×

পুরনো খবর

সাড়ে ৩ বছরেও শেষ হয়নি ৫৬ মামলার তদন্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০১৯, ০১:৫৭ পিএম

সাড়ে ৩ বছরেও শেষ হয়নি ৫৬ মামলার তদন্ত
প্রায় চার বছর হতে চললেও বেসিক ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের করা ৫৬ মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ফলে একটি মামলারও চার্জশিট দেয়া সম্ভব হয়নি। শিগগিরই তদন্ত শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই বলে জানা গেছে। যদিও স্বাধীন সংস্থাটির আইনে যে কোনো মামলার তদন্ত ৬ মাসের (১৮০) মধ্যে শেষ করার বিধান রয়েছে। এ নিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন উচ্চ আদালত। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহের পাশাপাশি কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও একাগ্রতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণের অভিযোগ ওঠে। এরপরই অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধান শেষে ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় ১২০ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় বেসিক ব্যাংকের ২৭ কর্মকর্তা, ১১ জরিপকারী ও ৮২ ঋণগ্রহণকারী ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। বেসিক ব্যাংক দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। এর মধ্যে রয়েছেন ৮ জন ব্যবসায়ী, একজন সার্ভেয়ার ও ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের পাঁচ জন কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তাদের সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এখন কারাগারের বাইরে। এ ছাড়া আসামিদের মধ্যে অনেকেই দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মামলার কয়েকজন আসামির জামিন প্রশ্নে রুল শুনানিকালে উচ্চ আদালত গত বছরের ৩০ মে এসব মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের ও দুদক আইনজীবীর বক্তব্য শুনে হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বলেছেন, আপনাদের কথা শুনে লজ্জায় কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলতে ইচ্ছে করছে। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের বক্তব্যের মধ্যেই আদালত তাকে বলেন, চার্জশিট দিচ্ছেন না কেন? এ ধরনের মামলায় আড়াই বছর লেগে গেল? তাহলে কেমনে হবে? উচ্চ আদালতের এই ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশের এক বছর পার হলেও তাতেও কোনো কাজ হয়নি। টনক নড়েনি সংশ্লিষ্টদের। আসামিদের সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যোগসাজশ প্রসঙ্গে তখন বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম বলেন, আপনাদের নির্লিপ্ততার কারণে যেসব আসামি ভেতরে আছে তারাও বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে আপনাদের সখ্য আছে বলে মনে হচ্ছে। চার্জশিট দিতে দেরি করছেন, যাতে আসামিরা জামিন পেয়ে যায়। আমরাও তাদের জামিন দিতে বাধ্য হচ্ছি। গত বছর জুলাই মাসে ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখতে হাইকোর্ট দুদককে নির্দেশনা দেন। এরপর বাচ্চুকে পাঁচবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। সেই সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কেউই গ্রেপ্তার হননি। বরং তারা বুক ফুলিয়ে চলাফেরার পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানেও অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকছেন। জানা গেছে, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সময় শেখ আবদুল হাই বাচ্চু দুই মেয়াদে চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকলেও তাকে কোনো মামলায় আসামি করা হয়নি। শুধু তাই নয়, ওই সময়কার পর্ষদ সদস্যদের কারও নামই আসামির তালিকায় নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ প্রস্তাব ত্রু টিপূর্ণ থাকায় ওই ৫৬ মামলা করা হয়। ওই সময়ের পর্ষদ সভায় খুব সহজেই প্রস্তাবগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এর দায় তারা এড়াতে পারেন না। জানা গেছে, পর্ষদের ১৩ সদস্যের মধ্যে সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। এর আগে পর্ষদের সদস্য সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার, সাবেক বাণিজ্য সচিব শুভাশীষ বোস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক নিলুফার আহমেদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও অর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কামরুন্নাহার আহমেদ, প্রফেসর ড. কাজী আখতার হোসেন, ফখরুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, জাহাঙ্গীর আকন্দ সেলিম, এ কে এম কামরুল ইসলাম, আনোয়ারুল ইসলাম (এফসিএমএ), আনিস আহমেদ এবং এ কে এম রেজাউর রহমানকে জ্ঞিাসাবাদ করা হয়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পর্ষদের ওইসব সদস্যই বেসিক ব্যাংকের তদন্তে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আত্মসাৎ করা টাকার প্রতিটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ওই সময়ের পর্ষদ। এ কারণে অর্থ আত্মসাতের পেছনে সে সময়ের প্রতিটি সদস্যের দায় রয়েছে। চার্জশিটে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেই আদালতে চার্জশিট দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। এখন তদন্ত শেষ না হওয়ার দোহাই দিয়ে চার্জশিট দেয়া হচ্ছে না। দুদকের একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেছেন, বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন পরিচালকদের মধ্যে বেশিরভাগই এখন বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের উচ্চপর্যায়ে রয়েছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করাও এখন দুদকের জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুদকের তদন্ত থেকে জানা গেছে, ঋণ প্রস্তাবগুলো ছিল ত্রু টিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) ছাড়পত্র না নেয়া, জামানতের মূল্য যাচাই না করা, ঋণ গ্রহীতার ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ও ঋণের টাকা ফেরত দেয়ার সক্ষমতা মূল্যায়ন করা হয়নি। অধিকাংশ ঋণ গ্রহীতার কোনো ধরনের ব্যবসা ছিল না। কারও ক্ষুদ্র ব্যবসার অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও ব্যাংক থেকে নেয়া কোটি কোটি টাকার ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা ছিল না। ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ঋণ প্রস্তাবগুলোতে ওইসব তথ্য উল্লেখ করা হলেও পর্ষদ সভায় অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক দুদক কর্মকর্তা বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ত্রু টিপূর্ণ ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন দিয়ে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের দায় পর্ষদ সদস্যদেরও নিতে হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধ করে কেউ পার পেতে পারে না। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি মামলার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, ৫৬ মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। আরো সময় লাগবে। তদন্ত শেষ হলে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে মামলাগুলোর তদন্ত কবে শেষ হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি। এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের দায়ের করা মামলার অভিযোগপত্র সাড়ে তিন বছরেও দিতে না পারাটা অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক। এটা দুদকের প্রতি মানুষের আস্থার সঙ্কটকে আরো ঘনীভ‚ত করবে। তিনি তদন্ত কর্মকর্তাদের পেশাগত ব্যর্থতার বিড়ম্বনা, দক্ষতার ঘাটতি, সদিচ্ছার অভাব ও সৎ সাহসিকতার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, দুদক কারো চেহারা দেখে তদন্ত করবে না। দুদক একটি শক্তিশালী স্বাধীন সংস্থা। আইনেই তাদের সেই ক্ষমতা দেয়া আছে। তাদের সেই সৎ সাহসিকতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন, ব্যাংকিং খাতে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে এই খাতে অপরিহার্যতা ফেরাতে হলে এই মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলার আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দুদক সেই প্রমাণ রাখতে পারে। এ বিষয়ে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, ৬ মাসের জায়গায় সাড়ে তিন বছরেও চার্জশিট দিতে না পারাটা খুবই হতাশার। তদন্তের জটিলতার কারণে যদি কিছুটা সময় লাগে, তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এসব মামলার আসামির মধ্যে তো অনেক ক্ষমতাবানরা রয়েছেন। যদি তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের কারণে সময়ক্ষেপণ হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে দুদক তার সঠিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা ফেরাতে মামলাগুলোর দ্রæত চার্জশিট দিয়ে বিচার ত্বরান্বিত করা দুদকের দায়িত্ব। আশা করি প্রতিষ্ঠানটি তাদের সেই দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App