×

সাময়িকী

সময়ের ক্যানভাসে জীবনের প্রচ্ছদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০১৯, ০৭:২৬ পিএম

সময়ের ক্যানভাসে জীবনের প্রচ্ছদ

তাঁর গল্প ও উপন্যাস সমসাময়িক মুসলিম সমাজের অন্তরঙ্গ উদভাসন। প্রথম উপন্যাস চৌচির, গল্পগুচ্ছ ‘মাটির পৃথিবী’ এবং ‘বিচিত্র কথা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পাঠালে কবি আবুল ফজলকে প্রশংসা করে একটি দীর্ঘ চিঠি দেন।

বিগত শতাব্দীর এক দীর্ঘ সময় আমাদের দেশে মানবমুক্তি ও মানসমুক্তির সংগ্রামে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন মনীষী আবুল ফজল। তাঁর সৃষ্টির সব শাখাতেই এ বোধ ব্যাপ্ত ও বিস্তৃত হয়েছে যে, তাঁকে সমকালীনতার রেখাচিত্র ছাড়া অন্য কোনোভাবে বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-সাহিত্যের এ সব সৃজনসম্ভারে তাঁর ভূমিকা কেবলি সমকালের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে এবং তা মানব ও মানবতার কর্মযজ্ঞকে ক্রমেই প্রভাবিত করতে থাকবে। সময় ও সমাজের অসংগতি, কপটতা, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতাকে তিনি আক্রমণ করেছেন তীব্রভাবে, শিল্পগুণের তোয়াক্কা না করেই। দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা মৌলভী ফজলুর রহমান ছিলেন বিখ্যাত আলেম। চট্টগ্রাম জামে মসজিদের পেশ ইমাম। মা গুলশান আরা দক্ষিণ পটিয়ার হাশিমপুর গ্রামের জান আলী মুন্সির মেয়ে, মাতামহের পরিবার ছিল প্রভাবশালী। কৈশোরেই বাবার সাথে চট্টগ্রামে এসে প্রথমে প্রাইমারি স্কুলে, পরে নিউ স্কিম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। কিশোর বয়সেই তিনি জায়গির থেকে লেখাপড়া করেছেন। পিতার শাসনে সরাসরি না থাকার কারণে সেই সময়ে চট্টগ্রামে নানা সভা-সমিতি, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্মেলন, শিক্ষা-সামাজিক সম্মেলনগুলেতে যেতেন। তখন চট্টগ্রাম ছিল অগ্নিগর্ভ। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড, যুগান্তর ও অনুশীলন বিপ্লবীদের তৎপরতা, অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন চট্টগ্রামকে তীব্রভাবে আলোড়িত করেছে। আবুল ফজলের প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাসে এসব বিষয় নানাভাবে এসেছে। চট্টগ্রামের ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে বিএ, পরে বিটি এবং বেশ কয়েক বছর পর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে বাংলায় এমএ পাস করেন। শিক্ষকতা করেন সীতাকুণ্ড নিউস্কিম মাদ্রাসা, খুলনা জিলা স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ও কৃষ্ণনগর কলেজে। ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৫৯ সালে ঐ কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন, তাঁর শিক্ষকতা জীবন প্রায় ৩০ বছরের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি জড়িয়ে পড়েন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন ও প্রথাবিরোধী নানা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে। এই সময় জাতীয়তাবাদী জোয়ার বাংলার জাগৃতিতে প্রবল আলোড়ন তুলে এবং বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এর আঘাতে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। তবে এই রেনেসাঁর সীমাবদ্ধতা বুঝা যায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিভক্তি ও প্রবল বৈরিতার ফলাফলে। জাগৃতির এই ধারায় মুসলিম তরুণদের মধ্যেও আলোড়ন এবং চিন্তার ক্ষেত্রে নানা অভিঘাত আসে। আলোড়নকে প্রথাবিরোধী প্রবল ধারায় নিয়ে আসেন বেগম রোকেয়া। এরপরই কাজী নজরুল ইসলাম প্রবল উন্মাদনা নিয়ে তরুণ মানসে ঝড় তোলেন। ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি ১৯১৭ সালের রাশিয়ায়- সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এ সময় বাংলায় প্রভাব ফেলতে শুরু করে। সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতির এই আলোড়নকে চিন্তা ও চেতনায় সংগঠিত রূপ দিতে ১৯২৬ সালে ঢাকায় গঠিত হয়, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। আবুল হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, আনওয়ারুল কাদির, আবদুল হক, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবদুল কাদির, কাজী মোতাহের হোসেন, আবুল ফজলের উদ্যোক্তা। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ছিল ‘শিখা’-এর ৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এর লেখালেখিতে ছিল পরিবর্তনের অগ্নিশলাকা। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সদস্যদের তৎকালীন মুসলিম লীগের রাজনীতিক ও সামন্ত প্রভুদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। মুসলিম সাহিত্য সমাজের ভূমিকা ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর সঙ্গে তুলনীয়। তবে ইয়ং বেঙ্গলের আন্দোলন প্রধানত ছিল ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার নিয়ে, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ সংস্কারের বাইরেও সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিবর্তনের সূত্রগুলো ধরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল, এর ধারা আমরা বুঝতে পারবো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববাংলার স্বাধিকার-জাতীয়তা ও গণতন্ত্রের আন্দোলনের বিকাশের মধ্যে। পূর্ব বাংলার যে মানুষ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলো, তার কয়েক বছরের মধ্যেই সেই ‘রাষ্ট্র’ ধারণার বিরুদ্ধে তারা দাঁড়িয়ে গেল। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি অসাধারণ ঘটনা। পূর্ব বাংলার রাজনীতি সমাজ ও সাংস্কৃতিক জাগরণের এই কালপর্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন আবুল ফজল। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সদস্যদের ভূমিকা তখন সক্রিয় না থাকলেও আবুল ফজল পূর্ববাংলার জাগৃতির এই অধ্যায়ে তাঁর সাহিত্যকর্মে বিশেষত প্রবন্ধে, আলোচনায়, সাংগঠনিক কাজে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি, জাতীয়তা, গণতন্ত্র, সেক্যুলার বিশ্বাস- এসব বিষয়কে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত করেন। পাকিস্তানি ভাবাদর্শে সাহিত্যিক ঐতিহ্য সৃষ্টির যে ধারাটি শুরু হয়েছিল, তাতে প্রবল আঘাত হানেন তিনি এবং সাহিত্যে-শিল্পে-জীবনে ‘স্বস্তির’ ধারণাটি পাল্টে দেন। তাঁর পাকিস্তানের ভাবাদর্শ বিরোধী বেশ কিছু লেখা ‘সমকালে’ প্রকাশিত হলে পাকিস্তান সরকার পত্রিকার কয়েক সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উত্তেজনার বিরুদ্ধে লেখক-সংস্কৃতি কর্মীরা তা প্রতিরোধে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। শান্তি মিছিলে সংগঠিত করেন তাঁরা। এ সময় আবুল ফজল এসব কাজ সংগঠিত করতে বিশেষ উদ্যোগ নেন। ‘সীমান্ত’ পত্রিকায় তিনি তরুণদের সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়াতে ‘ইতিহাসের আহ্বান’ শীর্ষক একটি লেখায় আবেদন জানায়। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে হরিখোলার মাঠে পূর্ববাংলার প্রথম উন্মুক্ত সংস্কৃতি সম্মেলন সংগঠিত করেন যা ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। ১৯৬১ সালে চট্টগ্রামে ৭ দিনব্যাপী রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালের ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদে লেখেন ‘মানবতন্ত্র’ নিবন্ধটি যা তাঁর জীবন ও সাহিত্য দর্শনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে। বিগত শতকের ষাটের দশকে অসামান্য অগ্নিগর্ভ সব প্রবন্ধ লেখেন। পূর্ববাংলার নানা জায়গায় দেয়া ভাষণে তিনি দেশের লেখক, সাংস্কৃতিককর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন। মূলত পূর্ববাংলায় পঞ্চাশ ও ষাট দশকের আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম সাংস্কৃতিক নির্মাতা। অসহযোগ আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের লেখক-সংস্কৃতিকর্মীরা খুবই সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি তৎকালীন সরকারের কিছু নীতি ও এস্টাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন। এসব নিয়ে লিখেছেনও নিয়মিত। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুরোধে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব নেন এবং তৎকালীন শিক্ষাক্ষেত্রে নানা বিশৃঙ্খলা পরিহারে দৃঢ় ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৫-এর বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিচারপতি সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের সরকারে যোগদানের ব্যাপারে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও এ কথা বলা যায়, সেই সময় সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তির যোগদানের ফলে দেশ আরো দক্ষিণপন্থা ও প্রতিক্রিয়ার ছোবল থেকে সাময়িক হলেও রক্ষা পায়। অবশ্য সেই সরকারে তিনি বেশিদিন থাকেননি, দেড় বছরের মাথায় তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁর সেই সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে গল্পগ্রন্থ ‘মৃতের আত্মহত্যা’ ব্যাপক আলোচিত হয়। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে উপন্যাস- ৬টি, চৌচির, সাহসিকা, জীবনপথের যাত্রী, প্রদীপ ও পতঙ্গ, রাঙাপ্রভাত, পরাবর্তন। ছোটগল্পের সংখ্যা ৫০টি, উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ : বিচিত্র কথা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা, সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন, সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র, সমকালীন চিন্তা, ‘মানবতন্ত্র’, শুভবুদ্ধি, একুশ মানে মাথা নত না করা, রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধাবলি। আত্মজীবনী : রেখাচিত্র, লেখকের রোজনামচা, দুর্দিনের দিনলিপি। অনুবাদ : ছদ্মবেশী, নাটক (নিকোলাই গোগোল রচিত দি ইনসপেক্টর জেনারেল এর ভাষান্তর), তবুও সূর্য ওঠে, (আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দি সান অলসো রাইজেস উপন্যাসের অনুবাদ), দর্শনের ইতিকাহিনী (উইলি ডুরান্টের দি স্টোরি অব ফিলসফি’ গ্রন্থের অনুবাদ), এ ছাড়া জীবনী ও স্মৃতিকথা, কয়েকটি নাটক ও সম্পাদনা গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সদস্যদের মধ্যে আবুল ফজল কথাসাহিত্য নিয়ে প্রথম লেখা শুরু করেন। তাঁর গল্প ও উপন্যাস সমসাময়িক মুসলিম সমাজের অন্তরঙ্গ উদভাসন। প্রথম উপন্যাস চৌচির, গল্পগুচ্ছ ‘মাটির পৃথিবী’ এবং ‘বিচিত্র কথা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পাঠালে কবি আবুল ফজলকে প্রশংসা করে একটি দীর্ঘ চিঠি দেন। কবিগুরু লিখেছেন, ‘চাঁদের এক পৃষ্ঠায় আলো পড়ে না, সে আমাদের অগোচর, তেমনি দুর্দৈবক্রমে বাংলাদেশের আধখানায় সাহিত্যের আলো যদি না পড়ে, তাহলে আমরা বাংলাদেশকে চিনতে পারবো না, না পারলে তার সঙ্গে ব্যবহারে ভুল করতে থাকব’- এটি রবীন্দ্র জীবন দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তাঁর উপন্যাস ‘সাহসিকা’, ‘প্রদীপ ও পতঙ্গে’ নারী অধিকারের বিষয় এসেছে। ‘জীবনপথের যাত্রী’ উপন্যাসে প্রধান দুই তরুণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন আন্দোলনের কর্মী। ‘রাঙা প্রভাত’ উপন্যাসে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিপরীতে উদার মানবিক সম্মিলনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। বৈষম্যহীন সমাজ গঠন ছাড়া সাম্প্রদায়িকতা বিলুপ্ত হবে না- এই মেসেজও আছে উপন্যাসে। আবুল ফজলের গল্পের প্রশংসা করেছেন কাজী নজরুল, লীলা রায়, মোহিত লাল মজুমদার। লীলা রায় ‘মাটির পৃথিবী’ গল্পগুচ্ছের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর গল্প প্রসঙ্গে দেশ পত্রিকার (৬ বৈশাখ ১৩৪৮) মন্তব্য ছিল এ রকম, “আবুল ফজলের গল্প পড়িয়া আমরা বিস্মিত হইয়াছি। অকস্মাৎ এমন একটা সংস্কারবিমুক্ত মনের পরিচয় পাইয়া মন খুশিতে ভরিয়া ওঠে। বাংলাসাহিত্যের ক্ষেত্রে আবুল ফজল বিশেষ পরিচিত নহেন কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, বাংলা সাহিত্য তাঁহাকে বাদ দিয়া অসম্পূর্ণ।” এই মন্তব্য সাহিত্যবোধের চাইতে স্ব-সমাজের সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য চিত্র নির্মাণের প্রশংসা। আবুল ফজলের গল্প উপন্যাস তৎকালীন পাঠক সমাজ ও সমালোচক মহলে বেশ আলোচিত হয়েছে- তার প্রমাণ এসবে মেলে। তবে আবুল ফজলের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন দর্শনের দিকটি উজ্জ্বল ও স্পষ্ট হয়েছে প্রবন্ধ সাহিত্যে। তাঁর লেখায় সাহসী ও মানবতাবাদী প্রাবন্ধিকের পরিচয় পাই আমরা। সাহিত্য ও সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ধর্ম ও রাজনীতি, মানবকল্যাণ ও মানবমুক্তি এসব বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট মতামত বিগত শতকের পঞ্চাশ ও ষাট দশকে প্রবল আলোড়ন তুলেছে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মাঝে। শুধু তাই নয়, এ দুদশকে পূর্ব বাংলায় বাঙালির আত্মঅন্বেষণের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দর্শনটিও তিনি নির্মাণ করেছেন তাঁর মননশীল লেখায়। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালির যে নবযাত্রা এবং সংবিধানের যে মৌলনীতি-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র- সেসবের সাংস্কৃতিক ও তত্ত্বগত ধারণা নির্মাণে তাঁর প্রবন্ধ অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি নিজে সাহিত্যিক অনুগামীদের প্রেরণা দিয়েছেন। আমাদের লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সাহসী ভূমিকা নেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর নানাবিধ প্রেরণা ছিল। তাঁর সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধগুলো আমাদের জাতীয় জীবনের সীমাবদ্ধ ও খণ্ডিত ধারণার বিপরীতে মানবিক, সমন্বয়বাদী- নানা মত ও পথের সাংস্কৃতিক সম্পদের বিশিষ্টতা চিহ্নিত করে। তাঁর মতে ‘উৎকট বিশ্বাস ও অন্ধ ভাবাবেগ হচ্ছে সাংস্কৃতিক জীবনের অন্তরায়’। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামের হরিখোলার মাঠে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হিসেবে দেয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘আমি আপনাদের সামনে বলতে চেয়েছি, মনুষ্যত্বই তথা মানবধর্মের সাধনাই সংস্কৃতি এবং একমাত্র এই সাধনাই জীবনকে করতে পারে সুন্দর ও সুস্থ।’ তাঁর মতে ‘সংস্কার যেমন সংস্কৃতি নয়, প্রচলিত ধর্মীয় আচার বা শিক্ষাও তেমনি সংস্কৃতি নয়।’ আজ উপমহাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে যেভাবে ধর্মীয় উগ্রতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদ, অন্ধ শাস্ত্রানুগত্য, হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানি প্রবল হয়ে উঠেছে- এসবের মোকাবেলায় সাহিত্য ও সংস্কৃতির মানবিক উজ্জ্বলতা আমাদের পথ দেখাতে পারে। এ ক্ষেত্রে আবুল ফজলের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা আমাদের চিন্তা ও মননের পাথেয় হতে পারে। সংস্কৃতি প্রসঙ্গে তাঁর কথা দিয়ে আমার লেখা শেষ করবো। তিনি লিখেছেন, ‘সংস্কৃতির রূপ কখনো এক বর্ণ হয় না- জীবন্ত সংস্কৃতি সব সময় বিচিত্র ও বহুবর্ণ। এমনকি তার মধ্যে স্ববিরোধিতার স্থানও রয়েছে। মৃত্যুর বর্ণ এক, জীবন বহুবর্ণ। যে সংস্কৃতি বহুবর্ণ হতে অনিচ্ছুক, তার অকালমৃত্যু অনিবার্য।’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App