×

মুক্তচিন্তা

রাহুল গান্ধী আর কংগ্রেসের সভাপতি নন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০১৯, ০৮:৩৭ পিএম

মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যেও আছে নতুনত্ব। ধর্ম এখন সব দেশেই রাজনীতিতে একটি নিয়ামক ভূমিকায় পরিণত হচ্ছে। আকাশ কুসুম চয়নের চেয়ে বাস্তবের জমিনটা ঠিকমতো বুঝতে পারার মনমানসিকতা যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের না থাকে তাহলে মানুষের কাছে তারা ফিকে হয়েই পড়বেন। পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে না পারলে কংগ্রেস কেবল ঐতিহ্যের অহঙ্কার নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে পারবে বলে মনে হয় না।

ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কি নেতৃত্ব সংকটে পড়ল? নাকি নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে কংগ্রেস সময়ের প্রয়োজন মেটানোর সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে আবার ঐতিহ্যের ধারায় ফিরে আসবে? কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে রাহুল গান্ধীর সরে দাঁড়ানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর পর এসব প্রশ্ন আলোচনায় আসছে। রাহুল গত ২৫ জুন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় দলের সভাপতি পদ ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন। এরপর শুরু হয় তাকে পদে রাখার অনুরোধ-উপরোধ। নির্বাচনে দলের বিপর্যয়ের দায় মাথায় নিয়ে রাহুল পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

প্রথমে ভাবা হয়েছিল, এটা তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। সবাই মিলে তাকে দলের সভাপতি পদে থাকার অনুরোধ করলে তিনি হয়তো তার সিদ্ধান্ত বদল করবেন।

কিন্তু না, রাহুল তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। গত ৩ জুলাই তিনি এক চিঠির মাধ্যমে তার সভাপতি না থাকার কথা সাফ জানিয়ে দিয়ে দলের নতুন নেতা নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। রাহুল কংগ্রেসের সভাপতি পদে না থাকলেও রাজনীতিতে থাকবেন। তিনি বলেছেন, এখন কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে কাজ করবেন। তিনি একজন সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবেন। সভাপতি হিসেবে তাকে যেসব ধরাবাঁধা কাজ করতে হতো এখন তার বাইরে এসে দলের জন্য কাজ করতে পারবেন। কেউ কেউ মনে করছেন, এটা রাহুলের সাময়িক বিরতি। নিজেকে আরো উপযুক্ত হিসেবে তৈরি করে তিনি আবার দলের হাল ধরবেন।

রাহুল কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করলেন সাকল্যে বছর দেড়েকের মতো। তিনি বয়সে তুলনামূলক নবীন। অবসরে যাওয়ার বয়স তার হয়নি। কিন্তু দলীয় প্রধান হিসেবে তিনি দলকে নির্বাচনী বিজয়ের সাফল্য উপহার দিতে না পারায় তিনি নেতৃত্ব ছাড়ছেন। দলের নতুন সভাপতি নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে রাহুল বলছেন, ‘আমাদের দলের একটি সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে। সেটাকে আমি গভীর শ্রদ্ধা করি। কংগ্রেস দেশের বুননের সঙ্গে মিশে গেছে। আমি মনে করি সঠিক নেতাই নির্বাচন করবেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।’

রাহুল আরো বলেছেন, ‘ক্ষমতাবানরা ক্ষমতার সঙ্গে থাকেন, ভারতে এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কেউই ক্ষমতা ত্যাগ করেন না। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সা ত্যাগ করতে না পারলে আর গভীর আদর্শবাদী লড়াই করতে না পারলে আমরা আমাদের বিরোধী পক্ষকে হারাতে পারব না।’

ভারতের ক্ষমতার রাজনীতিতে বহু বছর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম ছিল কংগ্রেসের। ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর কংগ্রেস দলের প্রতিষ্ঠা। প্রথম সভাপতি ছিলেন উমেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বিভিন্ন সময় এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহরু, জহরলাল নেহরু, সুভাষ বসু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, ইন্দিরা গান্ধীর মতো বিখ্যাত সব ব্যক্তি। কংগ্রেসের নেতৃত্বেই ভারত স্বাধীন হয়। তারপর একটানা বহু বছর শাসন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস।

তবে এখন অবস্থা বদলেছে। কংগ্রেস এখন আর ভারতের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় নিয়ামক রাজনৈতিক শক্তি নয়। কংগ্রেসের অসাম্প্রদায়িক-ধর্মভিত্তিক রাজনীতির জায়গা এখন সাম্প্রদায়িক-ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি বিজেপির দখলে। গত মাত্র কয়েক বছরে ভারতজুড়ে বিজেপির বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে। বিজেপি যদি হয় উদীয়মান শক্তি তাহলে কংগ্রেস হলো অস্তাচলগামী।

রাহুল গান্ধীর মতো তরুণ নেতৃত্বের হাত ধরে কংগ্রেসের পুনরুত্থানের যে আশা করা হয়েছিল বাস্তবে তা না হওয়ায় কংগ্রেস মহলে এক ধরনের স্বাভাবিক হতাশা তৈরি হয়েছে। দলের নির্বাচনী ফলাফল ভালো না হওয়ার দায় রাহুল নিজের কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করলেও তিনি মনে করেন দলের আরো কিছু শীর্ষ নেতারও পদত্যাগ করা উচিত ছিল। তিনি পদত্যাগ করলেও অন্য আরো কিছু নেতা কেন ইস্তফা দিলেন না, তা নিয়ে ঘনিষ্ঠদের কাছে রাহুল আক্ষেপ করেছেন বলেও ভারতীয় মিডিয়ায় খবর এসেছে।

রাহুল বলেছেন, ‘সভাপতি হিসেবে ভোটের হারের দায় আমার। দলের বৃদ্ধির জন্য দায়বদ্ধতা জরুরি। তাই আমি পদত্যাগ করছি। দলকে নতুন করে তৈরি করা কঠিন সিদ্ধান্ত এবং ভোটের হারের জন্য অনেককে দায়বদ্ধ করা উচিত। কিন্তু নিজের দায়িত্ব উপেক্ষা করে অন্যদের দায়ী করা ঠিক নয়।’ তিনি তার কাজে দলের সবার কাছ থেকে সমান সহযোগিতা পাননি বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, মোদি-আরএসএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কেউ তার পাশে এসে দাঁড়াননি। তাকে একাই লড়তে হয়েছে।

রাহুলের পর কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে তার বোন প্রিয়াঙ্কার নাম আলোচনায় থাকলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। এবার ‘গান্ধী’ বাদ দিয়েই কংগ্রেস নেতৃত্ব নির্বাচিত করতে হবে। সোনিয়া-রাহুল-প্রিয়াঙ্কা এই পরম্পরা এবার ভাঙবে। তবে অনেকেই মনে করেন গান্ধী পরিবারের ছায়া এড়িয়ে কংগ্রেসের এগিয়ে যাওয়া কার্যত অসম্ভব। রাহুলের মা সোনিয়া গান্ধী টানা দুই দশক কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করায় এবং তারপর তার ছেলে রাহুলের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হওয়ায় এটা মনে হয়েছে যে, কংগ্রেস বুঝি একটি বিশেষ পরিবারের প্রভাব থেকে বের হতে পারবে না। জহরলাল নেহরু, তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী, তার পুত্র রাজীব গান্ধী, তার স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী, তার পুত্র রাহুল- এই তালিকা দেখলে কারো মনে হতেই পারে যে, দলটি এক পরিবারের হাতে বন্দি! কিন্তু ১৯৬০ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত টানা সময় কংগ্রেসের নেতৃত্ব গান্ধী পরিবারের বাইরে ছিল। নীলম সঞ্জীব রেড্ডি, কামরাজ, এস নিজলিন গাপ্পা, জগজীবন রাম, ড. শঙ্কর দয়াল শর্মা, দেবকান্ত বড়ুয়া ওই সময়ে কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন প্রথমে ১৯৫৯ সালে, পিতা জহরলাল নেহরুর জীবদ্দশায়। তারপর ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪, মৃত্যুর সময় পর্যন্ত। ইন্দিরা-পুত্র রাজীব গান্ধী ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন পি ভি নরসীমা রাও। তারপর এক বছর সভাপতি ছিলেন সীতারাম কেশরী। ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সোনিয়া-কাল।

কংগ্রেসের নেতৃত্ব গান্ধী পরিবারের বাইরে একাধিকবারই গিয়েছে এবং তাতে দল বড় ধরনের কোনো সংকটেও পড়েনি। এবার কী হয়, দেখার বিষয় সেটি। কংগ্রেসের নতুন সভাপতির দায়িত্ব কে পাবেন, সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে দুটি নাম আলোচনায় আছে। এরা হলেন মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সুনীল কুমার সিন্ধে এবং কর্নাটকের বর্ষীয়ান নেতা মল্লিকার্জুন খড়েগ। এরা বয়সে প্রবীণ। প্রথম জনের বয়স ৭৭ এবং দ্বিতীয় জনের ৭৬। তারা রাজনীতি এবং প্রশাসনিক কাজে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ। কিন্তু কংগ্রেসের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি যেখানে নেতৃত্ব নির্বাচনে ষাটের ঘরের মধ্যে থাকতে চাইছে, সেখানে কংগ্রসের চয়েজ যদি সত্তরোর্ধ্ব হয়, তাহলে সেটা ‘বুড়ো’দের দল বলে প্রচার পেতে পারে। প্রাচীন দল, প্রবীণ নেতৃত্ব- তাতে যদি নবীনের প্রাণ প্রবাহ যুক্ত না হয় তাহলে রাজনীতির কঠিন পথে চলা কতটুকু সহজ হবে সে প্রশ্ন আছে।

ভারতের রাজনীতি এখন এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহর নেতৃত্বে বিজেপি ভারতকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাতে চায় সেটা যেমন দেখার বিষয়, তেমনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী কংগ্রেস দলটিইবা কোন কৌশলে অগ্রসর হয় তাও মানুষের পর্যবেক্ষণে থাকবে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ বলে পরিচিত ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস এখন আর নিয়ন্ত্রক শক্তি নয়। পুনর্গঠন ও নবায়নের মাধ্যমে কংগ্রেসকে মানুষের মনের ভাষা বোঝার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। রাজনীতিও আর প্রচলিত ধারায় অগ্রসর হচ্ছে না। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যেও আছে নতুনত্ব। ধর্ম এখন সব দেশেই রাজনীতিতে একটি নিয়ামক ভূমিকায় পরিণত হচ্ছে। আকাশ কুসুম চয়নের চেয়ে বাস্তবের জমিনটা ঠিকমতো বুঝতে পারার মনমানসিকতা যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের না থাকে তাহলে মানুষের কাছে তারা ফিকে হয়েই পড়বেন। পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নীতি-কৌশল গ্রহণ করতে না পারলে কংগ্রেস কেবল ঐতিহ্যের অহঙ্কার নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে পারবে বলে মনে হয় না।

বিভুরঞ্জন সরকার: যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App