×

সাময়িকী

কীর্তিমান পুরুষ কামাল লোহানী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০১৯, ০৭:১৮ পিএম

কীর্তিমান পুরুষ কামাল লোহানী

কামাল লোহানী আমাদের দেশে কীর্তিমান পুরুষ, যিনি কালের পরিক্রমায় নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছেন। তিনি দেশে অনেক মানুষের কাছে লোহানী ভাই নাম খ্যাত কিন্তু ছয়ের দশকের প্রথম দিকে যখন তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়; তখন থেকে মনের টানে তাঁকে পোশাকী নামে সম্বোধন না করে; কামাল ভাই নামে ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম।

যখন আমি তাঁকে প্রথম দেখি, তখন থেকেই আমার রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য শ্যামার বজ্রসেনের মতোই মহেন্দ্র নিন্দিত কান্তিময় মনে হয়েছিল এবং পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালায় ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চায়িত হয়েছিল। সেই নৃত্যনাট্যে কামাল লোহানীকে বজ্রসেনের ভূমিকায় এবং মন্দিরা নন্দীকে শ্যামার ভূমিকায় দেখে অভিভূত হয়েছিলাম।

এর আগে জানতে পারিনি যে, কামাল ভাই একজন নৃত্যশিল্পী। ঢাকায় আসার পরপরই কামাল ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ঘটে, শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমার আগ্রহ ও লগ্নতার কারণে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬০ সালে বিএসসি ক্লাসে ভর্তি হই। আমি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ঢাকায় আসি। প্রথম দর্শনে আমি কামাল ভাইয়ের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করি। ঢিলা পায়জামা ও সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষটিকে আমার কাছে শুভ্রতার সুস্মিত প্রতীক মনে হয়েছিল এবং পাশাপাশি সংস্কৃতিবান এই মানুষটিকে মনে হয়েছিল মৃত্তিকা লগ্ন, দেশ প্রেমিক ও মানব প্রেমিক এক ঋত্বিক পুরুষ।

আমি মনে মনে কামাল ভাইকে আমার পথ প্রদর্শক হিসেবে হৃদয়ে গ্রহণ করেছিলাম। এই নির্ভেজাল চরিত্রের সাদাসিধে মানুষটিকে আমাদের বাংলা মায়ের প্রকৃষ্ট সন্তান কীর্তিমান পুরুষ বলে আমাদের মনে হতো। আমি তাঁর অন্যতম ভক্ত হয়ে উঠেছিলাম। আজ আমি এই পরিণত বয়সে এ স্বীকারোক্তি দিচ্ছি। সেদিন এই কথাটি বলতে পারিনি যে, কামাল ভাই আপনি আমার মনের মতো মানুষ, যাকে পথ প্রদর্শক নেতা হিসেবে আনন্দচিত্তে গ্রহণ করা যায়। আমি গুরুবাদে বিশ্বাস করি না। কামাল ভাই আর আমি যৌবনে যে রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছিলাম তাতে গুরুর কোনো স্থান ছিল না। সেখানে কেবলমাত্র স্থান ছিল সহযোদ্ধা ও সহকর্মীর। তাঁর সংস্কৃতি লগ্নতা, মুক্ত চিন্তা, দেশপ্রেম ও মানব প্রেম দেখে আমি জানতে চেষ্টা করিনি ওনার পেশা কি? কীভাবে ওনার সংসার চলে? পরে জেনেছিলাম, উনি পেশায় একজন জাঁদরেল সাংবাদিক। পরে আরো জেনেছি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে উনি কোনোদিন নীতির প্রশ্নে আপস করেননি।

স্মৃতি যুগপৎ বড় আনন্দের ও কষ্টের হয়। দুঃখ হয় এই ভেবে যে, ছয় আর সাত দশকের উদ্বেলিত সময়টাকে আর কোনোদিন খুঁজে পাব না; কামাল ভাইয়ের ছত্রছায়ায় আইয়ুব খান। তথা পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের সময়টাকে। আমাদের যৌবনের তখন উত্তাল সময়। আমরা তখন জানতাম আমাদের শত্রু কে বা কারা?

কামাল ভাইয়ের বাসায় ছিল, আমার নিত্য আসা-যাওয়া। অনেক সময় দুপুরের খাবারসহ তাঁর বাসায় বিকেলের নাস্তা করেছি। খুব সম্ভবত তাঁর বাসা ছিল তখন পল্টনে। তাঁর বাসার লাল সিমেন্টের ঝকঝকে ফ্লোরে বসেই আমরা আড্ডা দিয়েছি সকালে, বিকেলে, দিনের পর দিন। দীপ্তি ভাবির স্নেহ ছায়া আমাদের ছিল বড় আশ্রয়স্থল। আমাদের প্রায় সব সময় চা-নাস্তা খাবার আবদার উনি হাসিমুখে সহ্য করতেন। উনি ছিলেন সর্বংসহা ধরীত্রির মতো। উনি অকালে চলে গেলেন, আমরা স্বজনরা তাঁর প্রয়াণে খুব দুঃখ বোধ করেছিলাম। কামাল ভাই ও দীপ্তি ভাবি দম্পতির তিন ছেলেমেয়েকে আমি খুব ছোট দেখেছি। সাগর লোহানী আজ তরতাজা যুবক; তাকেও আমি খুব ছোট দেখেছি। বন্যা ও উর্মি তখন খুবই ছোট ছিল। উর্মিকে আমি ফ্লোরে হামাগুড়ি দিতে দেখেছি।

বর্ধিত বয়সে অনেক স্মৃতি হারিয়ে যায় অথবা ম্লান হয়ে যায় কিন্তু আমার স্মৃতিগুলো কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর ‘ডেফোডিল’ কবিতার সে ফুলের মাঠের মতো অবকাশে ও অলস মুহূর্তে আমার মনের মণিকোঠায় ময়ূরের পুচ্ছ বিস্তার করে। কামাল ভাই তাঁর পার্থিব জীবনের ৮৬ বছর পূর্ণ করবেন। আমিও তাঁর অনুগামী হয়ে আছি- চলেছি পিছে পিছে। আমি ৭৮ বছর ছুঁই ছুঁই করছি। আমাদের জীবনের যুদ্ধগুলো এখন সোনায় মোড়ানো পাতের মতো মনে হয়। কামাল ভাইয়ের অনুসারী হয়ে আমরা মৃত্তিকালগ্ন জনগণের সংস্কৃতি চর্চায় ছিলাম নিয়োজিত।

কামাল ভাইয়ের অনুগামী হয়ে আমি তাঁর সৃষ্ট ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীতে যোগদান করি। ক্রান্তি ছিল জনগণের কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত একটি শিল্প-সৃজনের প্রতিষ্ঠান। মার্কসবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যবৃন্দ। আমার নাট্য প্রীতির উদ্ভব ঘটেছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন থেকেই। তাঁর নির্দেশিত ‘আলোর পথযাত্রী’ নাটকে আমি আর সুলতানা রেবু প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। পল্টন ময়দানে হাজার দর্শক সেই নাটকের মঞ্চায়ন দেখেছিল এবং প্রশংসা করেছিল। মনে আছে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর প্রযোজনায় এবং প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী আমানুল হকের নির্দেশনায় জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে বিপুলভাবে দর্শক নন্দিত হয়েছিল। আমি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর ব্যানারে আব্দুল্লাহ আল মামুন রচিত ও নির্দেশিত কাব্য নাটক ‘শপথ’-এ অভিনয় করে কিছুটা প্রশংসিত হয়েছিলাম। আমি যুদ্ধের ভূমিকায় ও সুলতানা রেবু শান্তির ভূমিকায় অভিনয় করেছিল।

কামাল লোহানী সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী এবং দেশ প্রেমিক পুরুষ হিসেবে অনন্য। তাঁর তুলনা কেবল তিনিই। তিনি দেশের সাধারণ জনগণের কথা ভাবতেন এবং তাঁর জীবনের সব কর্মকা- সাধারণ মানুষের মঙ্গলে নিয়োজিত ছিল এবং আজো অব্যাহত আছে।

১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কামাল ভাইয়ের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌরবজনক। উনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন। দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ ছাড়া নানা কথামালার অনুষ্ঠানসহ সংবাদ পাঠ ও কবিতা আবৃত্তিতে উনি নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করতেন।

১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর কামাল লোহানী ঢাকা বেতারের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আমি তাঁর শাহবাগের অফিস একাধিকবার গিয়েছি। পায়জামা ও পাঞ্জাবির ওপর শীতের দিনে চিকন পাড়ের পশমী শাল গায়ে দিয়ে উনি অফিস করতেন। এর আগে স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম হোটেল পূর্বাণীতে। তাঁর সাথে ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত ভাষ্যকার ও সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

আমার কাছে কামাল লোহানীর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরে এমন আপাদমস্তক বাঙালি আমি জীবনে কমই দেখেছি। এখনো তিনি তাই আছেন- একান্তভাবে সোনার বাংলার মানুষ হয়েই। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ইদানীং ক্ষীণ হয়ে আসছে।

আমি নিশ্চিত যে, ‘অয়দিপাউস’ নাটকের টাইরেসিয়াসের মতোই তিনি ত্রিকালদর্শী হয়ে এবং ইংরেজ কবি মিল্টনের মতোই অন্তর্গত গভীর দৃষ্টি নিয়েই স্বর্গসুখ উপভোগ করবেন; একজন চিরন্তন বাঙালি মহৎ পুরুষ হিসেবে। তিনি আমাদের অক্ষয় গৌরব হয়ে আছেন। জয় হোক তাঁর। জন্মদিনে এই হোক আমার অন্তরের নিবেদন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App