×

সাময়িকী

বাবুরেও লইয়া যাইবেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০১৯, ০৭:১০ পিএম

বাবুরেও লইয়া যাইবেন

আমি শফিকুর রহমান। বয়স প্রায় চল্লিশোর্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে বেশ কয়েক বছর বেকার জীবনযাপন করি। সরকারি প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষায় বেশ কয়েকবার অবতীর্ণ হয়েও শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের শিকা আমার বরাতে ছিঁড়েনি। আমি একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ভালো পজিশনে চাকরি করি। আমার বৈবাহিক জীবনের ইতিবৃত্ত এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়। আমার স্ত্রীর কার্যপরিধির বিস্তার তার ঘরেই সীমিত। যদিও সে স্নাতক ডিগ্রিধারী, তবে এ কথা সত্য যে ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো সে চাকরি খুঁজেছিল সত্য। কিন্তু যথার্থ চাকরি না পেয়ে সে বর্তমানে একজন সুগৃহিণী বটে।

আমার দুটি পুত্র সন্তান। বড়টি মালয়েশিয়াতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আর কনিষ্ঠ সন্তানটি ঢাকায় একটি সরকারি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ছোট ছেলেটি তুলনামূলকভাবে বেশি মেধাবী ছাত্র। পরীক্ষার ফলাফল বরাবর ভালো। মাঝে মাঝে মনের হেঁয়ালিতে সে ক্রিকেট খেলে থাকে। খেলোয়াড়ের চেয়ে সে একজন ভালো খেলার দর্শক। অনেকটা আমার মতো। প্রণোম্মাদনায় উদ্দীপ্ত খেলোয়াড় নয়, কেমন যেন বুড়োটেভাব।

মনে হয় ভবিষ্যতে একজন বড় বুদ্ধিজীবী হবে। তবে আমার বড় ছেলেটি বলতে গেলে অনেকটা নিমরাজি হয়েই বিদেশে পাড়ি জমায়। লক্ষ্য একটাই মধ্যবিত্ত আটপৌরে জীবনের কাক্সিক্ষত স¦প্ন একটা ভালো চাকরি। তাই সে সোনার হরিণ ধরার প্রস্তুতি নিয়ে মালয়েশিয়ায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে অ্যাডমিশন নিয়েছে। কিন্তু সে নাম যশের ক্ষেত্রে খুবই উচ্চাভিলাষী। তার প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল সে একজন মুথিয়ামুরুলি ধরনের মতো বিশ্বখ্যাত স্পিন বোলার হবে। তার এই স্বর্ণোজল খ্যাতির স্বপ্নচূড়ায় আরোহণের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক ছিলাম আমি। সে সব সময় আমাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায় এই চার্জ এনে যে, কেন আমি তাকে সাভারে বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে দিলাম না।

যদিও আমি তাকে পড়ালেখার পাশাপাশি কলাবাগান ক্রীড়াচক্রে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম বটে কিন্তু তার মতামত হলো খণ্ডিত লক্ষ্য নিয়ে কোনোদিনও সফলতা অর্জন করা যায় না। একনিষ্ঠ একাগ্রতা নিয়ে কায়মনোবাক্যে লক্ষ্যাভিসারী না হলে কোনোদিনও লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। মালয়েশিয়ার প্রবাসী ছাত্র জীবনে সে প্রায়শ আমার কাছে মোবাইল ফোনে কথা বলে।

বিশেষ করে যখন বাংলাদেশে বিদেশিদের সাথে বিপিএলের ম্যাচ থাকে। মোবাইল ফোনে সেই একই পুরনো অভিযোগের চর্বিতচর্বণ। আমি অনেক সময় বিরক্ত হয়ে তাকে বলি ‘পড়ালেখা ঠিকমতো চলছে তো’? সেও প্রত্যুত্তর আমাকে ততধিক বিরক্তভরে বলে, ‘পড়ালেখার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি যা চেয়েছিলে আমি তোমাকে তাই করিয়ে দেখিয়ে দিব’। তারপর বিপুল অক্ষেপে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলে, ‘ কিন্তু আমি যা হতে চেয়েছিলাম তা তুমি আমাকে হতে দিলে না। আমি তোমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করব না।’

আমি ওর এই পরিণতির জন্য অনেক সময় নিজেকে দায়ী করতাম। নিজের মধ্যে একটি স্নায়বিক অপরাধবোধ সব সময় আমার মনকে বেদনাদীর্ণ করে তুলত। হৃদয়ের উদ্গত অশ্রুতে চোখ সজল হয়ে উঠত।

সাভারে আমার শ্বশুরবাড়িতে এসে পুত্রার্থেকৃয়ত একই সমস্যার আবার মুখোমুখি হলাম। আমার শ্বশুর একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তার দুটি মেয়ে। বড় মেয়েটিকে আমি বিয়ে করেছি। কনিষ্ঠা মেয়েটি সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে মাস্টার্সের ছাত্রী। সে অবিবাহিতা। আমার শ্বশুর মহাশয় তার সমগ্র চাকরি জীবনে অর্জিত অর্থ তথা পেনশন আর প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনতলা দুই ইউনিটের একটি বাড়ি তৈরি করেছেন। তার ব্যাংক কলোনির বিশ শতাংশ বাড়ির আঙিনাটা বেশ বড়ই ছিল। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে খুব সস্তায় তিনি এ জমিটি কিনেছিলেন। আঙিনার শেষ প্রান্তে আধাপাকা টিনশেডের কয়েকটি ঘর করেছেন। তাতে ভাড়াটিয়ারা ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কয়েকটি পরিবার। কেউ বা ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বা গার্মেন্টস এর শ্রমিক আবার কেউ ছিল দরিদ্র ভ্যানচালক।

সব জায়গাতেই পৃথিবীর সেই আদি ঘৃণ্য বর্গভিত্তিক শোষক আর শাসিতের অত্যাচারের নির্দয় খেলা। মার্কস এঙ্গেলসের সেই শ্রেণি সংগ্রামের দ্বন্দ্ব। ‘তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে, আমি রহিব নিচে, অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভাবনা আজ মিছে’। আমার শ্বশুর মহাশয়ের এই মাঠটিতে কেবল এ বাড়ির ছেলেমেয়েরাই খেলাধুলা করে থাকে। টিনশেড ঘরের ভাড়াটিয়াদের ছেলেরা এখানে খেলত না। হয়তোবা কোনো অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিংবা নিজেরাই এখানে খেলতে দ্বিধাবোধ করত। সেই দীনবন্ধু মিত্রের নীল চাষিদের ছেলেদের মতো। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে এ নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছিলাম।

তবে এ বাড়িতে বসবাসকারী সবগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এখানে খেলাধুলা করলেও সব সময় দেখতাম একটি সুঠামদেহী তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলে কখনোই খেলতে আসত না। অথচ খেলোয়াড়রা হলে সে হয়তো নিশ্চয় ভালো করত। কারণ বডিফিটনেস তার ভালো ছিল। কেবল দূর থেকে এককোণে তাদের ঘরের ফটকে দাঁড়িয়ে সে নীরবে খেলা দেখতো। খুবই একাগ্রচিত্তে। খেলায় অংশগ্রহণের চেয়ে খেলা দেখতেই বোধকরি সে বেশি আনন্দ পেত।

আমার মনে হতো হয়তোবা ওর ওপর কোনো অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। অথচ ওকে দেখে আমার মনে হতো, খাঁচার ভিতর পাখিটি রয়েছে বটে কিন্তু চোখটি তার সব সময় আকাশের দিকে। ছেলেটি বাড়ির অন্য ছেলেদের সঙ্গে পারতপক্ষে কোনো কথাই বলত না। তবে ভীষণ কৌতূহলোদ্দীপক দৃষ্টিতে সব ছেলেদের খেলাই সোৎসাহে বেশ খুশি মনে উপভোগ করত। আমার ছেলেও এবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে খেলায় অংশগ্রহণ করত। আমার ছেলেকে ও মনে হয় খব পছন্দ করত। কারণ আমার ছেলে ওরই সমবয়সী ছিল।

এ ছাড়া ও বোধ হয় এও জানত আমার ছেলে এই বাড়িওয়ালার সন্তান। একদিন সকাল দশটা-এগারোটার দিকে হবে যখন আমি আমার পরিবারসহ ঢাকায় যাবার উদ্যোগ গ্রহণ করছি মাঠে তখন কেউ ছিল না। সেই ছেলেটি আমার কাছে এসে বেশ দৃঢ়পায়ে দাঁড়াল। মনে হয় বহুদিনের সাধনায় রপ্তকরা প্রচেষ্টার সুফল ফলশ্রুতিস¦রূপ প্রাণপণে সব শক্তি একীভূত করে দুর্দমনীয় সাহস অর্জন করে স্থলিত কণ্ঠে আমাকে বলল ‘বাবুরেও লইয়া যাইবেন’? আমি স্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ তোমার নাম কী বাবা’?

-রুবেল মিয়া। -তুমি স্কুলে পড়? -হ্যাঁ পড়ি। -কোন স্কুলে? -সাভার অধরচন্দ্র হাই স্কুলে। -কোন ক্লাসে? -ক্লাস সেভেনে। -তুমি এ বাড়ির ছেলেদের সাথে খেলা কর না কেন? -এরা বড় লোক। মায় এদের সাথে খেলতে দেয় না।

প্রত্যুত্তরে আমি ওকে যথেষ্ট অভয় দিয়ে বললাম, ‘তাতে কী তুমিও তো ওদের মতো স্কুলে পড়’।

আমি ছেলেটিকে এ বাড়ির ছেলেদের সাথে খেলা করার ব্যবস্থা করে দিতে চাইলেও সে কখনো খেলতে চাইত না। একদিন আমি ও আমার পরিবারে সদস্যদের নিয়ে আর সেই এ বাড়ির ভাড়াটিয়া কয়েকজনকে নিয়ে পিকনিকে গেলাম। অনেক অনুরোধ উপরোধ করে রুবেল মিয়ার মার অনুমতি নিয়ে তাকেও সঙ্গে নিলাম। শর্ত একটাই রুবেল মিয়া যেন খেলাধুলা না করে। কারণ তার ডান পায়ের হাঁটুতে সমস্যা আছে। একবার ক্রিকেট খেলতে গিয়ে তার হাঁটুর হাড় ভেঙে গিয়েছিল। শুধু যে রুবেলের মা তার ছেলের হাঁটু ভাঙার অজুহাতের জন্যই তাকে খেলতে দেয় না তা কিন্তু নয়। এর নেপথ্যে আরো কাহিনী আছে। যা না বললেই নয়।

রুবেলের নানা বাড়ি ও দাদাবাড়ি মাদারীপুরের কালকিনী উপজেলার কোনো এক গ্রামে। রুবেলের মা আমিনা মোটামুটি ভালো গৃহস্থ বাড়ির সন্তান। আমিনা ভালোভাবেই এসএসসি পাস করে কালকিনী আবুল হোসেন কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু তার আর কলেজে পড়া হলো না। প্রেমের টানে সাড়া দিতে গিয়ে সে পার্শ্ববর্তী বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় সলিম মিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। সলিম ছিল হতদরিদ্র ঘরের একজন অশিক্ষিত সুঠামদেহীর যুবক। আমিনা বেগম একপ্রকার বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রচণ্ড অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও সে তার বাবার বাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে সলিম মিয়ার হাত ধরে চিরদিনের জন্য রাতের আঁধারে অজানার দেশে পালিয়ে গিয়েছিল। সাভারে এসে আমিনা বেগম ও তার স্বামী একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেয়। যোগ্যতানুযায়ী আমিনা কাটিং শাখায় হেলপারের চাকরি নেয়। আর সলিম মিয়া সাধারণ শ্রমিকের খাতায় নাম লিখায়। শুরু হলো নুন আনতে পানতা ফুরানোর মতো। দারিদ্র্যাকীর্ণ যাপিত জীবনের পালাবদলের অনাকাক্সিক্ষত পর্ব।

আমিনা তার যোগ্যতায় ভর করে কাটিং মাস্টারের পদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল। কিন্তু সলিম মিয়া শত চেষ্টা করেও সবক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়ে মাকাল ফলের নাম ধারণ করল। আগে গ্রামের ফুটবল ম্যাচে হায়ারে খেলতে গিয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করত। কিন্তু এখানে তাও নেই। এখানে সবাই শুধু ক্রিকেট খেলে। ক্রিকেট রাজকীয় খেলা। সে এখানে নিতান্তই অপাঙ্ক্তেয়। আর যায় কোথায়? দারিদ্র্যের দশ মুখ স্বামী-স্ত্রীতে প্রায় মনোমালিন্য আর ঝগড়াঝাটি শুরু হয়।

আমিনা তার ছেলেকে কিছুতেই খেলাধুলা করতে দিবে না। তার মামাদের মতো অনেকগুলো পাস দিয়ে তাকে বড় চাকুরে হতে হবে। একেবারে ধুনুর্ভঙ্গপণ। যার ফলশ্রুতিতে রুবেল মিয়া কারো সাথে খেলা করে না। অথচ সে পিতার মতোই খেলাধুলায় একেবারেই পাক্কা প্লেয়ার। কিন্তু বিধিবাম, তার মা একেবারেই নেতিবাচক। আমি একটা বড় বারো সিটের মাইক্রোবাস ভাড়া করেছিলাম পিকনিকে যাব বলে।

গন্তব্য ছিল দোহারের পদ্মার পাড়। জুলাভাতি পার্টি সবাই সমভিব্যহারে দোহারে পদ্মার পাড় মৈনট রিসোর্টে। আমাদের গাড়ি কলাকোপা বান্দুরা হয়ে মৈনট ঘাটে এসে পৌঁছে। আমি নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম। সেই শৈশবে পদ্মার স্টিমার অর্থাৎ রকেট স্টিমার করে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং, ভাগ্যকুল ও জশিলদা হয়ে মৈনট যেতাম। আমার নানাবাড়ি দোহারে। যতই পদ্মার নিকটবর্তী হচ্ছিলাম রুবেল মিয়ার সাথে আমার ততই আন্তরিকতা বেড়ে যেতে লাগল। সেও তার ছোট্ট জীবনের বীরগাথা আমার কাছে সোৎসাহে অকপটে নিবেদন করতে থাকল। সে একজন ভালো সাঁতারু। তার গ্রামের আড়িযাল খাঁ নদীতে জুনিয়র স্কুল প্রতিযোগিতায় একবার সে প্রথম হয়েছিল। ক্রিকেট খেলায় জুনিয়র স্কুল প্রতিযোগিতায় সে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিল। আরো কত কী। সেই ছোট বেলায় সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প পালামৌতে পড়া, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’।

রুবেল মিয়ার মতো পদ্মাপাড়ে এসে আমার মনটা আনন্দোল্লাসে মেতে উঠল। আমিও ওদের সাথে দশ ওভারের একটি প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ খেললাম। রুবেল মিয়া এই ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলো। আমি রুবেল মিয়াকে বললাম; ‘এই ম্যাচের বিজয়ের ট্রপি হিসেবে তোমাকে আমি সাভার বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে দেব’।

সে যারপরনাই খুশি হয়ে বলল, ‘ তাহলে আমি সাকিব আল হাসানের মতো বিপিএল খেলতে পারব’? আমি বললাম, ‘নিশ্চয় কেন নয় সে দারুণ খুশি হয়ে বলল, ‘তাহলে তো আমি সাকিব আল হাসান হয়েই যাব। অনেক টাকা পাব’। প্রত্যুত্তরে আমি ওকে বললাম, ‘তুমি এত টাকা দিয়ে কী করবে’? ও বলল, ‘আমি আমার গ্রামে একটা স্টিডিয়াম বানামু। যাতে আমাগো গেরামের হক্কলে ওই স্টিডিয়ামে খেলতে পারে’। তারপর একটু সন্দিহান দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে আমাকে বলল, ‘আঙ্কেল সত্যিই তো আমি বিকেএসপিতে ভর্তি হইতে পারুম’?

আমি তাকে যথেষ্ট সাহস দিয়ে বললাম, ‘কেন পারবে না, নিশ্চয় পারবে’। ও অনেকটা হতাশাপূর্ণ কণ্ঠে বলল, ‘মায় যদি আমারে খেলতে না দেয়’? আমি বললাম, ‘আমি তোমার মাকে সব বুঝিয়ে বলব, যে এখানে খেলাধুলার পাশাপাশি পড়াশুনাও করতে পারবে। তোমার বাবা রাজি তো’? ও উৎসাহ ভরে বলল, ‘বাজানতো সব সময় চায় যে আমি বাজানের মতো খেইলা মেডেল জয় করি। খালি মায় খেলতে দেয় না’!

আমার মনে হলো, আমি কত হতভাগা বাবা, রুবেলের বাবার মতোও হতে পারলাম না মনে মনে স্থির করলাম আমি আমার বড় ছেলেকে বিকেএসপিতে ভর্তি না করিয়ে যে ভুল করেছিলাম এখন তার প্রায়শ্চিত করব। আমি রুবেলকে বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে দিব। আমার মনে এতদিন যাবৎ যে অপরাধবোধ আমাকে নীরব ঘাতকের মতো অনেকদিন ধরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল বুঝিবা এবার তার কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

আমরা সবাই মাইক্রোবাসে চড়ে পদ্মার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, আর আবৃত্তি করছি ‘‘নমো নমো সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি, গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি’। রুবেল সোল্লাসে নাচতে নাচতে যখন মাইক্রোতে উঠতে যাচ্ছিল বুঝিবা তার মায়ের সম্মতিটা পেতে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। তার আর কিছুতেই তর সইছিল না। পড়ালেখা যখন করা যাবে তখন তার মা নিশ্চয় সম্মতিটাও তাকে দিয়ে দিবে। ঠিক তখনই একটা অঘটন ঘটল, গাড়িতে উঠতে গিয়ে তার যে পায়ে ব্যথা ছিল সে পাটি হঠাৎ ফসকে যায় ফলে সে মাটিতে পড়ে গেল। আমরা তাকে দোহার উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। ডাক্তার বলল, ‘ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ভালো আর্থোপেডিক ডাক্তার দেখাতে হবে’। আজকের সব আনন্দই হরিষে বিষাদ।

আমরা যথারীতি সাভারে ফিরে এলাম। সমস্ত ঘটনা আদ্যন্ত জেনে রুবেলের মা অগ্নিশর্মা কণ্ঠে আমাকে বলল, ‘যা মনে করছিলাম তাই অইলো! আপনে আমার পোলাডারে শেষ কইরা ফেললেন। আর এহেনে থাকন যাইবো না। এইহানে থাকলে আপনের কুসংসর্গে আমার পোলাডা শেষ অইয়া যাইবো। অর বাপের মতো অশিক্ষিত বলদ অইবো।’

আমি রুবেলের মাকে সমস্ত সমস্যা সমাধানের দায়ভার গ্রহণ করব বলে শতকোটিবার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা নিতান্তই তপ্ত কড়াইতে এক ফোঁটা ব্যর্থ জলোচ্ছ্বাসের মতোই মনে হলো।

সপ্তাখানেক পরে জানলাম আমিনা বেগম তার পরিবারবর্গ নিয়ে সাভারের আড়পাড়ায় অন্যত্র ভাড়া বাড়িতে চলে গেছে। বিপদের ঘনঘটা এখানেই শেষ নয় আমিনা তার স্বামী যে গার্মেন্টসে চাকরি করত সেখানে আগুন লেগেছিল। অনেক মালামাল আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। সেই আগুনের অদৃশ্য লেলিহান শিখা আমাকেও বুঝিবা স্পর্শ করল। আমার সপ্নের অবসান হলো। রুবেলকে আর বড় আর্থোপেডিক ডাক্তার দেখানো হলো না। সাকিব আল হাসান বানানো গেল না। আমার প্রায়শ্চিত্ত করার শেষ সুযোগটাও নষ্ট হয়ে গেল। আমার ছেলে বোধ হয় আমাকে আর কখনো ক্ষমা করবে না। এখনো শ্বশুরবাড়ি থেকে ঢাকায় যাওয়ার সময় আর সেই মাঠটির দিকে চেয়ে দেখি না। সেই মাঠটিতে এখনো কত ছেলেরা খেলা করে কিন্তু রুবেলের মতো কেউ আর আমার কাছে এসে কখনো বলে না ‘বাবুরেও লইয়া যাইবেন’?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App