×

মুক্তচিন্তা

মূল্যায়নের বাটখারায় জেন্ডার বাজেট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০১৯, ০৮:৪৭ পিএম

জেন্ডার বাজেট করেই দায়িত্ব শেষ নয়, নারীরা সব অধিকার উপভোগ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব বৈষম্য বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তা চিহ্নিত করে সেগুলো মোকাবেলার দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সরকার জেন্ডারবান্ধব বাজেট করলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো পর্যালোচনা, সমীক্ষা এবং বিশ্লেষণ নেই। আর এগুলো না থাকলে জেন্ডার বাজেটের আকার যত বড়ই হোক না কেন তাতে লিঙ্গীয় সমতা পরিমাপের বাটখারা খুব জুতসই হবে না।

প্রথমেই বলে নিই বাজেট এমন একটি বিষয় এবং যেসব অর্থনৈতিক শব্দ চয়নে এটি উপস্থাপিত হয় তার সঙ্গে দেশের বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের সংযোগ ঘটাতে পারে না। বাজেটগুলো কখনোই জনগণের বোঝাপড়ার ভাষায় উপস্থাপিত হয় না। যে কারণে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের বাজেট নিয়ে টগবগে আকাক্সক্ষা দরিদ্র কিংবা শ্রমজীবী মানুষের নেই। তারা বাজেট বলতেই বোঝে পারিবারিক বাজেট, আনে পরিবারের চাহিদা, আয় এবং ব্যয়ের হিসাব। সেই বাজেট তৈরিতেও হয়তো নারীর অংশগ্রহণ কম থাকে। তাই পরিবারে এখনো জেন্ডার বাজেটিংয়ের চল চালু না হলেও দেশের বাজেটে হয়েছে। জেন্ডার বাজেটের জেন্ডার বোঝাপড়ায় কতটুকু এগিয়েছে সেটি প্রতি বছরের জেন্ডার বাজেটের বণ্টন, ব্যবহার এবং অবস্থা পরিবর্তনের বিশ্লেষণ এবং তথ্য উপস্থাপিত হলে ভালোভাবে বোঝা যেত। প্রতি দেশেই এখন জেন্ডার বাজেটিং, জেন্ডার অডিটের মতো বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। সেই হিসাবে প্রতি বছরই বাজেটের আগে-পরে জেন্ডার বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়। দীর্ঘদিনের নানা ধরনের দেন-দরবারের পর সরকার দেশে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রথম ঘোষণা করে ২০০৯-১০ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে ৪টি মন্ত্রণালয়ের জন্য জেন্ডার বাজেট প্রস্তাব করা হয় এবং সে সময় বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। এবারে ১৩ জুন সংসদে উত্থাপিত ১১তম বাজেটে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। বলা হয়েছে এবারের বাজেটে জেন্ডার বাজেটিংয়ে বরাদ্দকৃত অর্থ গত অর্থবছরের তুলনায় ২৩ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা বেশি। এবং মোট বাজেটের ৩০ দশমিক ৮২ শতাংশ ও জিডিপির ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ৪৩টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জন্য এই জেন্ডার বাজেট উপস্থাপন করা হয়। এই জেন্ডার বাজেটিংয়ে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও ১৬টি বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জেন্ডার বাজেট আসলে কী? জেন্ডার বাজেটের মূল উদ্দেশ্য কী? নারীকে উন্নয়নের মূল জায়গায় বৈষম্যহীনভাবে নিয়ে আসার যে বিষয়টি কাজ করে সেটি হলো জেন্ডার বাজেট। অত্যন্ত সহজ এবং সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, জেন্ডার বাজেটিং আলাদা কোনো বাজেট নয়। আমাদের জাতীয় বাজেটকে নারীর প্রতি সংবেদনশীল এবং বৈষম্যহীন করে তোলাই জেন্ডার বাজেটের মূল লক্ষ্য। একটি রাষ্ট্রের মানুষদের নারীর প্রতি সংবেদনশীল করে তোলার প্রয়োজন এজন্য হচ্ছে যাতে নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূর করে একটি সমতাপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র তৈরি করা যায়। নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা মুক্তিযুদ্ধের সবচেড়ে বড় অঙ্গীকারগুলোর একটি, যা এখন সংবিধান কর্তৃক বিধিবদ্ধ। আর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বাস্তব দিক হচ্ছে জনসংখ্যার ৫০ ভাগ নারীকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করা, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আরো মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে এবং ত্বরান্বিত করবে। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো গত ৫টি অর্থবছরে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হলেও পুরোটা ব্যবহার হয়নি কোনো অর্থবছরেই। কারণটাও অনুমেয়। নারী উদ্যোক্তারা বলছেন, অর্থ ছাড়ের প্রক্রিয়ায় জটিলতার পাশাপাশি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং এ বিষয়ে এক ধরনের ‘গা ছাড়া’ ভাব জারি রয়েছে। তবে জেন্ডার বাজেটিংয়ে যতটা হাঁকডাক শোনা যায় বাস্তবে এর যে খুব একটা প্রয়োগ হয় না তা বোঝা যায় কর্মরত নারীর সংখ্যার দিকে তাকালে। ২০১০ সালে কর্মরত নারীর সংখ্যা ছিল ১৬ দশমিক ২ মিলিয়ন। যাদের আয় ছিল ১৮.৬ মিলিয়ন ডলার। ২০১৭তেও তাই। কেন তবে নারীর জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট পূর্ণোদ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না? নারী উন্নয়নে বিশ্বে আমাদের অবস্থান ৮২তম। দক্ষিণ এশিয়ায় এটি সবচেয়ে ভালো অবস্থা। তাহলে সমস্যাগুলো কী? এবং কোথায় কোথায় এই জেন্ডার বাজেটিং ধাক্কা খায়। যার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় এবং জাতীয় পরিসরে নারীর টেকসই উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ আরো বাড়ানো উচিত। আরো দেখতে হবে নারী উন্নয়নে বরাদ্দের টাকা সুব্যবহারের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী? এর পাশাপাশি গ্রাম পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তার জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাজেট উপস্থাপনের বক্তৃতায় বলা হয়েছে, নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা দূর করতে আইনগত সংস্কার করা হবে। জাতিসংঘে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডওর গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারার (২ ও ১৬.১.গ) বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি রয়েছে এবং এখনো সেটিতে সরকার একমত নয়। সিডও সনদের ২ নম্বর ধারায় বলা আছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। ১৬.১(গ) ধারায় বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। বৈষম্য বসবাস করছে পারিবারিক আইনেও। সব ছাপিয়ে যখন সব ধরনের বৈষম্যমূলক আইন বিলোপের ঘোষণা আসে তখন বিষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতে এক ধরনের ভালো লাগা শুরু হয়। তবে আদৌ সব ধরনের বৈষম্য যে বিলোপ হবে না তা বলতে সময়ের অপেক্ষা করতে হবে না। এবারের বাজেট বক্তৃতায় জেন্ডার বাজেট বারবার আলোচনায় এলেও নারীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং এই মুহূর্তের জন্য সবচেয়ে কাক্সিক্ষত নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি কোনোভাবেই আলোচনায় ছিল না। তবে সরকারি সেবার সুযোগ বৃদ্ধি, নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য দোকান বা স্পেস ভাড়ার ক্ষেত্রে যে ভ্যাট দিতে হতো তা প্রত্যাহার ইতিবাচক ভাবনার জোগান দেয়ার কথা। জেন্ডার বাজেট করেই দায়িত্ব শেষ নয়, নারীরা সব অধিকার উপভোগ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেসব বৈষম্য বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তা চিহ্নিত করে সেগুলো মোকাবেলার দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। এ জন্য বাজেট নারীর লিঙ্গীয় সমতা নিশ্চিত করতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে, বরাদ্দ সঠিক খাতে হচ্ছে কিনা, সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, উপকারভোগীদের ফিডব্যাক জানা এবং এসব বিষয়ের মূল্যায়ন প্রয়োজন। যেখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিই অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষার খাতের পরিসর বেড়েছে। দুগ্ধবতী মা, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এর পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের জন্যও ভাতা দিচ্ছে সরকার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেই ভাতার সুবিধা প্রতিবন্ধী নারীরা পাচ্ছেন না। পুরুষ প্রতিবন্ধীরাই বেশি পাচ্ছেন এবং এই বিষয়ে কোনো ধরনের তদারকি নেই। এ কথা দাবি করলে অন্যায় হবে না যে, অন্য নারীর তুলনায় ‘আদিবাসী’ নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে বাজেটে ‘আদিবাসী’ নারীদের জন্য আলাদা বরাদ্দের দাবি করে আসছে ‘আদিবাসী’ নারীরা। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। নারীদের উন্নয়নে এবং লিঙ্গীয় সমতা নিশ্চিত করতে গত কয়েক অর্থবছর থেকে জাতীয় বাজেটের সঙ্গে আলাদা করে জেন্ডার বাজেট ঘোষণা করা হলেও এর প্রভাব কেমন পড়েছে, সে চিত্র আমাদের কাছে আসছে না। এই বাজেট কি নারীর প্রতি সহিংসতা-নির্যাতন ও বৈষম্য কমাতে সহায়তা করছে? এই বাজেট প্রণয়নকারী ব্যক্তিরা কি জেন্ডার বাজেট কিংবা লিঙ্গীয় সমতার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ? প্রশাসনিক পর্যায়ে লিঙ্গীয় সমতা বোঝাপড়ায় কী বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কেননা এখন পর্যন্ত দেশের একটা বড় অংশ লিঙ্গীয় সমতা বুঝতে নারীকে নিয়ে কাজ করাকেই মনে করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সরকার জেন্ডারবান্ধব বাজেট করলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো পর্যালোচনা, সমীক্ষা এবং বিশ্লেষণ নেই। আর এগুলো না থাকলে জেন্ডার বাজেটের আকার যত বড়ই হোক না কেন তাতে লিঙ্গীয় সমতা পরিমাপের বাটখারা খুব জুতসই হবে না।

জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App