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকবে? যৌনতা কোনো পাপ না। কিন্তু তার সঠিক ব্যবহার বয়স বিবেচনায় কতটা যেতে পারবে, কতটা পারবে না সেগুলোই হলো বিবেচনার। সে বোধ এখন লুপ্ত। কারণ যারা অভিভাবক তারাও সবসময় কোনো না কোনোভাবে এসবের উসকানিদাতা, নয়তো শিকার। ঘরে ঘরে সম্পর্ক নষ্ট আর পরিবারে বন্ধন শিথিল হওয়ার এ আরেক মস্ত কারণ। কাজেই ছাত্রছাত্রীদের যেমন একতরফা দোষারোপ করে পার পাওয়া যাবে না তেমনি শিক্ষকরাও এখন আর ধোয়া তুলসীপাতা নয়। এটাই এ সময়ের বড় জিজ্ঞাসা কবে কখন কীভাবে এমন বৈরী বাতাস আমাদের সমাজে ঢুকলো? আর যা এখন ঠেকানোও প্রায় দুঃসাধ্য। তাই এখানে সমাজ, রাজনীতি ও মানুষ এই তিনের সমন্বয় দরকার। কাকে বলে সামাজিক ন্যায়? আসুন আমরা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের কথাটা পড়ে দেখি : The ultimate measure of a man is not where he stands in moments of comfort and convenience, but where he stands at times of challenge and controversy. তিনি বলছেন মানুষের পরিমাপ স্বস্তি ও সহনীয় সময়ে কোথায় তার অবস্থান তা দিয়ে হয় না। হয়, কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে সে মানুষটি কোথায় দাঁড়িয়ে তা দিয়ে। এবার নিজেদের দিয়ে বিবেচনা করলে কী পাই আমরা? এমন কঠিন সামাজিক বাস্তবতায় রাজনীতির কোনো বিকার আছে? কোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের কোনো উদ্যোগ? আছে কোনো প্রতিকার? শুধু আইন আর বাহিনী দিয়ে কোনোকালে সমাজ সমস্যার সমাধান হয়নি। হবেও না। যে বাংলাদেশ ছিল নৈতিকতার দেশ, ছিল সামাজিক সংহতি আর মূল্যবোধের তার পেছনে শুধুমাত্র ধর্মচর্চা ছিল না। ছিল সংস্কৃতি আর মানুষের বিশ্বাস। সেটাই আজ নেই। তাই পিতা, সন্তান, মা বা শিক্ষক কেউই কারো কাছে নিরাপদ না। এ পরিবেশ যদি না বদলায় আপনি উন্নয়ন টেকাতে পারবেন না। দেশের ভেতরেও মানুষ অনিরাপদ। আবার গরিব বা পিছিয়ে পড়া দেশেও মানুষ আছে আনন্দে, শান্তিতে। কোনটা আমরা চাই? আপদ-বিপদ ঘাড়ে নিয়ে বড়লোক হতে, না শান্তি নিয়ে সামনে এগুতে? এর উত্তর যারা দিতে পারবেন তাদের কাছে আছে বড় সমাধান। আর ছোট সমাধানগুলো পরিবারে। পরিবারে নিয়মশৃঙ্খলা ও আনন্দ ফিরলে সমাজেও তা ফিরে আসতে বাধ্য।

অজয় দাশগুপ্ত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App