বিবেক-তাড়িত মানবতাবাদী
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০১৯, ০৯:০৬ পিএম
আবুল ফজলকে যে বলা হতো বাংলার বিবেক, সেটা তিনি নানাভাবে প্রমাণ করেছেন। বিবেকের বাণীর কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে জাগতিক ভাবনা। ফলে আবুল ফজল দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদীও বটে, যদিও সেই প্রতিবাদ বুঝতে আমরা তেমনভাবে সমর্থ হইনি, কেননা মৃদুভাষী নম্রকণ্ঠ এই মানুষটির প্রতিবাদেও ছিল নম্রতা, তবে ভিত্তি ছিল দৃঢ়তা, বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ মানুষের অনন্যতা। তিনি তাই মানবতাবাদী তবে বাণী সর্বস্ব মানবতাবাদী নন, বিবেকসিদ্ধ মানবতাবাদী তিনি, যেমনটি খুব বেশি মিলবে না।
আবুল ফজলকে এক অভিধায় মানবতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, এমন তকমা এঁকে দেয়ার মধ্যে ভুল কিছু নেই, তবে সংক্ষিপ্ততম এমনি ধারা পরিচিতিতে মানুষটির পূর্ণ সত্তা পাওয়া যায় কিনা তা বিবেচনা করে দেখার রয়েছে। মানবতাবাদ নিয়ে সর্বদা পথ চলেছেন আবুল ফজল। মার্কিন দার্শনিক জন ডিউয়ির তিনি অনুরক্ত ছিলেন, দর্শনের ক্ষেত্রে তত্ত্বের নানা বিভাজনের মধ্যে ঐক্যসূত্র তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মানবতাবাদে, ফলে তিনি সহজে এক মত থেকে অন্য মতে অবগাহন করতে পারতেন। কেননা দর্শনে তিনি সভ্যতার জীবনজিজ্ঞাসার বিভিন্ন রূপ খুঁজে পেতেন। যে কারণে ডিউয়ির রচনা আবুল ফজলকে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে এক অর্থে তাঁকে সমন্বয়বাদী বলা যায়, বাস্তব জীবনেও নানা মতের মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ।
আবুল ফজল সময়ের সন্তান যিনি সময়কে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর নিজ সত্তার বিকাশ বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। নজরুলের সান্নিধ্য এবং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ তাঁর প্রাপ্য হয়েছিল। ঢাকা-কেন্দ্রিক মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর নেতৃবৃত্তে তিনি ছিলেন, সংগঠনের মুখপত্র ‘শিখা’-সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছুকাল। মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা তিনি সমাপন করেন, যে যাত্রা খুব সহজ ছিল না, সময়ও লেগেছিল দীর্ঘ। তারপর স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা, বিশেষভাবে চট্টগ্রাম কলেজে তাঁর শিক্ষকতা তৈরি করেছিল অনন্য আবহ। এ সবের পাশাপাশি তিনি সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত ছিলেন প্রায় সর্ব সময়। ছিল বহুবিধ সামাজিক-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগ তাঁর ভূমিকা। ফলে বহুব্যাপ্তভাবে আমরা পাই আবুল ফজলকে।
আরো অনেকের মধ্যে আবুল ফজলের স্নেহধন্য হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি তখন একান্তই অর্বাচীন যুবক, গায়ে-গতরে খাঁটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক উদ্যোগে, সেজন্য কিনা জানি না, অগৌণ এই যুবকও তাঁর প্রশ্রয় পায় এবং যেভাবে তাঁকে দেখেছি তাতে মুগ্ধতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবনের অশেষ পাওয়া। শ্রদ্ধাভাজন মানুষটিকে দেখেছি তাঁর চট্টগ্রামের আবাস ‘সাহিত্য নিকেতনে’, তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কিন্তু জীবনাচরণে, পোশাকে, ব্যবহারে পদের ভার মোটেই টের পাওয়া যায় না। পরে যখন তিনি জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনের মন্ত্রিসভা তথা উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হলেন তখনো গেছি তাঁর মিন্টো রোডের মন্ত্রী-আবাসে। মনে হতো এ তাঁর অস্থায়ী ও অনিচ্ছুক আবাস, মূল রয়ে গেছে চট্টগ্রামে সাহিত্য নিকেতনে, ঢাকা এসেছেন বোধ করি কোনো কাজে, কাজ শেষে চট্টগ্রামে ফিরে যাবে ত্বরিত। এর-ওর কাজ নিয়ে যেতে হয়েছে তাঁর কাছে, সেসব কাজ করে দিতে তিনি চেষ্টা করেছেন যথাসাধ্য। মনে পড়ে আমাদের এক শিক্ষক বন্ধুকে নানাভাবে নাজেহাল করছিল সামরিক গোয়েন্দাবাহিনী, তাঁর কলকাতায় পড়াশোনা গোয়েন্দাদের কাছে মনে হয়েছিল ভারতীয় চর হিসেবে নিযুক্তির আবরণ মাত্র। ভদ্রলোকের নাগরিকত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। আবুল ফজলের যে খুব ক্ষমতা ছিল তা নয়, তবে এ সমস্যার সুরাহা তিনি করে দিতে পেরেছিলেন।
আমি তখন একান্তই অর্বাচীন যুবক, গায়ে-গতরে খাঁটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক উদ্যোগে, সেজন্য কিনা জানি না, অগৌণ এই যুবকও তাঁর প্রশ্রয় পায় এবং যেভাবে তাঁকে দেখেছি তাতে মুগ্ধতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবনের অশেষ পাওয়া। শ্রদ্ধাভাজন মানুষটিকে দেখেছি তাঁর চট্টগ্রামের আবাস ‘সাহিত্য নিকেতনে’, তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কিন্তু জীবনাচরণে, পোশাকে, ব্যবহারে পদের ভার মোটেই টের পাওয়া যায় না।
জিয়ার শাসনামলে সর্বক্ষেত্রে সামরিক গোয়েন্দাদের নজরদারি ও কর্তৃত্ব সম্পর্কে আবুল ফজল সম্যক অবগত ছিলেন। তখন এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, শিল্পী-সাহিত্যিকদের হেনস্থা করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে। সামরিক গোয়েন্দারা একদিন তুলে নিয়ে যায় মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহাকে। সামরিক গোয়েন্দাদের জেরা ও নির্যাতনের পর তিনি প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেন আবুল ফজলের কল্যাণে। তবে বর্বর গোয়েন্দা জেনারেলদের হাত থেকে কতজনকে কীভাবে বাঁচাবেন তিনি! হাসান হাফিজুর রহমান আবার নতুন করে ধরেছেন ‘সমকাল’ সাহিত্যপত্রের হাল, সেখানে প্রকাশিত হয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতা ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’। কবিতার পঙ্ক্তি পড়ে হকচকিয়ে যায় গোয়েন্দা দল, এতকিছুর পরও বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে কি করে? ‘একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি, নিথর বিশাল, মাটি খুঁড়ে জেগে ওঠে গভীর রাত্তিরে’, পড়ে আরো চমক লাগে, যাকে কবরের নামে পুঁতে রাখা হয়েছে নগরী থেকে বহুদূর গ্রামের মাটিতে, তিনি আবার জেগে উঠবেন কি? কোন তেপান্তরে আজ হাঁপাচ্ছে বিশীর্ণ পক্ষিরাজ, তৃতীয় কুমার তাঁর এখনো ফেরেনি; এই শেষ লাইনে এসে একেবারে হতভম্ব গোয়েন্দা দল। কে তাদের বোঝাবে এসব পঙ্ক্তির মাহাত্ম্য, জিজ্ঞাসাবাদ চলে শামসুর রাহমানকে ঘিরে, তৃতীয় কুমার বলতে কাকে বোঝাতে চেয়েছেন তিনি? সে-কি শেখ শহীদুল ইসলাম?
বৈরী সময়ে অন্যের বিপন্নতা রোধ করতে আবুল ফজল বিশেষ পারগ ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত কি তাই নিজেকে বিপন্ন করবার সিদ্ধান্তই তিনি নিলেন। একান্ত সঙ্গোপনে হাসান হাফিজুর রহমানের হাতে তুলে দিলেন তাঁর লেখা ছোটগল্প ‘মৃতের আত্মহত্যা’, সেনা-সদস্যদের হাতে বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তাঁর বিবেক-তাড়িত রচনা। গল্পের মূল চরিত্র সোহেলী বিবেকের তাড়নায় ছটফট করতে করতে শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন হননেরই সিদ্ধান্ত নেয়। আবুল ফজলও বিবেক-তাড়িত হয়ে লিখলেন গল্প এবং প্রকাশের আয়োজনও সম্পন্ন করলেন। তবে আত্মহত্যা নয়, এ তাঁর বাঁচারই অবলম্বন, সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত দায়ভার-মোচন। ‘মৃতের আত্মহত্যা’ গল্পের সোহেলির মতো আবুল ফজলও ছিলেন জীবন্মৃত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও সান্নিধ্য তাঁকে অনেকভাবে ঋণী করে রেখেছিল। সেই ঋণ শোধের তাগিদ, বৈরী পরিবেশেও তাঁকে তাড়া করে চলছিল, আর তাই ‘মৃতের আত্মহত্যা’ কেবল গল্প ছিল না, গল্প লেখার গল্পও বটে এই সাহিত্যকর্ম, তার প্রকাশ ইতিহাস এবং প্রকাশ-পরবর্তী ঘটনাধারা সমেত। তিনি মন্ত্রিসভা ত্যাগ করলেন একান্ত অনায়াসে, স্বভাবগতভাবে যেন।
আবুল ফজলকে যে বলা হতো বাংলার বিবেক, সেটা তিনি নানাভাবে প্রমাণ করেছেন। বিবেকের বাণীর কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে জাগতিক ভাবনা। ফলে আবুল ফজল দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদীও বটে, যদিও সেই প্রতিবাদ বুঝতে আমরা তেমনভাবে সমর্থ হইনি, কেননা মৃদুভাষী নম্রকণ্ঠ এই মানুষটির প্রতিবাদেও ছিল নম্রতা, তবে ভিত্তি ছিল দৃঢ়তা, বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ মানুষের অনন্যতা। তিনি তাই মানবতাবাদী তবে বাণী সর্বস্ব মানবতাবাদী নন, বিবেকসিদ্ধ মানবতাবাদী তিনি, যেমনটি খুব বেশি মিলবে না।