×

মুক্তচিন্তা

হিন্দুত্ববাদ এবং নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় ইনিংস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০১৯, ০৮:৩৭ পিএম

মোদির দ্বিতীয় ইনিংসটির পরিসমাপ্তি খুব সহজ হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। শুধু ধর্মান্ধ অনুভূতির ওপর বসে মোদি ভোটযুদ্ধের বৈতরণী পার হলেও নির্বাচন-পরবর্তী সরকার পরিচালনায় বিশাল ভারতের বাস্তব সমস্যার চ্যালেঞ্জগুলো তিনি সহজে পার করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। তার যোগ্যতার কমতি নেই। তিনি তার যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর কাজে।

৩৯ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত মাত্র দুটি আসন নিয়ে যে দলের সংসদ দখলের যাত্রা শুরু, সেই বাজপেয়ি-আদভানির হাতে গড়া বিজেপি ২০১৪ সালে যখন মোদি-অমিত শাহের দলে পরিণত হলো, তখনো অনেকেই ভাবেনি ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কট্টর হিন্দুত্ববাদী এ দলটি পরপর দুটি লোকসভা নির্বাচনে এত বিশাল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসবে। দাঙ্গার রক্ত হাতে মেখে নরেন্দ্র মোদি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা লাভেও বঞ্চিত ছিলেন।

আজ তিনিই ভারতের পরপর দুবারের প্রধানমন্ত্রী। এ বিশাল জয়ের পেছনে মোদির ব্যক্তিগত ইমেজ না সময়ের রসায়ন কাজ করছে তা দেখতে হয়তো আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।

বিজেপি ইতোমধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে এ বিশ্বাস স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে- বিজেপিই একমাত্র দল, যে দলের অধীনে তাদের ধর্ম ও ধর্মীয় আচার-আচরণ অন্য যে কোনো দলের চেয়ে অধিকতর নিরাপদ। মোদির রাজনৈতিক আচার-আচরণ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এ রসায়নের চিত্র খুব সহজেই পাওয়া যায়।

এবারের নির্বাচনের আগে উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভোট ব্যাংকের ওপর বিজেপির সুতীক্ষ্ন নজর ও অধিক মনোযোগ ছিল। রাজ্য দুটিতে লোকসভার আসন সংখ্যা বেশি থাকায় হাতেনাতে ফলও পেয়েছে তারা। মমতার শক্ত ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গেরও ঘটেছে শোচনীয় পতন। মাত্র ২২টি আসন নিয়ে সন্তুষ্টি থাকতে হয় তৃণমূল কংগ্রেসের মমতাকে।

অন্যদিকে ২০১৪ সালে মাত্র দুটি আসন পাওয়া বিজেপি ২০১৯ সালে ১৮টি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে। এমন অভাবনীয় ফলাফল দেখতে যেন প্রস্তুত ছিল না ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ। কিন্তু মোদির দ্বিতীয় ইনিংস একেবারে লণ্ড-ভণ্ড করে দিয়েছে পশ্চিম বাংলাসহ ভারতের সর্বত্র।

ইতোমধ্যে মোদি সরকার এক মেয়াদে ভারত সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছে, যা বড় ধরনের বেকারত্ব, মারাত্মক কৃষি সংকট, সংখ্যালঘুদের প্রান্তিকীকরণ এবং সমাজের নতুন মেরুকরণ কোনোটারই সফল সমাধান করতে পারেনি। তারপরও মোদি পুনর্নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। কী জাদুর বাঁশি তার হাতে?

মোদির গত ইনিংসে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনেকটাই এগিয়েছে জয়শংকরের মাধ্যমে। মোদির বাংলাদেশ সফর এবং শেখ হাসিনার ভারত সফর এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ সফরের দায়িত্বে ছিলেন জয়শংকর। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু অমীমাংসিত সমস্যা বিদ্যমান আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পীড়াদায়ক তিস্তা সমস্যাটি। গণমাধ্যমের প্রচার নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কর্মীদের একটি কষ্টদায়ক অনুভূতি আছে। ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ যেন সঠিকভাবে উঠে আসে না কখনো।

এমনকি বাংলাদেশের ক্রিকেট, বাংলাদেশের মন্ত্রীদের সফর কোনোটাই যেন তার যোগ্য প্রচার পায় না ভারতের গণমাধ্যমে। তারই যেন বহিঃপ্রকাশ দেখলাম এবারের নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় অভিষেকে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপস্থিতির খবরের মাধ্যমে। ফলাও করে তো নয়-ই, বরং খুব হালকা করেই প্রচার করা হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির আগমন বার্তাটি।

অন্যদিকে বাংলাদেশে ভ্রমণ করা ভারতের মন্ত্রী, এমপি কিংবা রাজনীতিবিদরা যেন একটু বেশিই প্রচার পান বাংলাদেশের গণমাধ্যমে। অসম একটি ব্যবস্থা প্রচলিত আছে বাংলাদেশ এবং ভারতের টিভি চ্যানেল প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের চ্যানেলগুলো যেভাবে দেখতে পাচ্ছে, ভারতের বাঙালিরা বাংলাদেশের চ্যানেল সেভাবে দেখতে পায় না। ফলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিনিময় প্রচার ঠিকমতো হচ্ছে না।

মোদির দ্বিতীয় ইনিংসটির পরিসমাপ্তি খুব সহজ হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। শুধু ধর্মান্ধ অনুভূতির ওপর বসে মোদি ভোটযুদ্ধের বৈতরণী পার হলেও নির্বাচন-পরবর্তী সরকার পরিচালনায় বিশাল ভারতের বাস্তব সমস্যার চ্যালেঞ্জগুলো তিনি সহজে পার করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। তার যোগ্যতার কমতি নেই। তিনি তার যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর কাজে। কিন্তু বর্তমান মোদি-অমিতের বিজেপি মূলত চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে অন্য সবকিছু থেকে।

তাদের ধারণা, ধর্ম দিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ হচ্ছে। তাই তারা কর্তৃত্ববাদী মৌলবাদী গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবেই ভারতে উদীয় হতে পছন্দ করছেন। মোদি তাই সবকিছু ছেড়ে বেশি মনোযোগী হয়েছেন কী করে হিন্দু ভারতীয়দের নেতা হতে পারেন। তার এ পদ্ধতি হয়তো এবারের নির্বাচনে ম্যাজিকের মতোই কাজ করেছে।

একদিকে ব্যক্তি মোদি ম্যাজিক, অন্যদিকে বিজেপির ধর্মধারী ম্যাজিক- এই দুই ম্যাজিকই এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ধরনের নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু মোদি সরকার যদি ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে না পারে, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করতে না পারে, বর্ধিষ্ণু ধনী-গরিব অসমতা দূর করতে না পারে, কৃষি খাতে উন্নয়ন না আনতে পারে, বায়ু ও পানিদূষণ রোধ করতে না পারে কিংবা লাল ফিতার দৌরাত্ম্য দূর করতে না পারে- তবে শুধু ধর্ম-ধর্ম করে ভারতের জনপ্রিয় নেতার ভূমিকা ধরে রাখা মোদির জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে।

মোদির সময়ে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বাতাস বেশ জোরেশোরেই বইতে শুরু করেছে। বিভিন্ন ধর্ম এবং বিভিন্ন মতের ভারতে সম্প্রীতি ধরে রাখার চ্যালেঞ্জটি মোদি যতই হালকা করে দেখুন, ভবিষ্যৎ ভারত তা ততটা হালকা করে দেখতে না-ও পারে। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ এবং পশ্চিম বাংলার অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী খুব বেশি দিন ধর্মবাদী রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা বহন করবে বলে মনে হচ্ছে না। কংগ্রেস এবং স্থানীয় দলগুলোর দুর্বল রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের সুযোগে ভারতে মোদির দ্বিতীয় ইনিংসটি হিন্দুত্ববাদের বাঁশিতে ভালো ফল দিলেও এটা স্থায়ী সমাধান না-ও হতে পারে।

সাম্প্রদায়িক জাদুর বাঁশি একটি বা দুটি নির্বাচনে কাজ করলেও ভারতের মতো একটি সুশৃঙ্খল জাতির দেশে স্থায়ী সমাধান হতে পারে বলে মনে করি না। সাময়িক এই ধর্মান্ধ উন্মাদনা তাদের সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু তা চিরস্থায়ী হবে বলে মনে হয় না। কর্তৃত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক বিশ্বের কারণে কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর ধর্মান্ধ রাজনীতির বাড়াবাড়ির কারণে হয়তো-বা সাময়িকভাবে ভারতের হিন্দু জনগোষ্ঠী কিছুটা নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করেছে এবং বেসামাল হয়ে পড়েছে, কিন্তু এটাই যে তাদের রাজনীতির স্থায়ী চরিত্র এমনটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাদের ইতিহাস সে কথা বলে না। আগামী পাঁচ বছর আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে এর জবাব পেতে। ভারতের পরের নির্বাচনটিই বলে দেবে- এশিয়ার এই বড় দেশটিতে আমরা অসাম্প্রদায়িক মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখব কিনা!

আমরা দেখেছি ভারতের সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে মোদি এবং মোদি-অমিতের বিজেপি জয়লাভ করলেও পরাজিত হয়েছে ভারতের অসাম্প্রদায়িক জনগণ। মোদি ম্যাজিক দেখিয়েছেন ঠিকই। তিনি তার ম্যাজিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ম্যাজিক বলে প্রচার করলেও তার প্রকৃত ম্যাজিক ছিল ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদের ম্যাজিক। এর সঙ্গে তিনি পুঁজিপতি ও পুঁজিবাদীদেরও অসংখ্য সমর্থন পেয়েছেন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আড়ালে তিনি ভারতে প্রতিষ্ঠা করতে চান হিন্দু জাতীয়তাবাদ। তার জাতীয়তাবাদের মাসুল ঠিক ভাষা নয় বরং ধর্ম। তাই বর্তমান সংকট অনেক ভয়াবহ হলেও আগামী দিনের বিশ্ব সভ্যতা ধর্মীয় আর পুঁজিবাদের এই সংকট থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করবে- এমন ভরসা রাখতে চাই।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা: কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App