×

সাময়িকী

সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০১৯, ০৭:১৬ পিএম

বাংলাদেশে কামাল লোহানীকে চিনেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। কামাল লোহানী একজন মানুষই শুধু নন, তিনি একটি চেতনার নাম। দুঃসময়ে, রাষ্ট্রীয় দুর্যোগের কালে তিনি কখনোই ঘরে বসে থাকেননি।

বলা হয়ে থাকে ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাবিন্দু, তাই যদি সত্যি হয় তাহলে এ কথা বলতেই হবে- ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই কামাল লোহানী ছিলেন অগ্রসেনা।

কামাল লোহানীকে আমি কামাল ভাই বলেই ডাকি। যদিও বয়সে তিনি আমার চেয়ে এগারো বছরের বড়, তবু আমাদের সখ্য এবং হৃদ্যতা বন্ধুর মতো। কামাল ভাইয়ের সঙ্গে অনেকভাবেই আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। কাজের প্রতি তার যে ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তা আমি খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখেছি। তিনি একবার যে কাজ ধরেন, সে কাজ শেষ না করে কিছুতেই অন্য কাজে হাত দেন না।

‘কথায় এবং কাজের মিল’ বলে বাংলা। ভাষায় একটা বাগধারা প্রচলিত আছে। কামাল ভাই হলেন কথায় এবং কাজের মিলের মানুষ। তার সঙ্গে না চললে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেউ ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। কামাল ভাই সহজ-সরল-সাদা মনের মানুষ সন্দেহ নেই, কিন্তু তার জেদও বড় কম নয়। বিবেকবর্জিত কোনো কাজ কামাল লোহানীকে দিয়ে কেউ কখনো করাতে পেরেছে এমন নজির বাংলাদেশে কেউ-ই দিতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। মিছিলে, মন্বন্তরে, যুদ্ধে- সব সময়ই কামাল ভাই মানবতার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, এখনো তিনি তার কণ্ঠ সোচ্চার রেখেছেন শান্তি ও মানবতার স্বপক্ষে।

১৯৯৬ সালে শাহ এ এম এস কিবরিয়া আর আমি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিএফডিআর) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করি ২৩ চামেলীবাগে। এই প্রতিষ্ঠানে পরে আরো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এসে যোগদান করেন এবং তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে বিএফডিআরকে সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। বিএফডিআর মূলত একটি থিংক ট্যাঙ্ক। অনেক গবেষণাকর্মই সুসম্পন্ন হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় ও আর্থিক সহযোগিতায়।

একবার বিএফডিআর থেকে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নামে বাইশ পর্বের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করার পরিকল্পনা করি আমি। এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজে একবার কামাল ভাইয়ের কাছে যাই প্রামাণ্যচিত্রের গ্রন্থনা ও ধারাবিবরণীতে কণ্ঠ দেয়ার অনুরোধ নিয়ে। কামাল ভাই হাসি মুখে আমার প্রস্তাবে রাজি হলেন। এরপর দিনক্ষণ ঠিক করে কামাল ভাই, আমি আর আশফাক-উল-আলম (বর্তমানে প্রয়াত) কলকাতায় যাই। কলকাতায় গিয়ে আমি আর কামাল ভাই রিসার্চ সেন্টারের গেস্ট হাউসে উঠি, আশফাক উঠে তার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে। আশফাকের শ্বশুর বাড়ি আমাদের গেস্ট হাউসের কাছেই ছিল।

আশফাক দিনের বেলা আমাদের সঙ্গে থাকতেন, প্রামাণ্যচিত্রের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করতেন, আর রাত হলেই ঘুমুতে যেতেন শ্বশুরালয়ে। গেস্ট হাউসেই একদিন কামাল ভাই গল্পের ছলে তার জীবনের অনেক লড়াই-সংগ্রামের কথা আমাকে বলেন। কলকাতার গেস্ট হাউসে বসেই আমি প্রথম জানতে পারি- কামাল ভাইয়ের আসল নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। বাবার নাম আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা। খান লোহানী এবং মায়ের নাম রোকেয়া খান লোহানী। তাদের আদি বসতি ছিল যমুনা পাড়ে খাস কাউলিয়ায়। আগ্রাসী যমুনা গর্ভে তাদের বাড়িঘর, জমি-জিরেত চলে যাওয়ার পর তার পূর্ব পুরুষ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। নব-বসতি খান সনতলা গ্রামেই কামাল ভাই জুন মাসে জন্মগ্রহণ করেন।

বাংলা সন মোতাবেক আষাঢ় মাসে। শৈশবেই কামাল ভাই মাতৃহীন হন। মায়ের মৃত্যুর পরেই কামাল ভাইয়ের জীবনে শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। সেই লড়াই কামাল ভাই এখনো অবিরাম করে যাচ্ছেন, কামাল ভাই লড়াইয়ের মানুষ, আপসকামিতা তার স্বভাবে নেই, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়াই তার চিরদিনের অভ্যাস। বলছিলাম কলকাতার কথা।

আবার সেখানেই ফিরে আসি। আমরা রাতদিন পরিশ্রম করছি। প্রামাণ্যচিত্র সম্পাদনার কাজে। এরপরে কামাল ভাইয়ের কণ্ঠ দেয়ার সময় এলো, কিন্তু বিধি বাম হলো। কামাল ভাই জ্বরে আক্রান্ত হলেন, এমন জ্বরে পড়লেন যে, তার পক্ষে কাজ করাই অসম্ভব হয়ে পড়লো। আমি ভাবলাম এ যাত্রায় বুঝি আর কামাল ভাইয়ের কণ্ঠ ধারণ করা সম্ভব হবে না। আবার আসতে হবে কলকাতায়। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম।

আমার ভেতরে চিন্তা থাকলেও আমি তা কামাল ভাইকে বুঝতে দিলাম না। একদিন কামাল ভাই আমাকে বললেন- ‘মোনায়েম, আমাকে নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই, জ্বর হোক আর যাই হোক, যেই কাজে এসেছি সেই কাজ না করে কিছুতেই ফিরে যাবে না। আমার প্রামাণ্যচিত্রে শরীরে জ্বর নিয়েই কামাল ভাই কণ্ঠ দিলেন। আমরা তিনজন কলকাতার কাজ শেষ করে আবার ঢাকায় ফিরে এলাম। ঢাকায় এসে কামাল ভাইয়ের কণ্ঠ ধারণ করার অভিজ্ঞতা আমি যাদের কাছে বলেছি তারা মোটামুটি প্রত্যেকেই বলেছে, কামাল লোহানী না হলে সেবার আমার কাজ নিশ্চিত আটকে যেতো। এখানে উল্লেখ না করে পারছি না, আমার প্রামাণ্যচিত্রের পারিশ্রমিক বাবদ কামাল ভাই একটি টাকাও আমার কাছ থেকে নেননি।

কামাল ভাই কোনো দিন কোনো কিছুতেই আটকাতে জানেন না। যখনই তার সামনে কোনো বাধা এসেছে, তিনি তা স্বীয় সাহসে ভর করে ডিঙিয়ে গেছেন। জীবনযুদ্ধে তিনি কখনোই নৈতিক স্খলনকে প্রশ্রয় দেননি, বারবার তাকে কর্মক্ষেত্র বদলাতে হয়েছে, বারবার তাকে নানা অজুহাতে আটকে রেখেছে বিভিন্ন সরকার। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হওয়ার পরেও কামাল ভাই এক জায়গায় এক পরিবেশে বেশি দিন কাজ করার সুযোগ পাননি, কেন তিনি বারবার পেশা বদলাতেন- সে কারণ দূর থেকেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারতাম বলে তাকে কখনো সরাসরি জিজ্ঞেস করিনি। কামাল ভাইয়ের বড় কীর্তি হলো দুঃখের দিনেও তিনি প্রাণ খুলে হাসতে পারেন, অমনভাবে যিনি হাসতে পারেন তার জীবনে কান্না কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কামাল ভাইয়ের জীবনেও বিষাদ কখনো গভীরভাবে দাগ বসাবার সুযোগ পায়নি।

কামাল লোহানীর পরিচয়ের কোনো শেষ নেই, তিনি একজন সাংবাদিক, সংগঠক, অভিনেতা, আবৃত্তি শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী এবং সুলেখক। কামাল ভাইয়ের যতগুলো বই এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই আমাদের বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের লাইব্রেরিতে সযত্নে আছে। যখনই তার লেখা কোথাও দেখি তখনই আগ্রহ নিয়ে পড়ার চেষ্টা করি, তার লেখা পড়তে আমার ভালো লাগে। তিনি যে চেতনার জায়গা থেকে কথা বলেন, আমিও সেই চেতনা ধারণ করি বলেই হয়তো তার জীবনের অনেক কিছুই আমি সহজে গ্রহণ করতে পারি।

কামাল ভাই সুযোগ পেলেই দেশ, জাতি ও মানুষকে কিছু দিতে চেয়েছেন। এখনো তার দেয়ার ইচ্ছা এবং শক্তি দুটোই সক্রিয়।

কামাল ভাইয়ের বয়স হলেও মনের জোর বিন্দু পরিমাণ কমেনি। তার বিশেষ পোশাক বাংলাদেশের মানুষের কাছে ট্রেডমার্কের মতো। তিনি যখন পাজামা-পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় বের হন- মিছিলের পুরো ভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন- তখন বুঝতে পারি কামাল ভাইয়ের ‘বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। কামাল ভাই দীর্ঘজীবী হোন, তার স্বাস্থ্য অটুট থাকুক, চিন্তা ও কর্ম নির্মল থাকুক এই কামনাই করি।

জন্মদিনে কামাল ভাইকে হাসিমুখে শুধু এ কথাই বলতে চাই- আপনি আছেন বাঙালির কর্মে ও মর্মে, আমার ভয় নাই, আপনার লয় নাই। আর মাত্র চৌদ্দ পেরুলেই শতক। আপনার জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অপেক্ষায় থাকলাম।

শুভ জন্মদিন, কামাল ভাই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App