×

মুক্তচিন্তা

৪র্থ-৫ম শিল্পবিপ্লব ও সোসাইটি ৫.০

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০১৯, ০৯:০৪ পিএম

আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস, তার জাতিসত্তার জন্ম-বিকাশ-মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতা-উত্তর অর্ধ শতকের পথচলার সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যদি এসব পর্যালোচনা করি তবে নিশ্চিত করেই আমরা বলব আমাদের কেবল আলোচিত চতুর্থ বা পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের লক্ষ্যটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়- আমাদের রূপান্তরটা জাতিসত্তা থেকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক রূপান্তর, যা হয়তো শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনীয় নয়।

দুনিয়া যখন চতুর্থ বা পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের কথা বলছে কিংবা জাপান যখন সোসাইটি ৫.০ নিয়ে সামনে যাচ্ছে তখন বাংলাদেশ যে তার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে তার অবস্থানটি কোথায়- সেই প্রশ্নটি আমাদের সবার মাঝেই দেখা দিতে পারে। আমাদের অনেকেই মনে করেন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবই হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। মনে মনে ভাবেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে ডিজিটাল বাংলাদেশ হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এটিকে কেবল ডিজিটাল বিপ্লব বলে মনে করেন। কারো কারো তুলনায় এটি ব্রিটেনের ডিজিটাল ব্রিটেন বা ভারতের ডিজিটাল ইন্ডিয়ার মতো। একদম হাতেগোনা কয়েকজন হয়তো এটি জাপানের সোসাইটি ৫.০ হিসেবেও বিবেচনা করে বসছেন। ২০২১ সালকে যখন আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করি তখন কিন্তু এসব ঘোষণা বা চিন্তার কোনোটারই অস্তিত্ব ছিল না। আমরা আমাদের নিজেদের মতো করে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করেছি। ২০০৮ সালের ইশতেহারে অনুচ্ছেদ ১০.৫-এ বলা হয়েছিল, “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি : আইসিটি খাতের সম্ভাবনাকে সার্থক করে তোলার ব্যবস্থা নেয়া হবে। দেশের প্রতিভাবান তরুণ ও আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সর্বোতভাবে সহায়তা দিয়ে সফটওয়্যার শিল্প ও আইটি সার্ভিসের বিকাশ সাধন করা হবে। এতে রপ্তানি বাড়বে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। ২০২১ সালের লক্ষ্য হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে মাধ্যমিক স্তরে এবং ২০২১ সালে প্রাথমিক স্তরে আইটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গঠিত এবং জোট সরকারের আমলে নিষ্ক্রিয় করা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক টাস্কফোর্স সক্রিয় ও কার্যকর করা হবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইসিটি ইনকুবেটর এবং কম্পিউটার ভিলেজ স্থাপন করা হবে। ইশতেহারের এই অনুচ্ছেদে ‘২০২১ সালের লক্ষ্য হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাক্যটি ছাড়াও পরিশিষ্টে ১৫নং অনুচ্ছেদে লেখা ছিল ‘২০২১ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিতি লাভ করবে।” দলীয় বা সরকারিভাবে ইশতেহারের এই বিবরণটুকুর বাইরে তেমন আর কিছু লেখাই ছিল না। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে কেবল একটি সেমিনার করে। ২০ ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে যে কয়টি লেখা ছিল তার সবকটাই ছিল আমার। সাতক্ষীরা কম্পিউটার সমিতির স্মরণিকা, দৈনিক করতোয়ার উপসম্পাদকীয় বা মাসিক কম্পিউটার জগতের এপ্রিল ২০০৭ সংখ্যার লেখাগুলো ডিজিটাল বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ততম চিত্র উপস্থাপন করেছে। সেই থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে তো লিখেই যাচ্ছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে আমার। যারা আমার বইটি পড়েছেন বা নিয়মিত লেখাগুলো পাঠ করেন তারা এরই মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণাই পেয়েছেন। অন্যদিকে এরই মাঝে দিনে দিনে দলীয় এবং সরকারি পর্যায়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা বিকশিত হয়েছে। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, আমাদের দলের ও সরকারের অনেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ ও শিল্পবিপ্লবের বিষয়গুলোকে এক করে ফেলছেন। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এটুকু অনুধাবন করানো যে আমরা কেবল শিল্পবিপ্লবেই থেমে নেই, আমাদের যাত্রাটা আরো একটু বড়। অন্যদিকে আমাদের তুলনাটা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে করা উচিত নয় বা কাউকে অনুসরণ করে নয়- আমাদের পথ আমাদেরই তৈরি করতে হচ্ছে। খুব সংক্ষেপে কেবল এই কথাটি বলা যেতে পারে যে, আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস, তার জাতিসত্তার জন্ম-বিকাশ-মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতা-উত্তর অর্ধ শতকের পথচলার সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যদি এসব পর্যালোচনা করি তবে নিশ্চিত করেই আমরা বলব আমাদের কেবল আলোচিত চতুর্থ বা পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের লক্ষ্যটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়- আমাদের রূপান্তরটা জাতিসত্তা থেকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক রূপান্তর, যা হয়তো শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনীয় নয়। একেবারে আঁতকে ওঠার মতো একটি খবর হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উদ্যোক্তা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম তাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আলোচনার পাশাপাশি আলোচনা করছে পঞ্চম শিল্পবিপ্লব নিয়ে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আলোচনার সূত্রপাতটাও এই সংস্থাই করেছিল। উইকিপিডিয়ার তথ্য এ রকম : বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস সোয়াবের ২০১৫ সালের একটি লেখা থেকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের শব্দগুলো বিশ্ব ফোরামের জন্য চয়ন করা হয়। সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে আয়োজিত ২০১৬ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘মাস্টারিং ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভিওলিসন’। ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর সানফ্রান্সিসকোতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কেন্দ্র স্থাপিত হয়। সোয়াব তার বইতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চিহ্নিত করতে গিয়ে হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, জীববিদ্যার বিষয়গুলো ছাড়াও ডিজিটাল সংযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির প্রতি দিকনির্দেশ করেন। রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়ো টেকনোলজি, আইওটি, ৫জি, ৩ডি মুদ্রণ এবং সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় যানবাহন প্রযুক্তিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মহাসড়ক হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন। আমার হাতে ২০১৬ সালে ব্রিটেন থেকে পেঙ্গুইন প্রকাশিত কার্লস সোয়াবের যে পেপারব্যাক বইটি স্নেহভাজন নুরুল কবিরের সৌজন্যে রয়েছে তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ২০১১ সালের হ্যানোভার মেলাতে প্রথম চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটি উচ্চারিত হয় এবং এর ধারণা প্রধানত প্রচলিত শিল্প-কলকারখানার ডিজিটাল উৎপাদন ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করে। সোয়াব অতীতের বিপ্লবগুলোকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার সারাংশ হলো- ১. কৃষি বিপ্লব বস্তুত শুরু হয় যখন মানুষ বণ্য প্রাণীকে পোষা প্রাণীতে পরিণত করতে পারে তখন থেকে। তিনি সময়টি ১০ হাজার বছর আগের বলে মনে করেন। তিনি প্রাণীকে ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন, পণ্য পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়টি উল্লেখ করেন। অবশ্য তিনি ভুলে যাননি যে এর সবটাই হয়েছে মানুষের হাতে। তার মতে কৃষি যুগের পরে ধারবাহিকভাবে শিল্পবিপ্লব প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা সবাই জানি বাষ্পীয় ইঞ্জিনভিত্তিক ছিল ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ পর্যন্ত প্রথম শিল্পবিপ্লব। এর পরের বিপ্লবটা বিদ্যুৎনির্ভর, যার সঙ্গে গণউৎপাদন, এসেম্বলি লাইন এবং বিদ্যুৎনির্ভর প্রযুক্তির ব্যাপক সম্পর্ক ছিল। সোয়াব মনে করেন, ষাটের দশকে সেমি কন্ডাক্টর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়। এখনকার সময়টাকে তিনি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময় বলে চিহ্নিত করেছেন। একুশ শতকে এসে শিল্পোন্নত ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপান অনুভব করছে যে মানুষের অভাবে তারা বর্তমানের শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারছে না। প্রথমত, পোশাকশিল্প বা অনেকটাই কায়িক শ্রমকেন্দ্রিক অন্য শিল্প উৎপাদনের কায়িক বা মেধা শ্রমের জোগানদার তারা থাকতে পারেনি। এসব শিল্প তাদের হাতছাড়া হয়ে চলে এসেছে বাংলাদেশ, নেপাল, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন বা এই ধরনের দেশে। ওরা অনুভব করে যে, মানুষ নিয়ে বড় সংকটটা তাদের কেবল কায়িক শ্রম নয়, মেধা শ্রম নিয়েও। কারণ মানুষ ছাড়া মেধারও উৎপত্তি ঘটে না। সে জন্য তারা ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষের মেধার ঘাটতিটাও পূরণ করতে চায়। আমি আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে স্মরণ করতে পারি যে, ২০১৮ সালের মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে একজন জাপানি মন্ত্রীকে ড্রাইভারবিহীন গাড়ি পাওয়ার জন্য উল্লাস করতে দেখেছি। তারই প্রতিবাদে আমি বলেছিলাম, মানুষকে বলি দিয়ে আমরা প্রযুক্তি চাই না। প্রযুক্তি মানুষের জন্য, মানুষ প্রযুক্তির জন্য নয়। এবার মোবাইল ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস এবং উইসিসেও একই কথা বলেছি। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে ইউরোপ বা আমেরিকার মতো করে ধারণ করতে চাই না। এমনকি প্রস্তাবিত পঞ্চম শিল্পবিপ্লবকেও শিল্পোন্নত দেশগুলোর মতো করে নিতে চাই না। বরং বাংলাদেশের নিজস্ব ঘোষণা ডিজিটাল বাংলাদেশ এসব বিপ্লবের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি গণমুখী। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও সোসাইটি ৫.০ : তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এবার জাপানে আয়োজিতব্য তাদের সম্মেলনে জাপানের সোসাইটি ৫.০ ধারণাটিকে প্রতিপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। সঙ্গত কারণেই বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এখন পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের কথা বলছে। গত ১৫ মে ২০১৯ এই সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত এই বিষয়ক একটি নিবন্ধ বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিশ্বকে নতুন করে মূল্যায়ন করার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। হুয়াট দ্য ফিফথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভিলিউশন ইজ এন্ড হুয়াই ইট ম্যাটারস শিরোনামের একটি নিবন্ধে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের একটি তুলনা উপস্থাপন করেছে। নিবন্ধটির মূল প্রতিপাদ্য বস্তুত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জকেই উপস্থাপন করেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বৈশিষ্ট্যগুলোকে নিম্নরূপে বর্ণণা করা হয়েছে। ১. কর্মসংস্থান ও দক্ষতার আমূল পরিবর্তন, ২. উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতা, ৩. বৈষম্য, ৪. গতিশীল প্রশাসন, ৫. নিরাপত্তা ও বিরোধের বিস্তৃতি, ৬. ব্যবসার আমূল পরিবর্তন, ৭. অভাবিত প্রযুক্তি এবং ৮. নৈতিকতা ও ব্যক্তি পরিচয় সংকট। এই আটটি বিষয় পর্যালোচনা করলেই একদিকে যেমন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগ্রাসন অনুভব করা যায় তেমনি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সংকটগুলোও বোঝা যায়। সে জন্যই হয়তো বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যান্ত্রিকতা অতিক্রম করে পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের মানবিকতার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা বা শিল্পোন্নত দেশগুলোর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মাতামাতির মাঝে আকস্মিকভাবে এর নেতিবাচক দিকগুলোও আলোচনায় আসতে পারে, সেটি আমি অন্তত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের কাছ থেকে আশা করিনি। যা হোক বিপর্যয়ের আগেই বোধোদয় হলে তার প্রশংসাই করা উচিত।

মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App