×

মুক্তচিন্তা

লোকজ সংস্কৃতির বাজেট প্রয়োজন বাড়তি প্রণোদনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০১৯, ০৭:২৬ পিএম

লোকজ সংস্কৃতির বাজেট প্রয়োজন বাড়তি প্রণোদনা
লোকজ সংস্কৃতির বাজেট প্রয়োজন বাড়তি প্রণোদনা

যাত্রাপালা সাহিত্য সংস্কৃতির তথা লোকজ শিক্ষার বাহক কিন্তু এর ওপর প্রয়োগধর্মী গবেষণা একেবারেই অপ্রতুল এমনকি দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার পাঠ্যসূচিতে এ বিষয়টির তেমন কোনো উপস্থিতি লক্ষণীয় হয় না- যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি দুর্বল দিক। আবার যারা সাহিত্য কিংবা নাট্যকলা বিভাগে গবেষণা করেন তাদের যাত্রা শিল্পের ওপর এমফিল কিংবা পিএইচডি করতে দেখা যায় না। ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এ শিল্প। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চতর গবেষণা বিভাগগুলোকে এ বিষয়ে প্রাধান্য দিতে হবে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক খাতওয়ারি বরাদ্দের দিক থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অনেক পিছিয়ে রয়েছে যেমন পরিচালন বাজেট ৩,৪১৫ কোটি টাকা, চলতি বছরের সংশোধিত বাজেট ৩২৮ কোটি টাকা, প্রস্তাবিত উন্নয়ন ব্যয় ২৬০ কোটি টাকা এবং চলতি বছরের সংশোধিত উন্নয়ন বাজেট ৩০১ কোটি টাকা। আবার সার্বিক বাজেটের সম্পদের ব্যবহারে বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে রয়েছে মাত্র ০.৯% এবং পরিচালন খাতে রয়েছে ০.৮%। সম্প্রতি একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকায় ‘হারিয়ে যাচ্ছে যাত্রাপালা’ শিরোনামে একটি খবর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। খবরটি পড়ে আমি কিছুটা মর্মাহত হয়েছি বিশেষত লোকজ শিক্ষার বাহক এই মাধ্যমটির ক্রমাগতভাবে বিলুপ্তি হওয়ার করুণ চিত্রটি দেখে। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, বিশ্বায়নের আকাশ সংস্কৃতি বাঙালির এককালের বিনোদনের প্রধান বাহক যাত্রাপালাকে গ্রাস করে বসেছে অথচ যাত্রার কথা মনে হলে পুরনো ইতিহাস, মহর্ষী ব্যক্তিত্ব, লোকজ সাহিত্য, বিখ্যাত চরিত্র ইত্যাদির কথা মানসপটে ভেসে ওঠে। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ষাটের দশক কিংবা তারও আগে তখনকার মানুষের নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব, শিক্ষার মানসিকতা যেভাবে সমাজ সংস্কৃতির জগৎকে প্রভাবিত করত তা সত্যিই ছিল বিস্ময়কর। তখন প্রতিটি জেলায় শীতের সময়ে প্রদর্শনী হতো যেখানে যাত্রা ও পুতুল নাচ ছিল প্রধান আকর্ষণীয় বস্তু। যাত্রাশিল্পের নান্দনিক ও শৈল্পিক মূলবোধই ছিল উদ্যোক্তাদের প্রধান লক্ষ্য। তখনকার সময় প্রায় স্কুলেই যাত্রাগান অনুষ্ঠিত হতো যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আর্থিকভাবে স্কুলকে সহায়তা করা এবং শিক্ষামূলক পালাগুলো যেমন মাইকেল মধুসূদন, ভাওয়াল সন্ন্যাসী, ভক্ত রামপ্রসাদ, গলি থেকে রাজপথ, আনারকলি ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় হাওর বেষ্টিত অঞ্চলগুলো লোকসংস্কৃতিতে এত সমৃদ্ধ ছিল যে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গান-বাজনার আয়োজন থাকত এবং ভাসান যাত্রার আয়োজন হত বিয়ে কিংবা পূজার আসরে। পূর্ব ময়মনসিংহের গ্রামাঞ্চলে এর প্রভাব খুবই বেশি ছিল এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসাহিত্যের অধ্যাপক ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের ময়মনসিংহ গীতিকার মহুয়ার যাত্রাপালার নিদর্শন পাওয়া যায়। যাত্রা একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের হাতিয়ার হলেও সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিচ্ছবিও এখানে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যাত্রাপালার একটি অনবদ্য ভূমিকা ছিল যা স্মরণে রাখার মতো। পশ্চিম বাংলার গ্রামেগঞ্জে শহরে ‘আমি শেখ মুজিব বলছি’ নামক তরুণ অপেরার যাত্রাপালা মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সেখানকার মানুষের তথা সমাজের সমর্থন জুগিয়েছিল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যাত্রাদলের সংখ্যা ছিল তিনশরও বেশি এবং আমরা রাজনৈতিক তথা ভৌগোলিকভাবে একটি স্বাধীন দেশ পেলেও বিশ্বাস ও নৈতিকতায় সমৃদ্ধ মানুষগুলো তেমন দেখা যায়নি যা যাত্রাশিল্পের ওপরও পড়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেকে দেশ ছেড়েছে আবার অনেকে সংগঠনসহ বাদ্যযন্ত্র-কলাকুশলী হারিয়েছে, যারা নতুন করে সংগঠন তৈরিসহ অর্থের বিনিয়োগসহ নতুনভাবে চলা অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। যারা সংগঠক হিসেবে আসল তাদের নৈতিকতার ভিত্তি পূর্বেকার মতো ছিল না এবং এতে নতুনভাবে যোগ হয় মুনাফা, লোভ ও অশ্লীলতা। গ্রামীণমেলাগুলোতে চলে জুয়ার হাউজির আসর ও অশ্লীল নৃত্য। এ কারণে শুরু হয় যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং সত্তরের দশকের শেষের দিকে এটি চরম রূপ নেয় এবং এই ধারা পরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলতে থাকে। সাধারণ আগ্রহী দর্শকরা যাত্রাপালার প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ায় এই ব্যবসায় ধস নামে। বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প সমিতির সভাপতি ও দেশ অপেরার মালিক শ্রী বিমল কান্তি বলেন, যাত্রা শিল্পের সোনালি দিন ছিল ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত যখন যাত্রা দলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় তিন শতাধিক এবং শিল্পকলা একাডেমিতে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ছিল ১১১টি। ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে সাত মাস (আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস) যাত্রা ভরা মৌসুম যার শুরুটা হয় দুর্গাপূজায় আর শেষ হয় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। কিন্তু প্রশাসন এখন আর যাত্রা গান আয়োজনে অনুমোদন দিতে আগ্রহী নন নিরাপত্তাজনিত কারণে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতি বছর যাত্রা দলের নামে নিবন্ধনের জন্য প্রত্যেক যাত্রা দলের কাছ থেকে নির্ধারিত ফি বাবদ টাকা গ্রহণ করে থাকে অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শিল্পের উন্নয়নে কোনো কাজ করে না। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আটচল্লিশ বছরে মাত্র পাঁচবার জাতীয়ভাবে যাত্রা উৎসব শিল্পকলা একডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এবং প্রথম বছরটিতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল খুলনার শিরিন অপেরার অভিনীত ‘নিহত গোলাপ’ পালার জন্য। তারপর সর্বশেষ ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমি ঢাকার বাছাই করা সাতটি দল নিয়ে তিনবার যাত্রা উৎসব করেছিল। কিন্তু এরপর এই প্রতিষ্ঠানটির আর তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এই শিল্পের নেতারা বলছেন প্রতিটি দলে শিল্পী ও কলাকুশলী নিয়ে প্রায় অর্ধ শতাধিক লোক তাদের মধ্যে কেউ বংশীবাদক, তবলচি করনেট বাদক, প্রমটার ইত্যাদি। সেই হিসাব যদি সত্যি হয় তবে তিনশ দলে সারাদেশে প্রায় পনেরো হাজার লোকের কর্মসংস্থান তথা জীবন-জীবিকা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। নিয়মিত পালা না হওয়ায় এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিনেতা, অভিনেত্রী, গায়ক, বাদক, পালাকাররা চলে যাচ্ছে পেশা ছেড়ে- এমনকি দেশ ছেড়ে। এখন পর্যন্ত যারা টিকে আছে কোনোভাবে তাদের সংখ্যা দশটির মতো। এমতাবস্থায় বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে বাঙালির এককালের বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ যাত্রাপালা। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, হাতের কাছে বিনোদনের সহজলভ্যতা, অশ্লীল নৃত্য আর জুয়ার আবর্তে পড়ে বাঙালির লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য আজ সংকটাপন্ন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা বিভাগ যাত্রাশিল্পীর ক্ষেত্রে এত উদাসীন কেন? এই প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামোগত সুবিধা রয়েছে এবং কেবল উদ্যোগের অভাবে জাতীয় যাত্রা উৎসব আয়োজনে তারা পিছপা হচ্ছে তা সংস্কৃতির অঙ্গনের জন্য ক্ষতিকর। দর্শকের কাছ থেকে যে চাঁদা আহরিত হবে তা দিয়ে এসব আয়োজনের খরচ মেটানো সম্ভব। অথচ এর সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্য অনেক বেশি এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজের দক্ষতাকে প্রমাণ করে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির এক অপূর্ব মাধ্যম বলে বিবেচিত। সমালোচকরা বলছেন, সমসাময়িককালে যাত্রাশিল্পের অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ যাত্রাপালার ব্যবসায়ীদের অসাধুতা আর জুয়া, হাউসি ও অশ্লীলতা চালু যা আগের সময়ে ছিল না। এগুলোই চিরায়িত যাত্রাপালার মৃত্যুর কারণ। যাত্রাপালা সাহিত্য সংস্কৃতির তথা লোকজ শিক্ষার বাহক কিন্তু এর ওপর প্রয়োগধর্মী গবেষণা একেবারেই অপ্রতুল এমনকি দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার পাঠ্যসূচিতে এ বিষয়টির তেমন কোনো উপস্থিতি লক্ষণীয় হয় না- যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি দুর্বল দিক। আবার যারা সাহিত্য কিংবা নাট্যকলা বিভাগে গবেষণা করেন তাদের যাত্রা শিল্পের ওপর এমফিল কিংবা পিএইচডি করতে দেখা যায় না। ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এ শিল্প। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চতর গবেষণা বিভাগগুলোকে এ বিষয়ে প্রাধান্য দিতে হবে।

ড. মিহির কুমার রায় : অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, সিটি ইউনির্ভাসিটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App