×

সাময়িকী

কামাল লোহানী অন্ধকারের উৎস হতে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০১৯, ০৭:১৫ পিএম

কামাল লোহানী অন্ধকারের উৎস হতে

‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ- পৃথিবীতে আজ, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা; যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই- পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। -জীবনানন্দ দাশ

প্রায় সাত দশক আগে লিখেছেন। এরই মধ্যে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, দেশকে নিজেদের করতে চেয়েছি, কত কিছু বদলেছি- কিন্তু এ অদ্ভুত আঁধার পেরুতে পারিনি। আঁধার আমাদের পিছু ছাড়ে না। ‘ও আমার আঁধার ভালো’ বলতে পারলে হয়তো ভালোই হতো- কিন্তু তা পারছি কই? অন্ধ, বধির, প্রেমহীন, প্রীতিহীন এক নিষ্ঠুর সময় আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সময়ের এ দুর্মুখতার দায় কে নেবে?

যুগে যুগে কালে কালে যে শ্রেণিটি আলোকবর্তিকা হয়ে পথের নিশানা দিয়েছেন, তাদেরই একটি অংশ আবার সমাজে ছুড়ে দিয়েছে এক রাশ অন্ধকার, কত মানুষকে করেছে দিকভ্রান্ত। অন্ধকারের এ দায় তারা এড়াতে পারেন না। তারা সমাজের অগ্রসর বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। সমাজ বদলের বাঁকে সব সময় মধ্যবিত্ত এ শ্রেণিটির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

মেক্সিম গোর্কি বলেছেন, ‘মাছের পচন যেমনি শুরু হয় তার মাথা থেকে তেমনি কোনো জাতির অধঃপতনের শুরুটাও হয় সে জাতির মাথা, তথা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় থেকে। সমাজে সব সময়ই শাসক শ্রেণি তার শাসন বা দুঃশাসন নিরঙ্কুশ করার প্রয়োজনে লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী তৈরি করেন। তারা দলীয় বুদ্ধিজীবী। যারা সে শাসক ও শাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সব সময়ই ফরামায়েশি সাহিত্য ও সংস্কৃতি তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যান। আবার আরেক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী সেই ফরমায়েশি শিল্প সাহিত্যের সাথে যুক্ত না থাকলেও এ সবের বিরুদ্ধে দাঁড়ান না, প্রতিবাদ করেন না। তারা মৌন অবলম্বনের মধ্য দিয়ে নিরপেক্ষতার আদলে দুঃশাসনের পক্ষে পরোক্ষ অবস্থান নেন।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘কোথায় তিনি ঘুমিয়ে আছেন সেটি হচ্ছে গৌণ;/ কথা হচ্ছে কোথায় তিনি জাগেন/ আর কোথায় তিনি মৌন-’ মৃত্যুর পরে কার সমাধি কোথায় হলো বা হবে সেটি মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য হচ্ছে সেইটি তিনি যখন ছিলেন তখন সমাজে বিরাজমান দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংকট, আলোড়ন-বিলোড়নে তার অবস্থান বা ভূমিকাটা কি ছিল। তিনি সরব ছিলেন, নাকি নীরব থেকেছেন।

গত শতকের ষাটের দশকটি আমাদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতি ও সংস্কৃতির আন্দোলন সমান্তরালভাবে হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হয়েছে। ছয় দফা ও এগার দফাকে রবীন্দ্রনাথ পুষ্টি জুগিয়েছেন। ১৯৬১তে রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ থেকে শুরু হওয়া তরঙ্গ ’৭১-এ এসে আছড়ে পড়েছে। উত্তুঙ্গ সেই সময়েও ষাটের মধ্যভাগ বা এরপর পর্যন্ত জিন্নাহ ও আইয়ুব খানের স্তুতি নিয়ে কাব্য রচনা এখানে থেমে থাকেনি।

স্বনামখ্যাত তথাকথিত প্রগতিমনা অনেকেই সেই স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন। এ চিত্রটি শুধু আমাদের দেশের সমাজেই নয় পৃথিবীর বহু সমাজেই লেখক শিল্পীদের চারিত্রিক স্খলনের এমনি নজির রয়েছে।

আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের উত্তরাধিকারীদের নির্মম জীবন যন্ত্রণা নিয়ে ক্লুট হামসুন লিখেছেন, ‘a people without history, without a tradition, without a brain.’ ‘হাঙ্গার’-এর মতো বিস্ময়কর সৃষ্টির লেখক ক্লুট আবার হিটলারের আত্মহত্যার পর লিখলেন, ‘Adlof Hitler was a warrior, a warrior for humankind and preacher of the gospel of justice for all nations. He was a reforming character of the highest order...’ এ এক বিস্ময়কর পরিবর্তন। এসব কথা এই জন্য বলা যে, কামাল লোহানীকে বুঝতে গেলে লেখক বুদ্ধিজীবীদের এ চরিত্রটি মনে রাখা দরকার।

দুই.

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জোগান পর্যায়ে কামাল লোহানীর জন্ম। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন। প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়টি ছিল মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণ। রুশ বিপ্লবের মধ্যদিয়ে একদিকে ইউরোপের বিশাল এক অংশ জুড়ে শ্রমজীবী মানুষ সমতার স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। অন্যদিকে এর বাইরের সমগ্র ইউরোপবাসী শুনতে পাচ্ছে ভাঙনের ঘণ্টাধ্বনি।

দেশে দেশে সমাজে সমাজে দ্বন্দ্ব বিভাজন, সমাজ ভেঙে পড়ছে, পরিবার ভেঙে পড়ছে, মানুষে মানুষে তৈরি হচ্ছে ফারাক, বৈষম্য। সমগ্র ইউরোপজুড়ে তৈরি হলো মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতাবোধ। যার দার্শনিক নাম ‘এলিয়েনেশন’।

ইউরোপের সে সংকটময় বিপর্যস্ত সমাজের মানুষগুলো সম্পর্কে আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ে তার ছোটগল্প ‘দ্য ওল্ড ম্যান অন্ড দ্য সি’-এ বলছেন, মানুষগুলোর মেরুদণ্ড থেকে শিশ্ন পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে। সমাজে মানুষগুলোর প্রতিবাদের ক্ষমতা, দাঁড়াবার শক্তিটুক ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যে সংকট গোটা ইউরোপে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে তুললো।

ইউরোপের এ বিপর্যয়ের কালে আমাদের ভারতবর্ষে চলছে শেকল ভাঙার কোরাস। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতায় পশ্চিমের বিপর্যয়ে ভারতবর্ষও কঠোরভাবে আক্রান্ত হলো। সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্ভিক্ষে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো ভারতবর্ষ। একদিকে মানুষের ধর্মীয় উন্মাদনা অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী কৌশল- ১৫ লাখ মানুষকে খাদ্য সংকটে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল।

’৭১-এ মানবতা বিরোধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থেকেছেন। ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জাতি-গোষ্ঠীকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার থেকেছেন। সাগর-রুনি, ত্বকী, তনুসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সামনে থেকেছেন। রাজপথে নেমেছেন। মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছেন। মিছিল করেছেন। আন্দোলনে সাহস জুগিয়েছেন। এইতো কামাল লোহানী।

সমাজের এমনি অগ্নিগর্ভ সময়ই কামাল লোহানীর শৈশব ও কৈশোর কাল। ৭ বছরের মাতৃহারা শিশু সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থেকে চলে গেলেন কলকাতা। কানে তুলো গুঁজে যুদ্ধের ধ্বংস ধ্বনি থেকে রক্ষা পেতে চাইতেন। সাইরেনের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ বিমানের গোলা ও শব্দ। ট্রেঞ্চে, বাড়ি ও স্কুলে সর্বত্র যুদ্ধের শব্দ। কিন্তু তুলো গুঁজেই কি যুদ্ধ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? শিশু কামাল লোহানীর সামনে তখন- পথে হাটে মাঠে সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা হাজার হাজার লাশ। ধর্মের নামে হিংস্র পশুর মতো মানুষকে হত্যা করছে মানুষ। সভ্যতা, মানবতার এক নির্মম নগ্ন চিত্র সর্বত্র। যে ছবি কামাল লোহানীকে কঠিন-কঠোরের দিকে নিয়ে যায়। তিনি বুঝতে থাকেন সভ্যতার নামে এখানে চলছে নিরন্ন মানুষদের নিয়ে নির্মম পাশাখেলা। এ থেকে মুক্তি পেতে হবে।

দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পাবনা চলে এলেন। পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হলেন। থাকেন চাচার কাছে। ব্রিটিশরা দেশ ভাগ করে চলে গেলেও দেশটা স্বাধীন হলো না। এ সত্যটি বুঝতে অবশ্য কিছুদিন সময় লেগেছিল। ভাষা নিয়ে এখানে পশ্চিমাদের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হলো। কামাল লোহানী বাংলা ভাষার পক্ষে দাঁড়ালেন। ঢাকা রক্তাক্ত হলো। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো সারা দেশে। তিনি তখন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। স্কুল ছেড়ে ভর্তি হলেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। ভাষা-সংগ্রামে অংশ নেয়া ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তোললেন ‘পাইওনিয়ার ফ্রন্ট’। এরা যোগ দিলেন ভাষা-সংগ্রাম থেকে গড়ে ওঠা প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে।

১৯৫৩ সালে পাবনায় মুসলিম লীগের এক কাউন্সিল অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনসহ কয়েকজন কেন্দ্রীয় লীগ নেতার আগমনকে কেন্দ্র করে জেলার ছাত্র-শিক্ষকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কারণ কিছুদিন আগেই এই নূরুল আমিনের নির্দেশে ঢাকায় ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে লীগ সরকার কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানীসহ অনেকে। মুক্তি পান কিছু দিন পর। এরি মধ্যে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে।

১৯৫৪-এর মার্চে নির্বাচন। হক-সোহরাওয়ার্দী-ভাষানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে মুসলিম লীগ ছাড়া পূর্ববঙ্গের সবাই যুক্তফ্রন্টের পক্ষে অবস্থান নেন। গণজোয়ারে লীগ সরকার ভীত হয়ে পড়ে। ১৯৫৪-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনায় টাউন হলে শহীদ দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে লীগ সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে নির্বাচনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের গ্রেপ্তার করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানী।

নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ের পর সরকার রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের এই বিজয় পশ্চিমারা মেনে নিতে পারে না। তিন মাসের মাথায় ১৯৫৪ সালের ২৯ মে নতুন আইন করে ‘গভর্নর পদ্ধতি’ প্রবর্তন করে। প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। মেজর ইস্কান্দার মির্জা পূর্ব বাংলার গভর্নর হন। শুরু হয় ভিন্ন মতাবলম্বীদের গ্রেপ্তার। ১ জুন আবার গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানী। এক বছর পরে ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে জড়িত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলে কামাল লোহানী আত্মগোপনে যান।

এ সময় তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন। বুলবুল একাডেমির মাধ্যমে নৃত্য ও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে নৃত্য গুরু জি এ মান্নানের প্রযোজনায় ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ নৃত্যনাট্য তৈরি করে দেশে ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন প্রদেশে মঞ্চস্থ করেন। এরই মধ্যে ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন চাচাতো বোন দিপ্তী লোহানীকে। যোগ দেন দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। ১৯৬১ সালে সাংস্কৃতিক দল নিয়ে ইরান ও ইরাক সফর করেন। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা আন্দোলন শুরু করে।

আবার শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। কামাল লোহানীর নামে হুলিয়া জারি হয়। কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে গ্রেপ্তার হন তিনি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ অনেকের সাথে ২৬নং সেলে রাখা হয় তাঁকে। কারাগার থেকে তিন মাস পর মুক্তি পান। যোগ দেন দৈনিক সংবাদ-এ। পরে পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেট ও দৈনিক পূর্বদেশ-এ যুক্ত হন।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে নতুনতর সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠলে তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। সাড়ে চার বছর ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক থাকার পর মার্কসবাদী আদর্শে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’। ১৯৬৭ সালে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সংগঠনের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান হয়। সেখানে মঞ্চস্থ হয় গণসংগীতের অনুষ্ঠান ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’, নাটক ‘আলোর পথযাত্রী’, নৃত্যনাট্য ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে’।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক স্বরাজ পত্রিকায় পাকসেনাদের দুঃশাসনের চিত্র নিয়ে দুঃসাহসিক প্রতিবেদন রচনা করেন। সাথে সাথে সাংস্কৃতিক সংগঠন ও কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী গোষ্ঠী’। এপ্রিল মাসে সহকর্মীদের নিয়ে তিনি ভারতের কলকাতা পৌঁছান। সেখানে প্রথমে জয়বাংলা পত্রিকা ও পরে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যুক্ত হন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে থাকলেও সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা, স্লোগানসহ সবকিছু করেছেন। দেশ স্বাধীন হলে ফিরে এসে ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা বেতারের দায়িত্ব নেন। কিন্তু স্বাধীন দেশেও প্রশাসনে কোনো পরিবর্তন না দেখে বেতার ত্যাগ করেন। ফিরে যান সংবাদপত্রে। সাংবাদিকতায় স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের সংগঠনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় প্রতিনিধি হয়ে বিভিন্ন দেশে গেছেন। ১৯৮৩ সালে আবার গড়ে তোলেন ‘গণশিল্পী সংস্থা’। পরে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি হন। বিভিন্ন সময় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।

গণসংগীত ও মুক্তিযুদ্ধের গান নিয়ে কামাল লোহানী প্রকাশ করেন গ্রন্থ ‘লড়াইয়ের গান’। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আমরা হারবনা’, ‘অগ্রজের সঙ্গে একদিন’, ‘এদেশ আমার গর্ব’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’, ‘মুক্তি-সংগ্রামে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র’। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত রাজনৈতিক নিবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘সত্য কথা বলতে কি’, কবিতা নিয়ে ‘দ্রোহ ও প্রেম’ এমনি বিভিন্ন গ্রন্থ।

তিন. কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের যে কথাটি বলেছিলাম তা দিয়ে কামাল লোহনীকে বুঝে নিতে হবে। তিনি সমাজে বিরাজমান অন্যায়, অনিয়ম ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সব সময় সরব ছিলেন, উচ্চকণ্ঠী ছিলেন। আপস করেননি। শাসক গোষ্ঠীর সাথে মত ভিন্নতায় বিভিন্ন সময় কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন। নিজের অবস্থান বদলাননি। ১৯৭৫ সালে সরকার ৪টি সংবাদপত্র রেখে বাকি সবগুলো বন্ধ ঘোষণা করলে তিনি তা মেনে নিতে পারেননি। তিনি বাকশালে যোগ দেননি। যোগদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ’

৭১-এ মানবতা বিরোধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থেকেছেন। ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জাতি-গোষ্ঠীকে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার থেকেছেন। সাগর-রুনি, ত্বকী, তনুসহ বিভিন্ন হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সামনে থেকেছেন। নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন ও শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে নির্যাতনের প্রতিবাদে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে নারায়ণগঞ্জ ছুটে গেছেন। নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি শুধু বিবৃতি দিয়ে দায় সারেননি। রাজপথে নেমেছেন। মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছেন। মিছিল করেছেন। আন্দোলনে সাহস জুগিয়েছেন। এইতো কামাল লোহানী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App