×

মুক্তচিন্তা

বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র বনাম ক্ষমতাতন্ত্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জুন ২০১৯, ০৮:৫১ পিএম

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চা এবং শিক্ষক রাজনীতির পরিবেশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এখানে নানাভাবে শোকজ, হুমকি প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তা এবং প্রতিবাদের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। যার ফলে এখন অনেক শিক্ষার্থীই সামাজিক গণমাধ্যমে কোনো ধরনের স্ট্যাটাস, মতামত এমনকি লেখা শেয়ার দিতে ভয় পাচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে কয়েকটি সামাজিক রোগে ভয়াবহ আক্রান্ত। এই ভয়াবহ রোগগুলোর কয়েকটি হচ্ছে ‘ভাবমূর্তি’, ‘অনুভূতি’ এবং ‘উসকানি’।

বেশ কয়েকদিন ধরেই ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থান না পাওয়ায় জনমনে ক্রোধ, খুতখুতানি এবং এ নিয়ে নানা ধরনের বাহাস হয়েছিল, এখনো অনেকাংশে তা চলমানও রয়েছে। অন্য প্রাইভেট এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানি না তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব শিক্ষককে নোটিস দিয়েছেন তাদের গবেষণা এবং প্রকাশনাসমূহ নিজস্ব বিভাগের ওয়েব পেইজে আপলোড করতে। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ধারণা হয়েছে শিক্ষকদের গবেষণা এবং প্রকাশনা ঠিকমতো মূল্যায়িত হচ্ছে না এবং যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে স্থান পাচ্ছে না। এটি না করলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। উদ্যোগটি ভালো। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার যে সামগ্রিক চলমান ব্যবস্থাপনা সেটির পরিবর্তন না ঘটিয়ে শুধুমাত্র এই ধরনের উদ্যোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অবস্থার পরিবর্তন খুব বেশি করা যাবে না। কেন যাবে না? সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তবুদ্ধি চর্চা এবং শিক্ষক রাজনীতির পরিবেশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এখানে নানাভাবে শোকজ, হুমকি প্রয়োগ করে শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তা এবং প্রতিবাদের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। যার ফলে এখন অনেক শিক্ষার্থীই সামাজিক গণমাধ্যমে কোনো ধরনের স্ট্যাটাস, মতামত এমনকি লেখা শেয়ার দিতে ভয় পাচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে কয়েকটি সামাজিক রোগে ভয়াবহ আক্রান্ত। এই ভয়াবহ রোগগুলোর কয়েকটি হচ্ছে ‘ভাবমূর্তি’, ‘অনুভূতি’ এবং ‘উসকানি’। এগুলোতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে খোদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও। বিভিন্ন প্রাইভেট এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার এবং শোকজ নোটিস প্রদান যেন প্রতিদিনকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতার সেবাদানকারী শিক্ষকরাই মূলত এই ধরনের সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শোকজের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায় এই সংস্কৃতি জারি থাকার ধরন। কেবলমাত্র মে মাসেই গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) প্রশাসন দুই দফায় কারণ দর্শাও নোটিস প্রদান করেছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৯ জন শিক্ষার্থীকে। এ ছাড়া সাময়িক বহিষ্কার করেছে একজনকে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোনো ধরনের যৌক্তিক কারণ ছাড়াই কেবল শিক্ষার্থীদের মাঝে ভয়ভীতি সৃষ্টি এবং কোনো ধরনের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের সংস্কৃতি বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই এসব শোকজ নোটিস দেয়া হয়েছে। কারণ দর্শাও নোটিস প্রদান করা ১৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে পাঁচজনকে ফেসবুক স্ট্যাটাস প্রদান ও নিউজ শেয়ার করার জন্য গত ৯ মে নোটিস প্রদান করা হয়। এই পাঁচজন শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হওয়া তাদের দুই সহপাঠীর দায়ের করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বিভাগীয় শিক্ষক যৌন নিপীড়ক আক্কাস আলীর বিচারের দাবিতে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। সেই প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই তারা গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট এবং কলাম শেয়ার দেয় এবং যেগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় ‘ভাবমূর্তি’ নষ্টের অংশ হিসেবেই দেখে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই মাসের দ্বিতীয় দফার শোকজটি ছিল আরো মজার। শোকজ নোটিসপ্রাপ্ত অবশিষ্ট ১৪ জন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে ধানের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে মানববন্ধন করায় এবং সরকারবিরোধী প্ল্যাকার্ড বহন করায় ৩০ মে শোকজ নোটিস প্রদান করা হয়। তাদের দৃশ্যমান অপরাধ তারা কেবলমাত্র সরকারের কাছে ধানের ন্যায্যমূল্য দাবি করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ‘ভাবমূর্তি’ এবং ‘উসকানি’ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ। ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট হচ্ছে বলে সামাজিক হাহাকার প্রায়শ শোনা যায়। এ দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যখনই যৌন হয়রানির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তখনই এটিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয় ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষার প্রশ্নে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি হবে, সেখানে সেই যৌন নিপীড়ক ব্যক্তিকে বাঁচানোর বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা তাহলে প্রতিষ্ঠানকে সম্মানিত করে? সেটাতে কোনো ধরনের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট হয় না? কিন্তু সেসব বিষয়ে আন্দোলন হলেই ‘ভাবমূর্তি’ নামক সিন্ধুকে রাখা বস্তুটি খান খান করে ভেঙে পড়ে? অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটি। অনেকে আবার বলেন, ‘এগুলোর প্রতিবাদ করা আমার রুচিতে বাধে’। এই কথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্র চুপ থাকা, লুকানোর চেষ্টা করাই অরুচিশীল এবং প্রতিবাদটাই বরং রুচির পরিচয় এবং সুস্থ ‘ভাবমূর্তি’র পরিচয়। ‘উসকানি’ কিংবা ‘ইন্ধন’ শব্দটিও আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন নয়, বরং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত শব্দ। সাম্প্রতিক সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এটিকে ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছেন। উসকানির সংজ্ঞা কী? মানুষ কখন উসকানি বোধ করে? প্রায়শ উসকানি শব্দটা শোনা যায় সরকারদলীয় মন্ত্রী এবং নেতাদের দেখে। বিশেষ করে গার্মেন্টস কিংবা ছাত্র আন্দালনের নৈতিক জোরকে স্বীকার না করে বিরোধী দলের উসকানি কিংবা বিশেষ মহলের ইন্ধন হিসেবে প্রচার করেন তারা। অর্থাৎ ক্ষমতার গায়ে আঁচড় পড়া যে কোনো কিছুই ‘উসকানি’ হিসেবে পাঠ করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারীকে একরকমভাবে ‘প্যাসিভ’ বা নিষ্ক্রিয় হিসেবে দেখার চেষ্টা করা হয়। যেখানে তাদের অন্যের উসকানির ‘পুতুল’ হিসেবে হাজির করার এ এক ধরনের জোর চেষ্টা থাকে। এর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আইনের যোগসূত্রও মিলে যায় কখনো কখনো। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বিভিন্ন সময়ে সমালোচনা এবং দাবিতে বিলুপ্ত হলেও নতুন আইন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মধ্যে ৫৭ ধারার সব উপাদান আছে, যার কারণে এই আইনে মামলা দায়ের করার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। মানুষের প্রতিবাদ, প্রতিরোধের বোধকেই উসকানি হিসেবে ঠাওরে গ্রেপ্তার করে এটি থেকে মানুষকে ক্রমশ দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে কোনো বক্তব্যের বিরুদ্ধে চট করে উসকানির অভিযোগ আনা নিশ্চিতভাবেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শোকজ সংস্কৃতিকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং যার বেশিরভাগই হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো স্ট্যাটাস কিংবা শেয়ারকে কেন্দ্র করে। তবে শুধু শিক্ষার্থীই নয়, আক্রান্ত হচ্ছেন শিক্ষকরাও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাইদুল ইসলামকে বাসার সামনে এসে গালিগালাজ করে হুমকি দিয়ে গেছেন কয়েকজন। তিনি প্রচ- রকমের নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। এর আগে তিনিও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ‘উসকে’ দেয়ার অভিযোগে। আর সেই মামলাটি করেছিলেন চট্টগ্রামের এক ছাত্রলীগ নেতা। এখন যদি শিক্ষক রাজনীতির দিকে একটু চোখ ঘুরাই তাহলে কী দেখব? বিশেষ করে গত কয়েক মাস ধরে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি পদে আসীন হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে যে ধরনের তৎপরতা এবং প্রতিযোগিতা দেখা গেছে তা কোনোভাবেই জ্ঞানের বিদ্যাপীঠ হিসেবে আখ্যায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। অথচ এই বছর দশেক আগেও বোধহয় বিষয়গুলো এইরকম ছিল না। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো সেই অতিরিক্ত মধু মাখা ভিসি পদে আসীন হতে সাম্প্রতিক সময়ে প্রাইভেট এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে সেটি। প্রার্থীরা যে নিজেদের সম্পর্কে জোরালো তদবির করেই ক্ষান্ত থাকেন তা নয়, অন্য প্রার্থীদের দোষের পাল্লা খুলে সেগুলো সরকারের নীতিনির্ধারক উচ্চমহলে প্রচারের ব্যবস্থা করেন এবং সম্ভাব্য নারী প্রার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের আমলনামাও খুঁজে বের করেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বাইরেও বিভিন্ন প্রার্থীকে নিয়ে লিফলেট, ছবি, উড়ো চিঠিসহ সম্ভাব্য সবই প্রচার করছেন। বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় আছে অর্থাৎ এগুলো ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলার কথা। এ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী যেভাবে ভিসি নিয়োগের বিধান আছে তা সাধারণত পালন করা হয় না। নিয়মিত সিনেট নির্বাচন দেয়ার কথা থাকলেও সে নির্বাচনও যথাথভাবে সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয় না। সিনেটকে সক্রিয় রাখতে হলে যেভাবে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের নির্বাচন করার কথা, সেটিও অনুসরণ করা হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে তিন সদস্যের প্যানেল নির্বাচন করে সেখান থেকে চ্যান্সেলরের যেভাবে একজনকে ভিসি নিয়োগ দেয়ার বিধান ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে আছে তার বাস্তবায়ন সব সময় করা হয় না। তাই সামগ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিশ্চিত করতে খুলতে হবে গণতন্ত্রের জানালা, বিশ্ববিদ্যালয়েই এটি বন্ধ করার প্রক্রিয়া চললে, বোধহয় অন্ধত্বের লাঠি নিয়ে চলতে হবে।

জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App