×

সাময়িকী

সূর্য ওঠার আগে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০১৯, ০৭:১১ পিএম

থানা কমিটির নেতা হিসাবউদ্দিন এ গ্রামে এসেছিলেন সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে, সম্পর্কে খালাতো ভাই হন, একবার তিনি খোঁজ নিয়েছেন মুজিবুর রহমানের? গাংনী বা মেহেরপুরে দেখা হয়ে গেলে মোটেই অসম্মান করেন না তিনি, হাতে সময় থাকলে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণও করেন, ইন্ডিয়ায় পাশাপাশি গ্রামে বাস ছিল বটে মাখামাখির তো ঘাটতি ছিল না মোটেই; ঘাটতি হয়েছে এপারে এসে রাজনৈতিক বিবেচনার ছাঁকনিতে মানবিক সম্পর্ক ছেঁকে তুলতে গিয়ে।

মুজিবুর রহমান আসলে কোনো প্রকার রাজনৈতিক ডামাডোলে নিজেকে জড়াতে চাননি। ওপার থেকে বিনিময় করে আনা সামান্য জমিজিরেত, ইশকুলের মাস্টারি আর নিজের সন্তানসন্ততি লালন পালন- এর মাঝেই নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। তাই বলে তিনি রাজনীতির মূল ধারার বাইরে বা বিরুদ্ধে তো নিজেকে কখনো দাঁড় করাননি। এরই মধ্যে কখন যে বৃন্তচ্যুত আঙুরের মতো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন, তা যেন এতদিন বুঝতেই পারেননি। হাফিজুর বাড়ি আসার পর থেকে তাঁর এই নিঃসঙ্গতার যেন খানিকটা অবসান ঘটে।

সারাদিন সে যে বাড়ি থাকে এমন নয়, গাংনী কিংবা মেহেরপুরে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়; মুজিবুর রহমানের তবু মানসিক স্বস্তি এই যে- আছে সে, দিনে না হোক রাতে দেখা হবে; তখন আলোচনা করলেই হবে। মনের মধ্যে যখন যে প্রশ্নের উদয় হয়, হাফিজুরকে বলার জন্য তা মনে মনে টুকে রাখেন আর অপক্ষোয় থাকেন- বাড়ি আসুক হাফিজুর। মানসিক এই নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় শেফালিদের বাড়ি বেড়াতে যাবার অনুমতি পর্যন্ত দেননি হাফিজুরকে। অথচ বড় ববুর বাড়ি যাবার জন্য সে একেবারে একপায়ে খাড়া। মেয়েকে দেবার জন্য ডাল বড়ি শুকিয়ে রেখেছে মা, হাফিজুরকে রাজিও করিয়েছে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য, কিন্তু বাবার অনুমতি মিললে তো! সরল যুক্তি তাঁর- দেশের অবস্থা ভালো না, কয়েকদিন পরে যেয়ো।

দেশের অবস্থা যে অতি সহসা ভালো হবার কোনো আভাসই দেখা যাচ্ছে না, বিশেষ করে ২৫ মার্চের এ্যাসেম্বলি স্থগিত ঘোষিত হবার পর সেটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতদিন পর গতরাতে মুজিবুর রহমান হঠাৎ প্রশ্ন করেন ছেলেকে,

এই চার-দফার ব্যাপারটা কী হাফিজুর? হাফিজুরও যেন অবাক হয়, চার-দফা মানে? আহা আমিও তো সেটাই জানতে চাইছি। ছয়-দফা, এগার-দফা গেল, বঙ্গবন্ধু যে এখন চার-দফা আঁকড়ে ধরেছেন, এক চুলও নড়তে চাইছেন না; এই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলো দেখি। এতক্ষণে হেসে ওঠে হাফিজুর, অ। এই চার-দফার কথা বলছেন আব্বা? হ্যাঁ হ্যাঁ, লিডার যে একটুও ছাড় দিতে রাজি নন! ঠিকই তো! ছাড় দেবেন কী করে? এতটা অনমনীয় হলে আলোচনা চলে নাকি? হাফিজুর অবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকায়, চার-দফার মধ্যে কী কী দাবি আছে, সেটা দেখতে হবে না! মুজিবুর রহমান অকপটে স্বীকার করেন, অমি তো সেই কথাটাই জানতে চাইছি। হাফিজুর সহজে বলে দেয়, এ সবই আছে ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্যে। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে এক নজর দেখে নিয়ে সে যোগ করে, আপনি তো সেদিন ঢাকায়। ভাষণ কি মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন আব্বা?

উত্তর দিতে জিহ্বা আড়ষ্ঠ হয়ে আসে মুজিবুর রহমানের। সত্যিকারের কথায় সেদিন তার মাথার ভেতরে উথাল পাথাল ঝড়। ঢাকার জনসমুদ্রে এসে হাফিজুর হাবুডুবু খাবার দশা। তবু সে ভাষণ শুনেছেন বই কি! সে তো মানুষের কণ্ঠ নয়, সিংহের গর্জন। বাপরে বাপ!

সারা গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে, চম্কে চম্কে ওঠে। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক ভাষণের সব কথা কি মনে আছে তাঁর। সব কথা মনে পড়ে না, তবু সেই বেগবান তরঙ্গমুখের স্রোতধারার কথা তো কখনোই ভুল হবার নয়, হাফিজুর তাই জানান,

হ্যাঁ, শুনেছিলাম তো। হাফিজুর আবারও জানায়,

ওই ভাষণের মধ্যেই ঐতিহাসিক ৬-দফা আছে, ১১-দফা আছে; বাঙালির প্রাণের দাবি সব আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আশু করণীয় যে চারটি দাবি, একান্ত জরুরি সেই দাবিগুলোকে বলা হচ্ছে-চার দফা।

মুজিবুর রহমান যেন আলোচনার সূত্রটা বেশ বুঝতে পারেন। তাই নিজে থেকেই বলেন, এক নম্বর দফা হচ্ছে- সামরিক আইন তুলে নিতে হবে। হাফিজুর খুব খুশি হয়ে বলে,

আপনিই বলেন আব্বা, কোনো সভ্য দেশে সামরিক আইন চলতে পারে?

প্রশ্ন করার পর নিজেই উত্তর দেয়- না, পারে না। চলা উচিত নয়। সেই জন্য তাঁর দুই নম্বর দফা হচ্ছে- সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে।

হ্যাঁ, তা তো যেতেই হবে। বাইরে ওদের কাজ কী? গুলি করে মানুষ মারা? বাবার কথার সূত্র ধরে হাফিজুর বলে, সেই জন্য তিন নম্বর দফায় বলা হয়েছে- যে ভাইদের হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। মুজিবুর রহমান আগের কথার সূত্র ধরে বলেন, বন্যেরা বনে সুন্দর, সৈন্যেরা ব্যারাকে। বাবার কথা শুনে হাফিজুর মুগ্ধ হয়ে যায়। নিজে আরো যোগ করে,

ব্যারাকের বাইরে থাকলে ওরা নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করবেই। আর এসব হত্যার কোনো রকম তদন্ত হবে না, বিচার হবে না, তাই কিছুতেই হয়! না, তা হতেই পারে না। হওয়া উচিত নয়।

বাবার কণ্ঠে উত্তর শুনে হাফিজুরও খুব আনন্দিত। দুর্বল ছাত্রকে পড়া বুঝিয়ে শিক্ষকের যে আনন্দ, এ যেন অনেকটা সেই রকম। প্রতিটি দফায় দফায় শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণে শিক্ষকও বেশ উল্লসিত। হাফিজুর অত্যন্ত উৎসাহরে সঙ্গে এবার বলে,

এ সব দফা মিলে হয়েছে এক দফা এবং চূড়ান্ত দফা। কী সেটা? হাফিজুরের সোজাসাপ্টা ঘোষণা- জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ঠিক ঠিক। এটাই আসল দফা। নির্বাচন হয়েছে, ক্ষমতা ছাড়তে হবে, সহজ হিসাব। এই চার-দফা থেকে সরে আসা তো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

ছয়. বাপের বাড়িতে জুঁই সবার ছোট মেয়ে এটা কোনো সমস্যাই নয়, অথচ শ্বশুরবাড়িতে বড় পরিবারের মধ্যে ওইটাই বেশ সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। এমন বিশাল একান্নবর্তী পরিবার আজকের দিনে লুপ্তপ্রায়। মাথার উপরে পাঁচজন ভাসুর, ছয়জন জা। বড়ভাই সন্তানহীনতার অজুহাতে দ্বিতীয় বিবাহ করেন এবং পরে দু’জনেই সন্তান উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। তাদের সন্তানেরা সবাই এই ছোটমায়ের চেয়ে বয়সে বড়। তবু তারা জুঁইকে ছোটমা বলে মান্য করে, সন্তানের মতো আবদার করে।

বিয়ের পর নববধূকে যদি নানি সম্বোধন শুনতে হয়, তাহলে চোখমুখ লাল না হয়ে পারে! অথচ রূপালি তার নাতনিই বটে, বড় ভাসুরের প্রথম পক্ষের হিসেবে সত্যিকারের নাতনি, ক্লাস নাইনে পড়ে, টকাস টকাস করে কথা বলে এমনকি তার ছোট নানা সেলিমকে জড়িয়ে অভব্য ইঙ্গিতও করে। কিছুদিন যাবার পর জুঁই আবিষ্কার করেছে- বড় সংসারের নানামাত্রিক এই সম্পর্কের মধ্যে মুগ্ধ হবার মতো আকর্ষণীয় কিছু দিকও আছে। উপভোগ করতে পারলে তারও নানান রকম মানে হয়, আনন্দের উৎস হয়ে ওঠে। ভালো লাগে।

ঢাকা থেকে ছোটভাই হাফিজুরের আগমন উপলক্ষে সূর্যখোলায় গেলেও জুঁই দুদিনের বেশি থাকতে পারেনি বাপের বাড়ি। মেজো জা জরুরি খবর দিয়ে লোক পাঠালে তাকে চলে আসতে হয চটজলদি। তার শরীর খারাপ। দেশের অবস্থা ভালো না, কখন কী হয় বলা যায় না, তিনি একবার কুষ্টিয়া যাবেন ডাক্তার দেখাতে; সঙ্গে যেতে হবে ছোটবউকে। এমন আন্তরিক আহ্বানের মুখে না বলতে পারে কোনো পাষান! কাজেই হাফিজুর বাড়ি আসার পরদিনই জুঁইকে চলে আসতে হয় শ্বশুরবাড়ি। তখন হাফিজুরের দুই হাত ধরে অনুরোধ জানিয়ে আসে-

কাল পরশু যখনই হোক, তুই একবার আসিস ভাই। হাফিজুর চিমটি কাটে, কোথায়, রাবণের লঙ্কাপুরী? একান্নবর্তী বড় সংসার বলে হাফিজুর বরাবরই জুঁইয়ের শ্বশুরবাড়িকে লঙ্কাপুরী বলে। রাবণের ভাই সেলিমকে কি পাঠিয়ে দেব? আমাকে এ্যারেস্ট করার জন্য পাঠাতে হবে না। তবে সেই ভদ্রলোকের যদি শ্বশুরবাড়ি আসার অভিলাষ হয়, নিশ্চয় তিনি আসবেন। নাটকের ডায়লগ বাদ দে তো ভাই। তুই আসিস। আচ্ছা তুই যা, আমি পিছে পিছে আসছি।

বাড়ি আসার পর থেকে হাফিজুরের তেমন কাজ নেই বললেই চলে। কাজ নেই বলে হাজার কাজে ব্যস্ততা। সকালে উঠে একবার মেহেরপুরে যাওয়াটা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলেজ মাঠে রোভার দলের কুচকাওয়াজে সেও অংশ নেয়। ছাত্রনেতা আব্দুর রশিদ, মেহেদী বিল্লাহ, ইমানুর রশিদের নেতৃত্বে মিছিল যায় শহরে। নির্বাচিত এমএনএ সহিউদ্দীন মিয়ার বাড়ির সামনে মিছিল পৌঁছুলে তিনি যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ছাত্রদের প্রস্তুত থাকতে বলে।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে ইদ্রিস মিয়া, মান্নান মাস্টার, ইসমাঈল হোসেন, নূরুল হক, হিসাবউদ্দীন উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। প্রায় সকলেরই আশঙ্কা- আঘাত ওরা হানবেই যে কোনো দিন, যে কোনো মুহূর্তে। হক সাহেব ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করছেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম-রাজশাহী সব জায়গায় চরম উত্তেজনা। সৈয়দপুরে ঈশ্বরদীতে বিহারীরা বেপোরোয়া নৃশংস হয়ে উঠেছে।

মিছিল-মিটিং সেরে দিনের শেষে গাংনীতে নেমে এ অঞ্চলের খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করে হাফিজুর। থানা শহরের ছোট্ট বাজারের মাঝখানে টেলিফোনের একমাত্র পাবলিক কল অফিসটিকে ঘিরে মানুুষজনের ভিড়। পোস্টমাস্টার আব্দুল মান্নান কলের গানের হ্যান্ডেল ঘোরানোর মতো করে টেলিফোনের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে রিসিভার কানে লাগিয়ে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া-ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করেন। কণ্ঠস্বর সর্বোচ্চ পর্দায় তুলে চিৎকার করেন, কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে চিঁ চিঁ ধ্বনিতে কী যে শুনতে পান তা তিনিই জানেন। অপেক্ষমাণ জনতার মেজাজ মর্জি বুঝেই হয়তো দু’চারটি খবরের টুকরো ছাড়েন। তাই শুনে জনতা মিছিলে নামে। জলিল মিয়ার মিল ঘরে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। ইসমাঈল ডাক্তার, জালালউদ্দীন, রহমান মিয়া, কালু চেয়ারম্যান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ কোত্থেকে যেন খবর পেয়েছেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা শেষ।

শেষ মানে? উত্তেজিত জনতা উচ্চকণ্ঠে জানতে চায় নেতাদের কাছে- আলোচনা শেষ মানে কী? এখন তা হলে কী করতে হবে? ঢাকার অবস্থা কী? আমাদের হক সাহেব কি ফিরে এসেছেন ঢাকা থেকে?

উত্তর আসে অগোছালো। খুব সুনির্দিষ্ট এবং দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য কেউ রাখে না। তবে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ ঠিকই দেয়া হয়। এরপর ছোট ছোট মিছিল নিয়ে মানুষ গ্রামে ফিরে যেতে উদ্যত হয়। হাফিজুরও নিজেদের গ্রামের মিছিলে শামিল হতে যাবে এমন সময় নাইন-টেন পড়ুয়া একটি ছেলে এসে খবর দেয়,

আপনার ছোটবু আপনাকে ডাকছে হাফিজ ভাই।

হাফিজুর বিস্মিত এবং লজ্জিতও। এই গাংনীর উপকণ্ঠেই চৌগাছা গ্রামে ছোটবুর শ্বশুরবাড়ি। সূর্যখোলায় বলে যাবার পরও জুঁই খবর পাঠিয়েছে, যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি হাফিজুরের। তাই বলে গাংনীতে এই মিছিল-মিটিংয়ের মধ্যে খবর পাঠাবে! হাফিজুর ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটিকে প্রশ্ন করে,

আমার ছোটবু ডাকছে! কোথায়? এই তো আমাদের বাড়ি। তোমাদের বাড়ি! হ্যাঁ, আপনার ছোটবু আমার নানি হন। আপনি আসেন আমার সঙ্গে।

এমন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার পরিচয় পাবার পর আর না বলার সুযোগ থাকে না। সাংবাদদাতার সঙ্গে পা বাড়াতেই হয়। কিন্তু হাফিজুরের ভাবনা হয়, কে এই ছেলেটি? আগে কোথাও দেখা হয়েছে কি! কত অবলীলায় বলে দিল- ‘আপনার ছোটবু আমার নানি হন’, কী রকম নানি? জুঁইয়ের বড় জা-য়ের নাতনি আছে বটে একটা, রূপালি তার নাম, কিন্তু সেই রূপালির ভাইয়েরা তো আরো ছোট। হাঁটতে হাঁটতে সে কথা শুধিয়েই বসে,

আচ্ছা, রূপালি তোমার কেমন বোন বলো তো! কেন, আমার খালাতো বোন। আমরা তো এক সঙ্গেই পড়ি। অ। তোমাদের বাড়ি বুঝি এখানেই! হ্যাঁ, এই যে মিল্ঘরের পেছনের পাড়াতেই আমাদের বাড়ি। তোমার নামটাই তো জানা হয়নি এখনো! আমার নাম মিলন। হারুনুর রশিদ মিলন।

তা সেই মিলনের সঙ্গে সঙ্গে ওদের বাড়ি গিয়ে তো হাফিজুর সত্যিই অবাক। নিজের বোন জুঁই তো আছেই, তার বড় জা-য়ের সুবাদেই এখানে আসা। তিনি এসেছেন তার বড়বোনের নাতনি জেসমিনের বিয়ে উপলক্ষে। বিয়ে নয়, বিয়ের দিন পাকা হবে, পাত্র পক্ষ রাজি থাকলে কলেমা পড়িয়েও রাখা যেতে পারে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা, জুঁই এসেছে, তার বড় জা সঙ্গে এনেছে তাই, এই সুযোগে নিজের ছোটভাইকে ডাকিয়ে আনা কি ঠিক কাজ হলো জুঁইয়ের! মিলনের সঙ্গে ওর নানাবাড়িতে ঢুকতেই জুঁইয়ের সঙ্গে দেখা, আদিখ্যেতা করে জড়িয়ে ধরে হাফিজুরকে- এসেছিস ভাই?

পেয়াদা পাঠালে কি না এসে পারা যায়! তবু এখানে আমকে ডেকে তুই ঠিক করিসনি ছোটবু! আমি বাড়ি চলে যাব। মাথা খারাপ! আব্বার কাছে আমি খবর পাঠাচ্ছি। তুই আমার সঙ্গে থাকবি। না না, আমি পরে একদিন আসব তোদের ওখানে। বাজে বকিস না তো! ভেতরে আয়। পরে আসব ছোটবু।

এরই মাঝে জুঁইয়ের বড় জা এগিয়ে আসেন, জিজ্ঞেস করেন, কি রে ছোট, কার সাথে কথা বলছিস? আমার ছোট ভাই হাফিজুরের সঙ্গে বুবু! অ হাফিজ! আয় ভাই, কদ্দিন দেখিনি তোকে। আয়। আজ থাক বড়বু। ঢাকায় গিয়ে খুব সেয়ানা হয়েছিস দেখছি। আয়, ভেতরে আয়।

শেষ পর্যন্ত কোনো আপত্তিই আর টেকে না বড়বুবুর আহ্বানের কাছে। মানুষটির এই এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। বয়সে মায়ের মতোন। তবু বোনের জা বলে বড় বুবু সম্বোধন করতে হয়। কিন্তু সত্যিকারের কথায় তিনি মায়ের মতোই আদর করেন, ভালোবাসেন। সেই কারণেই জুঁই কখনো তার এতটুকু অবাধ্য হতে পারে না। জুঁইয়ের ভাই হাফিজুরই বা হবে কী করে!

সারা দেশ জুড়ে এত যে উথাল পাথাল রাজনৈতিক তরঙ্গ উচ্ছ্বাস চলছে, অসহযোগ আন্দোলন-হরতাল-অবরোধ, এত কিছুর মধ্যে জীবনের স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত দাবি কিন্তু মোটেই থেমে যায়নি। জন্ম আছে মৃত্যু আছে, জীবন আছে বলে জীবনের অতি স্বাভাবিক চাহিদাগুলোও আছে। বৃক্ষ থাকলে কখনো সবুজ পাখনা মেলবে, এতে আর অবাক হবার কী আছে! জেসমিনের বিয়ের আয়োজনও তেমনই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। শৈশবেই হারিয়েছে জন্মদাতা বাপকে। মায়ের সঙ্গে নানাবাড়ি চলে এসেছে কৈশোরে পা রাখার প্রথম ধাপেই। এখান থেইে লেখাপড়া, খেলাধুলা, বেড়ে ওঠা সব কিছু। (চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App