×

মুক্তচিন্তা

সামনে আলো ঝলমল দিন, দুর্নীতির  অন্ধকারে যেন হারিয়ে না যায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০১৯, ০৯:৫৪ পিএম

সামনে আলো ঝলমল দিন, দুর্নীতির  অন্ধকারে যেন হারিয়ে না যায়
সামনে আলো ঝলমল দিন, দুর্নীতির  অন্ধকারে যেন হারিয়ে না যায়

২০১৮ সালে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের ফলাফল ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৯তম অবস্থানে। অথচ ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৩তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় আফগানিস্তানে। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। যে উন্নয়নের প্রশস্তিগীত আমরা গাইছি, রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানগুলোর লাগামহীন দুর্নীতি তাকে বেসুরো করে তুলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের সামনে আলো ঝলমল দিন, তা যেন দুর্নীতির অন্ধকারে হারিয়ে না যায়।

পুলিশ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ রাষ্ট্রের বর্ম হবে, এটাই তাদের দায়িত্ব। অথচ বাস্তবতা হাঁটছে উল্টো পথে। ‘পুলিশ’ শব্দটিই যেন আতঙ্ক। ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত হত্যাকাণ্ডে পুলিশের যে ভূমিকা আমরা দেখেছি, তা আতঙ্কগ্রস্ত করে। টিআইবির জরিপে দেশের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুর্নীতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার অবস্থান ৭২.৫ শতাংশ। যারা অপরাধ দমনে নিয়োজিত, সেখানে তারাই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। কে থামাবে তাদের? দুর্নীতি দমন কমিশন? সে চিত্র আরো হতাশাজনক। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের এক পরিচালক একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন! কতটা পাহাড়সম অপরাধ ঢাকতে এই টাকা লেনদেন হয়েছে, তা ভাববার বিষয়। এবার প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক, দুর্নীতি দমনের জন্য কতটা কাজ করছে এই কমিশন? প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দুর্নীতি দমন কমিশন কখনোই বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। দুদক পরিচালক এ কে এম ফজলুল হক আসামির কাছে তথ্যফাঁসের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েও পার পেয়ে গেছেন। তাকে বরখাস্তের অফিস আদেশে অভিযোগ ছিল সুনির্দিষ্ট। তথ্য ফাঁসের পাশাপাশি অনুসন্ধানে গড়িমসি ও কালক্ষেপণের অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুর রহমানের কাছে তথ্যফাঁসের অভিযোগে দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় গত ১০ জুন। তাহলে ফজলুল হকের মতো এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও কি মিথ্যা প্রমাণিত হবে? ডিআইজি মিজানুর রহমান তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত থেকে নিষ্কৃতি পেতে সরাসরি ও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘুষ লেনদেন করেছেন। গোপনে ধারণ করা বেশ কিছু অডিও রেকর্ডে সে প্রমাণও উঠে এসেছে। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন আব্দুল দয়াছ নামে লন্ডন প্রবাসী এক ব্যক্তি। দয়াছ ও ডিআইজি মিজানের সঙ্গে এসব কথোপকথনে অংশ নেন অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে (এলপিআর) থাকা দুদক পরিচালক আব্দুল আজিজ ভূঁইয়া। অডিও কথোপকথনে আলোচিত ব্যক্তিরা দুদক কর্মকর্তা। আর তাদের অনেকেই দয়াছের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারো সমালোচনার মুখে কমিশন। তাহলে সর্ষের ভেতরেই ভূত! দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ? কমিশনের তদন্ত কর্মকর্তা চাইলেই কি তার ইচ্ছামতো ঘুষের বিনিময়ে কাউকে রেহাই দেয়া কিংবা কাউকে ফাঁসিয়ে দেয়ার সুযোগ আছে? দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগও বহুদিনের। কমিশন প্রতিষ্ঠার আগে যখন দুর্নীতি দমন ব্যুরো ছিল তখন থেকেই সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। গত ২৮ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে “৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে : স্যার, আমি জাহালম, সালেক না” শিরোনাম একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলায় নিরপরাধ জাহালমের জেলখাটার প্রসঙ্গ তোলা হয়। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আবু সালেকের (মূল অপরাধী) বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটছেন এবং আদালতে হাজিরা দিয়ে আসছিলেন জাহালম। আদালত জাহালমের কারাভোগের ঘটনাকে আরেকটি ‘জজ মিয়া নাটক’ উল্লেখ করেছেন এবং একই সঙ্গে দুদককে অবশ্যই স্বচ্ছতার সঙ্গে তদন্ত করার পরামর্শ দেন। দুদকের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে আদালত মন্তব্য করেন, এ রকম ভুলের দায় দুদক কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। এরপর তিনি নিজেই ফাঁস করেছেন ৪০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের ঘটনা। গত ৮ জুন অনুসন্ধান থেকে রেহাই পেতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেয়ার তথ্য প্রকাশ করেন মিজান। ওই তথ্য নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার পর দুদকের ওই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। দেশের ১৩ হাজার পুলিশ দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলেও মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। এর ফলে আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ছে, মানুষ ন্যায়বিচারের আস্থা হারাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। নির্দিষ্ট বেতনে সরকারি চাকরি করেও শুধু দুর্নীতির কারণে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, এমন অন্তত ২৫ পুলিশ কর্মকর্তার সন্ধান পেয়েছে দুদক। চাঁদাবাজি, ঘুষ, ইয়াবা বহন, হয়রানি, প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টাসহ কী অভিযোগ নেই পুলিশের বিরুদ্ধে? পুলিশ বাহিনী কি জানে, জনগণকে ঠিক কী ধরনের সেবা দেয়ার জন্য তাদের নিয়োগ দেয়া হয়? পুলিশের নানা স্তরে যোগ দিতে আসা ব্যক্তিরা কি এখানকার বেতন কাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে না জেনেই এ পেশায় যোগ দেন? নাকি ‘উপরিসহ বেতন’ ভেবেই আসেন এ পেশায়? পুলিশ হেডকোয়ার্টারে একটি সিকিউরিটি সেল আছে, যাদের কাজ এই ধরনের নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধমূলক কাজের অনুসন্ধান করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা করার বিধানও রয়েছে। কিন্তু তা কার্যকর হচ্ছে কতটুকু? এ ছাড়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন রয়েছে, তাদেরও দায়িত্ব আছে এসব দেখভাল করা। সুতরাং পুলিশের বিরুদ্ধে অপরাধ বা দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সেগুলো খতিয়ে দেখা, তদন্ত করা এবং মামলা করার ব্যবস্থা যেহেতু রয়েছে, সেগুলো কেন অ্যাকটিভ হচ্ছে না? অপরাধপ্রবণ এলাকায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছেন কিনা, পুলিশ হেড কোয়ার্টারের সিকিউরিটি সেল এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকেই সার্বক্ষণিকভাবে নজরদারি করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমার কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাবের কারণে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের চর্চাও ফলপ্রসূ হচ্ছে না। যা প্রশাসনের ওপর সার্বিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০১৮ সালে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের ফলাফল ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৯তম অবস্থানে। অথচ ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৩তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় আফগানিস্তানে। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। যে উন্নয়নের প্রশস্তিগীত আমরা গাইছি, রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানগুলোর লাগামহীন দুর্নীতি তাকে বেসুরো করে তুলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের সামনে আলো ঝলমল দিন, তা যেন দুর্নীতির অন্ধকারে হারিয়ে না যায়।

কাজী নুসরাত শরমীন : কবি ও সাংবাদিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App