×

মুক্তচিন্তা

সহিংসতা প্রতিরোধের উপায় কী?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০১৯, ১০:১৪ পিএম

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার গলদের কথা বলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। বাস্তবিকই তা-ই। শিক্ষা মানবিকবোধসম্পন্ন করতে পারছে না শিক্ষার্থীদের। সেদিকে নজর দেয়া অত্যাবশ্যক, সময়ের দাবিও বটে। সংস্কৃতি প্রকৃত অর্থে মুখ থুবড়ে পড়েছে, শহরের দালানকোঠায় বন্দি। এর প্রসার ছাড়া সহনশীল সমাজের প্রত্যাশা দূরাশা।

ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পর বরগুনার রিফাত শরীফের হত্যাকাণ্ড বড় ধরনের আলোড়ন তুলল দেশে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার- শত শত লোকের সামনে রিফাতকে কুপিয়ে মারল দানবরা, সঙ্গে থাকা স্ত্রী ছাড়া আর কেউ এগিয়ে এলো না তাকে বাঁচাতে। সড়কে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় ছাত্রসমাজ কিছুদিন আগে রাস্তায় নেমে এসেছিল ব্যাপক হারে, চাকরিতে নিয়োগের বেলায় কোটা বাতিলের দাবিতে তরুণরা বিপুল পরিমাণে রাস্তায় ছিল, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চ করে ফুঁসে উঠেছিল ছাত্রযুবারা। এ ক্ষেত্রে ঘটল উল্টোটি, কেউ এগিয়ে এলো না রিফাতের প্রাণ রক্ষায়। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। ঘটনাটি ভিডিও করে এক বা একাধিক ব্যক্তি কর্তৃক তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ায় নিখাদ প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সংবাদটি। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সুশীল সমাজের কেউ কেউ প্রতিরোধে না নেমে ভিডিওতে সময়ক্ষেপণে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। ভিডিও সংক্রান্ত বিষয়টিকে সাদামাটাভাবে না দেখে অন্যভাবেও দেখা যায়; আর তাহলো ভীতি। ভয়ের কারণে প্রতিরোধ-অনন্যোপায় মানুষ আঙুল উঁচিয়ে দেখাল সামাজিক অবস্থার রক্তক্ষরণ। কারো আবার রাজনৈতিক অভিসন্ধিও থাকতে পারে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশের সর্বত্র প্রকৃতই একটা ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে, যে কারণে প্রতিরোধে নামার সাহস করছেন না সাধারণ মানুষ। যেখানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কিংবা যেখানে আছে ক্ষমতাসীন দলের আত্মীয় পরিচয় সেখানে তো না-ই। আলোচ্য ঘটনার নায়ক নয়ন গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় থেকে অপরাধ সংঘটিত করে যাচ্ছিল। পুলিশ বলছে, মাদক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ তার বিরুদ্ধে সাতটি মামলা রয়েছে, যার সবক’টিতে জামিন নিয়ে সে আগের মতো অপকর্ম করে যাচ্ছিল। গণমাধ্যম এলাকাবাসীর অভিযোগ সূত্রে এমন তথ্যও দিচ্ছে যে, পুলিশ নয়নের বিরুদ্ধে কঠোর থাকতে পারেনি প্রভাবশালী মহলে তার যোগাযোগ থাকার কারণে। বরগুনার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশজুড়েই সহিংসতার বিস্তার ঘটছে এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট। গণমাধ্যমে থেকে থেকেই নানা প্রকৃতির সহিংসতার বিবরণ আসছে। এ ছাড়া নিজেরাও চাক্ষুষ করছি ঘটনাপুঞ্জ। ময়মনসিংহ বরাবরই শান্তির শহর ছিল। সেই শহরের এক গলিতে কয়েকদিন আগে একদল উচ্ছৃঙ্খল কিশোর-তরুণের রামদা নিয়ে দৌড়াদৌড়ির দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আতঙ্কিত না হয়ে পারিনি। দুই. ক্রমবর্ধমান এই সহিংসতা প্রতিরোধের উপায় কী- এই প্রশ্নের সমাধান খোঁজার উপাদান কিছুটা ওপরের আলোচনায় বিধৃত। সরকারি মহলের অনেকে যথারীতি একে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস নিচ্ছেন। এটি ঠিক নয়। বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে সমাধান খোঁজা বাঞ্ছনীয়। উদাহরণস্বরূপ জঙ্গিনিরোধ তৎপরতার কথা ধরা যায়। সত্যিকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনী একাট্টা হওয়ায় সুফল পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ বলতে গেলে এখন অনেকটাই জঙ্গিমুক্ত। একই রকমভাবে সরকার সবাইকে নিয়ে তৎপর হলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে এ ক্ষেত্রেও। এতে সঙ্গে নিতে হবে পুলিশ-র‌্যাব ও সাধারণ জনগোষ্ঠীকে। রাজনৈতিক প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় করতে না পারলে প্রত্যাশা পূরণ হবে না। সামাজিক আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে হিতৈষীদের তরফ থেকে। সেটি অতি প্রয়োজনীয়ও। বাস্তবতা হলো, সরকারি দলের লোকজন মাঠে না নামলে এই মুহূর্তে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। দেশের রাজনীতি এখন সরকারি দলকেন্দ্রিক, বিরোধীপক্ষ ভীতসন্ত্রস্ত। এমনকি সাধারণ মানুষও ভীত। নির্বাচনের পর এই ভীতি ভাব আরো বেড়েছে। কেউ মুখ ফুটে কিছু বলতে চান না, মাঠে নামা তো দূরের কথা। ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পর একটা সামাজিক আন্দোলনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, অনেক মানুষ নেমে এসেছিল রাস্তায় প্রতিবাদে। সরকারি দলের লোকজন এ ধরনের কোনো কর্মসূচিতে যুক্ত না হওয়ায় আন্দোলন সফল হয়নি। সরকার বা সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায়ের ইঙ্গিত ছাড়া তাদের লোকজন পাওয়া যাবে না, সেটি আরেক বাস্তবতা। এই অনভিপ্রেত বাস্তবতার অবসান হলে দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের অংশগ্রহণে জনপ্রতিরোধ সম্ভব হতো। প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলতে হয়, সেটি হলো বড় ধরনের কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা সামনে এলে সরকারি দলের মুখপাত্ররা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী দেখভাল করছেন বলা হয়। সবকিছু যদি প্রধানমন্ত্রীই দেখবেন তাহলে তারা আছেন কেন? বাংলাদেশে পুলিশের সক্ষমতার ঘাটতি খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। ঘাটতি যতটুকু আছে তা পেশাদারিত্ব ও সততার। যে কারণে প্রভাবশালী মহলের প্রভাব সামলানো তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে। বাহিনীটি যখন নিরপেক্ষতা ও সততার সঙ্গে কাজ করে তখন বিফল হয় কমই। পুলিশের কাছ থেকে শতভাগ পেতে চাইলে এ ঘাটতি দূর করতে হবে আগে। রিফাতের হত্যাকারী নয়ন মঙ্গলবার ভোরে পুলিশের বন্দুক যুদ্ধে মারা গেছে। এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। খুনিদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হলে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসার নজিরও আছে। দাগি অপরাধী জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসার পর পুনরায় অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে- এ রকম খবর হরহামেশা প্রকাশিত হচ্ছে গণমাধ্যমে। তা ছাড়া বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও বিচার না হওয়া নিয়ে জনমনে গভীর প্রশ্ন আছে। রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগকে এ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। কালক্ষেপণ শুধু বর্তমান নয়, জাতির ভবিষ্যৎকেও ধ্বংস করে দেবে। তিন. সরল চিন্তা থেকে কেবল তাৎক্ষণিক সমাধানচিন্তা নয়, গভীরে যেতে হবে আরো সুদূরপ্রসারী ভাবনা নিয়ে। উন্নয়নকে টেকসই ও মর্যাদাসম্পন্ন করতে হলে সুস্থির ও উন্নত সমাজের বিকল্প নেই। সেই লক্ষ্যে আমাদের কর্মপ্রয়াস দরকার। দেশের মোট জনসংখ্যার গরিষ্ঠসংখ্যক তরুণ। এটি এক বড় ধরনের সুযোগ অগ্রযাত্রার জন্য। কিন্তু তাদের একাংশ যদি বখে যায় তাহলে ফল হবে হিতে বিপরীত, যেমন হচ্ছে বর্তমান সময়ে। বখে যাওয়া তরুণের সংখ্যা বাড়ছে। তেমনটি হচ্ছে সঙ্গদোষে কিংবা প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্র্রয়ে। শঙ্কা আছে আরো। প্রতি বছর ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে ঢোকার যোগ্যতা অর্জন করছে, তাদের সবার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দুরূহ হবে। সে ক্ষেত্রে পরিপার্শ্ব পরিশীলিত না থাকলে বখে যাওয়ার সংখ্যা বাড়বে। দেশের সত্যিকার মঙ্গল চাইলে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, সমাজটাও সুবাসযোগ্য হয়। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার গলদের কথা বলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। বাস্তবিকই তা-ই। শিক্ষা মানবিকবোধসম্পন্ন করতে পারছে না শিক্ষার্থীদের। সেদিকে নজর দেয়া অত্যাবশ্যক, সময়ের দাবিও বটে। সংস্কৃতি প্রকৃত অর্থে মুখ থুবড়ে পড়েছে, শহরের দালানকোঠায় বন্দি। এর প্রসার ছাড়া সহনশীল সমাজের প্রত্যাশা দূরাশা।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App