×

আন্তর্জাতিক

যত কাণ্ড পশ্চিমবঙ্গে!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০১৯, ১২:১৭ পিএম

‘জয় শ্রীরাম’ কাণ্ডের পর ডাক্তার-কাণ্ড। এরপর কী আসছে কে জানে? সত্যজিৎ রায়কে নকল করে বলাই যায় যত কাণ্ড পশ্চিমবঙ্গে! সদ্য ভোটের পর ভারতবর্ষ এখন মোটের ওপর ঠাণ্ডা। দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভা বাজেট আর প্রথম একশ দিনের কাজের খসড়া তৈরিতে ব্যস্ত। বিজেপির বাকি সদস্যরা এখনো হাই তুলছেন। সংসদ সদস্যরা শপথ নিচ্ছেন। ভোটে গোহারা হেরে বিরোধী দলগুলো এখনো মুষড়ে আছে। রাহুল গান্ধী সবে বিদেশে ছুটি কাটিয়ে ফিরেছেন। টিভি ডিবেটেও তেমন প্রাণ নেই। নানা রাজ্যে কিছু শোরগোল আছে বটে। তবে সেগুলো বেশিরভাগই নানা ধরনের দৈনন্দিন পাওয়া না-পাওয়ার গল্প। পাঞ্জাব বা উত্তরপ্রদেশে বিদ্যুতের দাম নিয়ে গোলযোগ। মধ্যপ্রদেশে বিদ্যুৎ না থাকা নিয়ে গণ্ডগোল। আবার বিহারে এনসেফেলাইটিস রোগে শিশুমৃত্যু নিয়ে তোলপাড়। ব্যতিক্রম কেবল একটা রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ। এখানে জল, বিদ্যুৎ, রাস্তা, এমন কী হাসপাতালের পরিকাঠামো নিয়ে আলোচনা হবার যো নেই। সব আলোচনা মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে। ফচকে ছোঁড়ারা, ‘জয় শ্রীরাম’ বললে গাড়ি থামিয়ে তাড়া করছেন। গুণ্ডারা হাসপাতালে ঢুকে ডাক্তার পেটালে প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নিয়ে ডাক্তারদের ওপর গজরাচ্ছেন। এমনকি বিজেপির ভুতও দেখছেন। আর তাইতে দেশজুড়ে প্রতিবাদ হলে, ডাক্তারদের লক্ষ্মীছেলে বলছেন। এদিকে ভোট-পরবর্তী হিংসা চলছেই। দুমদাম লাশ পড়ছে। কেন্দ্র দিস্তে দিস্তে চিঠি দিচ্ছে। গত এক হপ্তায় কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক অন্তত দুবার রাজ্যের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। শেষ চিঠিতে দেখা যাচ্ছে, গত তিন বছরে রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৮ সালে ১০৩৫ হিংসার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালের ছমাসে ঘটনা ঘটেছে ৭৭৩টি। রাজনৈতিক হিংসায় ২০১৬ সালে ৩৬ জন প্রাণ হারিয়েছে, ২০১৮ সালে ৯৬ জন আর ২০১৯ সালে এখনো পর্যন্ত ২৬ জন মৃত। ভারতের আর কোথাও এমন হিংসার নজির নেই। শুধু তাই নয়, রাজ্যে ধর্মীয় হানাহানির সংখ্যা বাড়ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সংসদে পেশ করা তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, ধর্মীয় হানাহানির সংখ্যার ভিত্তিতে দেশে উত্তরপ্রদেশ প্রথম আর পশ্চিমবঙ্গ সপ্তম। চিন্তার ব্যাপার হলো, বেশিরভাগ রাজ্যেই ধর্মীয় হিংসার ঘটনা হয় সমান আছে বা কমছে। আসামে হঠাৎ একবছরে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে, তারপর শান্ত। ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৪ থেকে ২০১৬ তিন বছরে ধর্মীয় হিংসা এখানে ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ১৬ থেকে ৩২ হয়েছে। লক্ষণীয় আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয় হওয়ায়, কেন্দ্র সরাসরি তথ্য পায় না। তাকে রাজ্যের দেয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। গত তিন বছরের তথ্য হাতে না থাকলেও চোখ বুজে বলা যায়, হিংসার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। মমতা ব্যানার্জির মতে যত দোষ নন্দ ঘোষ। রাজনৈতিক হোক আর ধর্মীয় হিংসা হোক, সবই নাকি বিজেপির দোষ। সত্যিই কি তাই? বারাসাত, বসিরহাট, উলুবেড়িয়া এসব জায়গায় তো এখনো বিজেপি নেই। তাহলে ধর্মীয় হানাহানি হলো কি করে? আর মিডিয়া সেসব খবর করতে গেলে, পুলিশ সাংবাদিকের নামে মামলা করল কেন? সদ্য ঘটে যাওয়া ডাক্তার-কাণ্ড খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে কেন এমন হচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক ৮৫ বছরের এক বৃদ্ধ মারা যেতে, কলকাতার ট্যাংরা অঞ্চল থেকে দু-ট্রাক লোক এসে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে ডাক্তারদের উত্তমমধ্যম দিল। অপরাধপ্রবণ বলে ট্যাংরা অঞ্চলের বদনাম আছে। এক জুনিয়র ডাক্তারের খুলি ফেটে গেল। আরেকজন পড়ুয়া ভয়ঙ্করভাবে আহত হলো। জুনিয়র ডাক্তাররাই হাসপাতালগুলোর মুখ্য কর্মীদল। তারা এই অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে কাজ বন্ধ করল। এমন ঘটনা শুধু পশ্চিমবঙ্গেই ঘটে তা নয়। কিন্তু ঘটলে সাধারণত রাজ্য সরকারগুলো দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। প্রথমেই হিংসার নিন্দা করে প্রশাসনিক বিবৃতি দেয়া হয় আর বেশকিছু লোককে গ্রেপ্তার করে মামলা দেয়া হয়। এতে ক্ষোভ প্রশমিত হয়। কজনের আর আন্দোলনের আঁঠা থাকে, বেশিরভাগ ডাক্তার আবার কাজে লেগে পড়ে। সেই সুযোগে হয়ত রাজনীতি দ্বারা আশ্রিত গুণ্ডারা আবার বেরিয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটল। তিনদিন ধরে, রাজ্য সরকার কোনো ব্যবস্থা নিল না। গোটা পাঁচেক লোককে ধরা হলো, কিন্তু পালের গোদাদের গায়ে হাতটিও পড়ল না। তারা আবার ধমকি দিতে লাগল। শুধু তাই নয়, রাজ্যের নানা অঞ্চলে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট গুণ্ডারা অন্যান্য মেডিকেল কলেজে গিয়ে ছাত্র পেটাল, প্যান্টের জিপার খুলে মহিলা ডাক্তারদের ভয় দেখাল। এমনকি তৃণমূলের এক নেতা লোক দিয়ে ডাক্তার পেটানোর হুমকিও দিল। তিনদিন পরে মুখ্যমন্ত্রী অন্য একটি মেডিকেল কলেজে গিয়ে রোগীদের ডাক্তার বিরুদ্ধে উসকালেন। হিন্দু, বড়লোকের বাড়ির ছেলেরা সংখ্যালঘু ও গরিবের চিকিৎসা করছে না সে তত্ত্বও বাজারে বেরোল। ফল যা হবার তাই। দেশজুড়ে বিক্ষোভ, হাসপাতালে সাত দিনের কর্মবিরতি। পশ্চিমবঙ্গের পাপের ফল সারা দেশ ভুগল। সব থেকে খারাপ ব্যাপার হলো। রাজ্যে ধর্মীয় বিভাজন আরো বাড়ল। আর সে নিয়ে বেশিরভাগ সংখ্যালঘু মানুষই চিন্তিত। ফেইসবুকে পোস্টও দেখা যাচ্ছে। ভালোর মধ্যে কোনো অতি-বামপন্থিও এ ঘটনায় বিজেপির হাত দেখতে পায়নি। বরং রাজ্য ও কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্ব, ডাক্তারদের বারবার ধর্মঘট তুলে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ডাক্তাররা তাতে সাড়া দেয়নি। রাজ্যে আগামী দিনে কে ক্ষমতায় আসবে সেটা পরের কথা। একজন রাজ্যবাসীর কাছে এখন প্রশ্ন, রাজ্যটা চলবে কি করে? তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপির সঙ্গে যুদ্ধ করে করুক, কিন্তু তাতে রাজ্যবাসীকে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে কেন? সামনে বাজেট। প্রধানমন্ত্রী, সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে আগামী বছরগুলোর পরিকল্পনার জন্য বৈঠকে বসেছেন। মমতা ব্যানার্জি যাননি। উনি কি ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী না অন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী? আগামীর পরিকল্পনা থেকে পশ্চিমবঙ্গ বাদ গেলে, কাল যে সরকারই আসুক না কেন, রাজ্যের উন্নয়ন কি করে হবে? প্রশ্ন অনেক। উত্তরগুলোও হয়ত অনেকটাই জানা। তবে পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক টানাপড়েনের আঁচ প্রতিবেশী রাজ্য ও দেশগুলোর গায়ে পড়বে বলেই মনে হয়। (লেখক ভারতীয় সাংবাদিক)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App