×

মুক্তচিন্তা

সামাজিক নিরাপত্তার দিকটা ভাবা উচিত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০১৯, ০৮:২২ পিএম

যে সমাজে স্ত্রী স্বামীকে দিবালোকে কুপিয়ে মারতে দেখে বাঁচাতে পারে না সে সমাজে বাদবাকি সব গল্প। মানুষ এখন আর এসব শুনতে চায় না। তার বড় দায় বাঁচার, নিজেকে বাঁচানোর। সব দেশেই দুর্ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু বারবার? একাধিকবার এক নাটক? এক মহড়া? আমি বলব সামাজিক নিরাপত্তার দিকটা আসলেই কেউ ভাবে না। ডিসকানেকটেড একটা সমাজ আর নষ্ট এক পরিবেশ।

খবরে দেখলাম রিফাতের জানাজায় নাকি মানুষের ঢল নেমেছিল। পারিও বটে আমরা। দেখেশুনে মনে হয় আমরা একটি জানাজাপ্রিয় জাতিতে পরিণত হয়েছি। একেকটা ঘটনা ঘটে, মানুষ প্রাণ হারায় আর আমরা জানাজায় ঢল নামাই। এ কি আমাদের ভবিতব্য না নিয়তি? কিছুদিন পরপর দেশের কোথাও না কোথাও অঘটন ঘটবেই। এখন যা হয় তা মোটামুটি চরম আর ভয়াবহ। যেমন হয় ধর্ষণ নয়তো মৃত্যু। হত্যাকা- এত সস্তা ছিল না কখনো। মানুষ মানুষের জন্য পাশে দাঁড়ানোর জন্য ব্যাকুল থাকত। আমরা জানতাম যত অভাব-অনটন থাক না কেন আমাদের দেশ মানেই মায়ার দেশ। আসলে কি তাই? এখন কি মানুষের মনে আসলে কোনো মায়া-দয়া আছে? থাকলে একের পর এক মানুষকে কোপানোর পরও কারো টনক নড়ে না কেন? রাস্তায় হাজার মানুষের চলাচল। পাঁচশ মানুষ ধেয়ে গেলেই তো এমন হতে পারে না। কিন্তু পাঁচজনও যায় না। এটাকে আপনি জানের মায়া বললে আমি মানব না। পাঁচশ মানুষকে মোকাবিলা করার সাহস কোনো আর্মিরও নেই। এরা তো ছিঁচকে খুনি। আসলে আমাদের জাতিগত ঐক্য আর ভালোবাসায় চিড় ধরে গেছে। হানাহানি আর স্বার্থপরতা এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে কেউ কারো জন্য কোনো দয়া-মায়া অনুভব করে না। ভাবখানা এই আমি বাঁচলেই হলো। কিন্তু তা কি হয়? যখন হুমায়ুন আজাদকে কোপানো হয়েছিল তখন যারা মুখ টিপে হেসেছিলেন আজ তাদের ঘরেও হত্যাকারী হানা দিয়েছে। একদিন এভাবে সবাই অনিরাপদ আর জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকবে। কোনো উন্নয়ন তা রদ করতে পারবে না। বুধবার এ হত্যাকা-ের সময় রিফাতের পাশেই ছিলেন তার নববধূ আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। তিনি খালি হাতেই খুনিদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। এ সময় হামলাকারীদের সঙ্গে তার ধস্তাধস্তি হয়েছে। কিন্তু স্বামীর মৃত্যু ঠেকাতে পারেননি। মিন্নি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘অনেক চেষ্টা করছি, কিন্তু ফিরাইতে পারি নাই।’ ওই ঘটনার সময় আশপাশে অনেকই ছিলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। এর মধ্যে একজন ঘটনাটি ভিডিও করে ফেসবুকে পোস্ট করেন। সেই পোস্টটি ভাইরাল হয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, রিফাতকে যখন সন্ত্রাসীরা কোপাচ্ছিল তখন তাদের খুব কাছেই কয়েকজন যুবক দাঁড়িয়েছিল। এ দৃশ্য দেখে সবাই প্রশ্ন তুলেছেন ওই ছেলেগুলো কেন এগিয়ে আসেনি। অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর শরীরী অঙ্গভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কারণ ঘটনার সময় ছেলেগুলোকে খুব স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এ জন্য অনেকের প্রশ্ন, ছেলেগুলো জনসাধারণ হলে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না। হয় রিফাতকে বাঁচাতে এগিয়ে আসত, না হয় ভয়ে পালাত। প্রকাশ্যে এমন হত্যাকা-ের সময় স্ত্রী ছাড়া রিফাতকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে না আসায় হাইকোর্ট পর্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বরগুনায় বড় ধরনের এই গুনাহ হয়েছে। অনেক বড় ধরনের পাপ। একবার হয়েছিল ঢাকায়। রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে। অসহায় বাঙালি দেখেছে একটি সাধারণ দর্জির ভয়াবহ মৃত্যু। সে দিনও কেউ বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি। ছেলেটির নাম ছিল বিশ্বজিৎ। একজন মোল্লা মতো মানুষ শুধু মিনতি করছিল না কোপাতে। সে কথা শোনার মতো ঘাতক নেই দেশে। তারা পারলে তাকেও কোপায়। এমন কঠিন সত্য আর বাস্তবতায় আমরা মনে করি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নামের কেউ নাকি আমাদের বাঁচাবে? কোনো মন্ত্রীর কাজ না, কোনো রাজারও কাজ না এসব ঠেকানো। তারা আর পারবেও না। কারণ রক্তের নেশা ঢুকে গেছে বাঙালির শরীরে। পরকীয়া সহজিয়া যে নামে ডাকেন না কেন সামাজিক মিডিয়ার কারণে খুলে গেছে গোপন জগৎ। সেখানে সবাই সবার পর। ঘরের মানুষ ঘরের মানুষকে চেনে না। কথা বলে না। কারো সঙ্গে কারো দেখা হয় না। তো টান, মায়া, দয়া এগুলো আসবে কোথা থেকে? এই যে অসামাজিকতা এটা আরো জঘন্য পরিবেশ তৈরি করছে। যার কারণে কয়েকদিন উত্তেজনার পর সব থেমে যায়। বোকা মানুষরা মনে করে এবার বিচার হবেই। যেমনটা তারা ঢাকার ঘটনার পরও মনে করেছিল। সবাই ভেবেছিল এবার একটা বিহিত হবে। চারদিকে ঢিঢি পড়ে যাওয়া সমাজ ও দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল যেন। বিচার কী হয়েছে সবাই জানে। শাস্তি যে কতটা হবে আর কার হবে সেও জানা। তাই আর একটি মহড়া হলো বরগুনায়। এবারের নাম রিফাত। যার মানে আপনি হিন্দু না মুসলমান না অন্য কেউ সেটা বিষয় নয়। বিষয় আপনি অসহায়। আপনাকে রক্তাক্ত করার ভিডিও ধারণের লোক আছে। পুরোটাই করবে। কিছু বাদ পড়বে না। কিন্তু বাঁচাতে আসবে না কেউ। রিফাতের স্ত্রী চেষ্টা করেছিলেন। কতভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে। তাতে কারো মন গলেনি। ঘাতকের তো না, ভিডিও ধারণকারী বা মানুষেরও না। এই স্থবির, এই অমানবিক, এই কৃতঘ্ন সমাজ এখন কিছুই করতে পারে না। শুধু দেখে আর হৈচৈ করে। তারপর মেনে নেয়। এমন অপদার্থ সমাজে রাজনীতি ও তার উন্নয়নের কথা হাস্যকর। সমাজ এখন কোন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে? রাজনীতিহীন বাদ-প্রতিবাদহীন গণতন্ত্রে সবকিছু শুধু একজনের ওপর নির্ভরশীল। এমন হলে এ সমাজ বাঁচবে? আমরা বলি না সরকারি দল এসব করছে। বা তারা বলেছে এসব করতে। বিরোধী দল বা কেউ বলেনি। কিন্তু রাজনীতির কাজ কী? সরকারের বাহিনীর দায়িত্ব কী? মানুষ মরার পর কি তারা লাঠি ঘুরিয়ে এসে বীরত্ব দেখাবে শুধু? সমাজ ও রাষ্ট্র নিরাপদ রাখা যাদের কাজ তারা দায় এড়াতে পারেন না। যে সমাজে স্ত্রী স্বামীকে দিবালোকে কুপিয়ে মারতে দেখে বাঁচাতে পারে না সে সমাজে বাদবাকি সব গল্প। মানুষ এখন আর এসব শুনতে চায় না। তার বড় দায় বাঁচার, নিজেকে বাঁচানোর। কোন উন্নয়ন, কোন সমৃদ্ধি চাই আমরা? যা মানুষের কল্যাণ আর নিরাপত্তা দিতে পারে না, তা দিয়ে কি হবে? সব দেশেই দুর্ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনাও বিরল নয়। কিন্তু বারবার? একাধিকবার এক নাটক? এক মহড়া? আমি বলব সামাজিক নিরাপত্তার দিকটা আসলেই কেউ ভাবে না। ডিসকানেকটেড একটা সমাজ আর নষ্ট এক পরিবেশ। রাজনীতি তার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এখন এসব ঘটনা দেশ ও জাতির ভাগ্যলিখন। মানুষ সব জানে। সব বোঝে। কিন্তু তাদের তো করার কিছু নেই। কেউ তাদের কথা শোনেও না। শোনার মতো মানুষ কোথায়? যারা শুনতেন তারা বিগত। যারা শোনার কথা তাদের এখন আখের গোছানো, টাকা কামানোর ধান্দা। তাই সময় থাকতে বোঝার শেষ অনুরোধ জানাই। কখন যে পোষা রাগ ঝড় হয়ে ওঠে কে জানে? কেউ কি মানুষের মনের কথা, ভাষা, রাগ বা দুঃখ বুঝতে পারছে?

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App