×

সাময়িকী

সূর্য ওঠার আগে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০১৯, ০৩:৫২ পিএম

সূর্য ওঠার আগে
হ্যাঁ এসেছি, আবার আসিনি। ও সব কথার বুজরুকি রাখো। নিজের রিফ্যুজি নাম ঘুচাতে পেরেছ? কী মুশকিল, ওপার থেকে এসেছি, আমরা রিফ্যুজি এসব তো আমি মোটেই অস্বীকার করছি নে! তাহলে এসেছি আসিনি, এসব মারফতি কথার মানে কী? মানে হচ্ছে এপারে আমরা দুভাই এক বোন এসেছি। কিন্তু তোমরা ভুলে যাচ্ছ কেন আমার দুই বোন এখনো ঘরসংসার করছে ওপারেই। সেই বোনের পেটের ছেলেমেয়েরা ভারতীয় নাগরিক। আসিনি মানে এবার বুঝেছ? শোনো বন্ধু, আমি সব বুঝি। পশ্চিমা শাসন শোষণ বুঝি। ৬-দফা বুঝি। ঢাকায় গিয়ে দেখে এসেছি মানুষের উত্তাল জাগরণ। কিন্তু ভাগাভাগিতে আমার খুব ভয়। মানুষের থাকে হারাবার ভয়। তোমার কিসের ভয়? কী হারাব বলো! আমার হারাবার মতো কী ইবা আছে! ভয়টা কিসের তবে? সে আমি বলতে পারব না। তবে ভারত ভাগের সময় আমার ছোট চাচাকে হারানোর কথা আমি যে কিছুতেই ভুলতে পারি না দোয়াজ! দোয়াজউদ্দীনের মুখে এবার আর কথা সরে না। মুজিবুর রহমানের চেয়ে মাত্র বছর পাঁচেকের বড় ছিল তার ছোট চাচা। তবু চাচা-ভাইপোর খুব ভাব ভালোবাসা। ছোট চাচা সেই বয়সেই স্থানীয় মসজিদে ইমামতি করতেন, ভাইপোকে মাদ্রাসা লাইনে পড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন। সাতচল্লিশের পর স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মধ্যে পড়ে সেই ছোটচাচা প্রাণ হারান। এ সব কথা বহু আগেই মুজিবুর রহমানের মুখে শুনেছেন দোয়াজউদ্দীন, তাই বলে বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে এতটা নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে চাইবেন তার বন্ধু, এমন সংকীর্ণ ধারণা কখনোই হয়নি বন্ধুর প্রতি। দোয়াজ মাস্টার নম্র কণ্ঠে বলেন, ছোটচাচার মৃত্যুর কথা তুমি বলেছ, আমার মনে আছে। মৃত্যু নয়, বলো মার্ডার। খুন। একটু থেমে বলেন, জানো, ছোটচাচার লাশটা পর্যন্ত দাফন করতে দেয়নি ওরা। এতই নিষ্ঠুর! হ্যাঁ, সে কথাও শুনেছি তোমার কাছে। তাহলে! সেই ভারতের কাছে আবার মাথা নোয়াতে হবে? এই দ্যাখো! মাথা নোয়ানোর প্রশ্ন উঠছে কেন? প্রশ্ন উঠছে, কারণ ভারত তো হাত বাড়িয়েই আছে, কব্জা করতে কতক্ষণ! দোয়াজউদ্দীন অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে ব্যাখ্যা দিতে চান, ভারত আমাদের নিকটতম এবং বৃহত্তম প্রতিবেশী। আমাদের বিপদে আপদে সবার আগে আমাদের পাশে দাঁড়াবে, সেটাই তা স্বাভাবিক। মুজিবুর রহমান কটাক্ষ করেন, হ্যাঁ, খুব দাঁড়াবে তোমার পাশে! পঁয়ষট্টি সালে ভারতের ভ‚মিকা মনে নেই? আহা পঁয়ষট্টি সালের বাস্তবতা আর আজ এই একাত্তরের বাস্তবতা কিন্তু এক নয়। এই পাঁচ বছরেই বদলে গেল বাস্তবতা? তুমি আসলে তর্কের জন্য তর্ক করছ বন্ধু। পঁয়ষট্টি সালের কথাই যখন তুললে, পাকিস্তানি শাসকদের ভূমিকার কথা মনে করে দ্যাখো তো! ভারতীয় আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত জুড়ে যতটা নিরাপত্তা জোরদার করেছে, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে কি তাই করেছে? দেশের এক অংশের মানুষের জানমাল ঝুঁকির মধ্যে ফেলে রেখে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে তারা.... মুজিবুর রহমান মাঝপথে বন্ধুকে থামিয়ে দেন, তাদের বৈষম্যের কথা আমার অজানা নয়, কিন্তু তাই বলে,... ইচ্ছে করলে সেই পঁয়ষট্টিতেই ভারত আমাদের এই পূর্ব বাংলায় হামলা করতে পারত, এমনকি দখল করে নিতেও পারত। তা করেনি। একাত্তরের বাস্তবতা তো আরও ভিন্ন! আমার উদ্বেগের জায়গাটা বোধ হয় তুমি ধরতে পারোনি। তোমার একার উদ্বেগ হবে কেন, উদ্বেগ তো গোটা জাতির। বাঙালি জাতি পরাধীনতার শেকল কেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে, মুক্তির আকাক্সক্ষায় টগবগ করে ফুটছে, স্বাধিকার শুধু নয় স্বাধীনতাই তার লক্ষ্য; এ তো খুব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠারই সময়। এ সময় ভুল সিদ্ধান্ত নিলে চলবে না। মুজিবুর রহমান এতক্ষণে একটু সহজ হয়ে আসেন। বন্ধুকে বলেন, মাস্টারি না করে তোমার তো রাজনীতি করাই ভালো ছিল দেখছি। নিদেন পক্ষে কোর্টে গিয়ে ওকালতি করলেও বেশ দাঁড়িয়ে যেতে দেখছি। কেন, এখনো তো আমি দাঁড়িয়েই আছি! না, আরও একটু শক্ত হয়ে দাঁড়ানো। পায়ের তলে মাটি থাকবে, এলাকার সব মানুষের আশা-ভরসা থাকবে; তুমি নেতৃত্ব দেবে, এমন হতে পারে না? এতক্ষণে তুমি আমার সঙ্গে তামাশা করছ? মাথা খারাপ! তামাশা করব কেন? ওই যে বললে না কিসের যেন সংগ্রাম কমিটির নেতা হয়েছ তুমি! বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি। ইচ্ছে করল তুমিও সগ্রাম কমিটি খুলতে পারো তোমার গ্রামে। ওখানে কি সংগ্রাম কমিটি গঠন হয়ে গেছে? এ প্রশ্নের স্বতঃস্ফ‚র্ত জবাব দিতে পারেন না মুজিবুর রহমান। সূর্যখোলা গ্রামের সব শ্রেণির মানুষের কাছে সামাজিক ও ধর্মীয় বিবেচনায় যতটা শ্রদ্ধেয় তিনি, রাজনৈতিক বিবেচনায় ততটা আস্থাবান নন। ফলে গ্রামের ইশকুল মাঠে বসে সংগাম কমিটি গঠিত হবার খবর তিনি শুনেছেন, কিন্তু ওই শোনা পর্যন্তই; এর বেশি কৌত‚হল জাগেনি তার অন্তরে। বরং এখন তিনি সেই কৌত‚হল দেখান বন্ধু দোয়াজউদ্দীনের কাছে, জানতে চান, এই সব সংগ্রাম কমিটি দিয়ে কী হবে বলো তো! কেন, বঙ্গবন্ধু তো বলে দিয়েছেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের জন্য সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা করবে এই কমিটি। এতক্ষণ পর মুজিবুর রহমান বলেন, তা বেশ বুঝলাম। এখন আমি বাড়ি যাই কেমন করে বলো দেখি! না না, বাড়ি যাবে কেন! বরং আরেক কাপ চা খেয়ে চলো উঠি। আমার সঙ্গে চলো। কোথায়? সন্ধ্যের পর মানিকনগর ভবেরপাড়া, আনন্দবাস, রতনপুর বাগোয়ান সব গ্রামে গ্রামে মিছিল বেরোবে সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে। তুমিও চলো আমার সঙ্গে। মাথা খারাপ! নিজের গ্রাম ফেলে এসে বুড়ো বয়সে মিছিলে নামব তোমার গ্রামে? ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, শোনোনি? তবু তুমি থাকো, আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ঘুরে আসছি। রাতে আরো কথা হবে। সেদিন এভাবেই তর্কে তর্কে গল্পে গল্পে শেফালির বাসায় তাঁর আটকে যাওয়া। পাঁচ. বাড়ি আসার পর থেকে একটা রেডিওর অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছে হাফিজুর। কিন্তু সে কথা কাকে বলবে? সূর্যখোলার ধর্মীয় শিক্ষক শেখ মোঃ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে গমগম করে রেডিও বাজবে, সেই রেজিওতে দুমদাম করে হিন্দি উর্দু গান বাজবে ব্যাপারটা খুবই বেমানান এবং দৃষ্টিকটু দেখাবে হয়তো, কিন্তু চরম উত্তেজনাকর এই সময়ে দেশের খবরাখবর পেতে হলে রেডিও না শুনলে চলে! অগত্যা খবর শোনার জন্যই প্রতি সন্ধ্যায় হাফিজুরকে নবিরের চায়ের দোকানে আসতে হয়। গ্রামের বুক চিরে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া প্রধান সড়কটি যাবার সময় এ গ্রামের হাটতলায় যে বুড়ো বটগাছের কাছে বুড়িছোঁয়ার ভঙ্গিতে একটুখানি ছুঁয়ে গেছে, দু’চারজন বাসযাত্রী ওঠা-নামার কারণে সেই বটতলায় বেশ কয়েকটি দোকান বসে বাজার মতো গড়ে উঠেছে। নবিরের চায়ের দোকান এই গ্রাম্য বাজারের প্রাণকেন্দ্র। টু-ব্যান্ড কি থ্রি-ব্যান্ডের একটা স্যানিও রেডিও এ দোকানের প্রধান আকর্ষণ। মওলানা ভাসানীর কর্মী-সমর্থক লাল টুপিঅলারা নিয়মিত এসে এই দোকানের লাল চা আর টোস্ট খায়, উচ্চস্বরে নানান সেন্টারের নানা ভাষার খবর শোনে এবং তারও চেয়ে উচ্চকণ্ঠে খবররের বিশ্লেষণ ও বাকবিতণ্ডা চালিয়ে যায়। গ্রামে সংগ্রাম কিমিট গঠিত হবার পর থেকে তারাও গ্রাম্য রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে মিছিল করে, জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে সারা গ্রাম জাগিয়ে তোলার পর তারাও এই নবিরের দোকানে এসে খবর শোনে, চা খায়। কখনো কখনো লাল টুপিঅলাদের সঙ্গে ঠুনকো কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে তীব্র কথা কাটাকটিও হয়। গ্রামের একমাত্র উচ্চ শিক্ষিত ছেলে হিসেবে হাফিজুরকে মাঝেমধ্যে রেফারির ভ‚মিকাও পালন করতে হয়। হুজুর স্যারের ছেলে হিসেবেই হোক, কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলেই হোক, তার মধ্যস্থতা অনেকেই বেশ মেনে নেয়। সূর্যখোলা গ্রামে আরো দু’চারটি রেডিও আছে। তার মধ্যে একজন আছে মুসলিম লীগের গোঁড়া সমর্থক, তার বাড়িতে খবর শুনতে কেউ যায় না। অন্য সব রেডিওর সামনে মানুষজন গোল হয়ে বসে। জসীমউদ্দীনের মধুমালা বা বেদের মেয়ে হলে তো কথাই নেই, না হলেও ক্ষতি নেই, বিবিসি ভয়েস অব আমেরিকা এমন কি আকাশ বাণী বিবিধ ভারতীয় খবর-টবর শুনে মধ্যরাতে হাই তুলতে তুলতে সবাই বাড়ি ফিরে যায়। খবরের কাগজের সঙ্গে তো সম্পর্ক নেই গ্রামের মানুষের, ওই রেডিওই যা ভরসা। তবে রেডিওকে ঘিরে প্রধান আসরটি নিয়মিত বসে নবিরের চায়ের দোকানে। ধর্মীয় শিক্ষক শেখ মোঃ মুজিবুর রহমানেরও ইচ্ছে করে দেশের আন্দোলন সংগ্রামের খবরাখবর জানতে। একটি রেডিওর প্রয়োজনীয়তা ইদানীং বেশ অনুভব করেন তিনি। কিন্তু এই দুঃসময়ে রেডিও কিনে বাবুগিরি দেখাবার মতো সামর্থ্য কোথায় তার! নবিরের দোকানে বসা হয় না, আবার কারো বাড়ি গিয়ে খবর শুনতেও পারেন না; অথচ তার ভেতরে এক ধরনের ছটফটানি ঠিকই কাজ করে। তখন আর কী করবেন, ঘুম না আসা মধ্যরাতে নিজের ছেলে হাফিজুরকেই চেপে ধরেন, জিজ্ঞেস করেন, ঢাকার খবরাখরর কি কিছু পাওয়া যাচ্ছে হাফিজুর রহমান? আলোচনা বৈঠক আর কদ্দিন চলবে বলতে পারো? হাফিজুর খুব সহজেই উত্তর দেয়, ওই যে বঙ্গবন্ধু আলোচনার দুয়ার বন্ধ করতে চান না। কাজেই আলোচনা চলবে। এদিকে পঁচিশ তারিখ যতই এগিয়ে আসছে, পরিস্থিতি ততই ঘোলাটে হয়ে উঠছে। হ্যাঁ, পঁচিশ তারিখে এ্যাসেম্বলি বসার আগে একটা সমাধান তো হতে হবে! কী করে সমাধান হবে! ভুট্টো এসেছেন ঢাকায়। সব নষ্টের গোড়া তো এই লোকটা। দ্যাখো তিনি আবার কী জটিলতা তৈরি করেন। হাফিজুর অবাক চোখে বাবার দিকে তাকায়, পরিস্থিতি জটিলতার জন্য আপনিও তাহলে ভুট্টোকেই দায়ী মনে করেন আব্বা? অবশ্যই। এই লোকটার গোঁয়ার্তুমির জন্যই পাকিস্তান আজ ভাঙতে বসেছে। বিস্ময়ে চোখের পলক পড়ে না হাফিজুরের। তার বাবার রাজনৈতিক বোধ ও বিশ্বসের জায়গাটা বরাবরই দুর্বোধ্য মনে হয়েছে। অবশ্য আগে কখনো এসব বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনার সুযোগও ঘটেনি। গতকাল মেহেরপুর থেকে এক কপি ইত্তেফাক এনে হাতে দিলে তিনি কী যে খুশি হন। পাতার পর পাতা মনোযোগ দিয়ে পড়েন আর ক্ষণে ক্ষণে ছেলেকে ডেকে এটা সেটা নানান প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়নের সুসজ্জিত গণবাহিনী রাজপথে বন্দুক উঁচিয়ে সামরিক কায়দায় কুচকাওয়াজে অংশ নেয়। হাজার হাজার জনতা রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে তাদের অভিনন্দিত করে। সাধু ভাষায় এই খবরটুকু পড়ে মুজিবুর রহমান রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, এ কী লিখেছে হাফিজুর রহমান, যুদ্ধ কি তবে শুরু হয়ে গেল? কুচকাওয়াজের ছবির উপরে আঙুল রেখে বলেন, প্রকাশ্যে রাজপথে বন্দুকের মহড়া! হাফিজুর খুব শান্তভাবে জানায়, যুদ্ধ শুরু হয়নি আব্বা, এ হচ্ছে প্রস্তুতি। আপনি ঠিকই বলেছেন মহড়া। কিসের প্রস্তুতি? ওই বঙ্গবন্ধু বলেছেন তোমরা প্রস্তুত থাকবা। যার যা আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে! তাই বলে বন্দুক নিয়ে মহড়া? ছাত্ররা বন্দুক পেলো কোথায়? হাফিজুর একটু খানি হাসে, প্রয়োজনের সময় সব জোগাড় হয়ে যায় আব্বা। রাইফেল বন্দুকও জোগাড় হয়? হয় আব্বা। ঢাকার কুচকাওয়াজ দ্রুত ছড়িয়ে যাবে সারা দেশে। বলো কী! আমাদের মেহেরপুর-গাংনীতেও? জ্বি আব্বা। এর বেশি বলতে সাহস হয় না হাফিজুরের। অথচ মেহেরপুর কলেজের রোভার স্কাউট দল প্রস্তুত হচ্ছে, ড্যামি বন্দুক নিয়ে যে কোনো দিন, রাস্তায় নেমে কুচকাওয়াজ করবে। ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী বিল্লাহ্ সে কী তৎপরতা! হাফিজুর পুরনো বন্ধুদের খুঁজতে মেহেরপুরে এসে প্রথমে হানিফের দেখা পায়। সে-ই ধরে নিয়ে আসে কলেজে। তখনই জানতে পারে রোভারদের কর্মকাণ্ড। শহর থেকে আতাউল হক লাল মিয়া এসে নির্দেশ দেন আজই কলেজ প্রাঙ্গণে কুচকাওয়াজের আয়োজন করতে হবে। এসডিও সাহেব দেখতে আসবেন। রোভার দলের সালাম নেবেন। মেহেরপুরে বহুদিন পর বাঙালি এসডিও এসেছেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। হালকা-পাতলা শরীরের সাদাসিধে মানুষ। কী তেজ আর কী যে সাহস! পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত আপদমস্তক বাঙালি! একজন মহকুমা প্রশাসকের কত রকম কাজ থাকে, সে সব কাজ গোছাতেই সময় ফুরানোর কথা। অথচ এই মানুষটি রাজনীতিবিদের মতো করে আন্দোলন-সংগ্রামের খবরাখবর নিয়ে বেড়ান। মেহেরপুরের বন্ধুদের কাছ থেকে এই অসাধারণ মানুষটির গল্প শুনে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এসেছ হাফিজুরের। আজ এই কলেজ প্রাঙ্গণে এসডিও সাহেবের দেখা পাওয়া যাবে শুনে হাফিজুর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। উত্তেজনায় ছটফট করে কখন আসবেন তিনি, কখন....। সেদিন সেই আসা হয়নি এসডিও সাহেবের। চুয়াডাঙ্গা নাকি ঝিনাইদহ কোথায় যেন জরুরি মিটিংয়ে বেরিয়ে গেছেন। সেখান থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছে। লাল মিয়া জানান রোভার দলকে প্রস্তুত থাকতে হবে, কাল-পরশু যে কোনোদিন তিনি কুচকাওয়াজ পরিদর্শনে আসবেন। হাফিজুর মন খারাপ করে বাড়ি চলে আসে। এ সব কথার বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত কিছুই সে বলেনি তার বাবার কাছে। বরং একটু আড়াল থেকে সে তার বাবার কৌত‚হলের মাত্রা পরখ করে দেখতে চায়। সূর্যখোলা গ্রামের ধর্মীয় শিক্ষক মো. মুজিবুর রহমান ইদানীং বেশ টের পান, তাঁর বুকের ভেতরে উথাল পাথাল নদী ভাঙনের খেলা চলছে। মনে মনে কত রকম প্রশ্নের উদয় হয়, ভাসতে ভাসতে সে প্রশ্ন আবার এক সময় তলিয়ে যায়। কারো কাছেই মুখ ফুটে বলা হয় না। ইশকুলের সহকর্মীদের সাথেও দুস্তর দূরত্ব অনুভব করেন, গ্রামে কার কাছে মুখ খুলবেন! বলতে গেলে তার চোখের সামনেই এ গ্রামের মানুষ সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট, তার নামটা কেউ প্রস্তাব করেছে নাকি বিবেচনায় এনেছে! সেই মিটিংয়ে কেউ ডাকেনি তাকে। না ডাকলে কী হবে, কান তো তার খোলাই আছে, সব খবরই তার কানে আসে। অশিক্ষিত হলেও আজিজ মেম্বর যথেষ্ট বিচক্ষণ এবং যোগ্য মানুষ, তাকে আহ্বায়ক করা ঠিকই হয়েছে। কিন্তু অবশিষ্ট ১২ সদস্যের মধ্যে কোথাও তার জায়গা হতে পারে না? এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে ব্যাপারটা উল্টো দিক থেকে মিলিয়ে দেখতে বসেন গ্রামের মানুষ কেন তাকে ডাকবে এ ধরনের রাজনৈতিক মিটিংয়ে? সংগ্রাম হিসেবে কেনইবা তার নাম প্রস্তাব হবে? (চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App