×

সাময়িকী

রুদ্র একটি গল্পের নাম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০১৯, ০৪:০৮ পিএম

রুদ্র একটি গল্পের নাম
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি নাম। ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন এ কবি। তাঁর মূল বাড়ি হচ্ছে বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে। তাই কবির স্মরণে মিঠেখালিতে রয়েছে ‘রুদ্র স্মৃতি সংসদ’। রুদ্রর পিতৃদত্ত নাম ‘মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ’। ছোটবেলায় এই নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। লেখালেখির জগতে এসে নামটি তিনি নিজেই বদলে দেন। নামের আগে যোগ করেন ‘রুদ্র’, ‘মোহাম্মদ’-কে করেন ‘মুহম্মদ’ আর ‘শহীদুল্লাহ’-কে ‘শহিদুল্লাহ’। নিজ প্রদত্ত এই নাম শুধু লেখক হিসেবেই নয়, পরীক্ষার সনদেও তিনি ব্যবহার করেছেন। কবি রুদ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এমএ পাস করেন। জানা যায়, ছাত্র থাকা অবস্থায় সক্রিয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। ব্যক্তিজীবনে স্বাধীনচেতা এ কবির বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা ছিল অনেক। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন রুদ্র। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশে সবগুলো আন্দোলনে কবি রুদ্র সশরীর অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং ধারণা করা হয় এসব থেকেই তিনি বেশ কিছু দ্রোহের কাব্য রচনা করেন। বাতাসে লাশের গন্ধ কিংবা ভালো আছি ভালো থেকো এই দিয়েই আমরা বোধহয় জানি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে, যদিও এর বাইরে আরো অনেক পরিচয় তাঁর আছে। এর বাইরে আরো অনেক কিছুই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সাহিত্যের পরিধি কম ছিল না। তাঁর জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’, ‘এক গ্লাস অন্ধকার’, ‘ভালবাসার সময় তো নেই’, ‘নপুংসক কবিদের প্রতি’। এর মধ্যে তাঁর কিছু কাব্যগুলোর পেছনে আছে দীর্ঘ এই ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসে জড়িয়ে আছে আরেকটি পরিচিত নাম। বাংলাদেশি নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের সাথে রুদ্রর চুটিয়ে প্রেম কারোরই অজানা নেই হয়তো। তৎকালীন সময়ে সুদূর ময়মনসিংহ ছুটে যেতেন রুদ্র প্রেমিকা তসলিমার টানে। আর এই জুটি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৮১ সালে। কিন্তু নানান কারণে ১৯৮৬ সালে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। আর সেই বিচ্ছেদের পরবর্তী সময়গুলো রূপ নেয় এক অনন্য কবিতাযুদ্ধে। পরস্পরের প্রতি তারা এক অলিখিত কবিতাযুদ্ধ ঘোষণা করে বসেন। হয়তো মুখোমুখি না বলা কথাগুলোর ভাষা রূপ নেয়ার ওটাই ছিল একমাত্র মাধ্যম। এই সময়েই কবি রুদ্র বেশ পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেন সাহিত্যিক অঙ্গনে। আর তসলিমা নাসরিন পরবর্তীতে আরো দুবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং সেগুলোও এক সময় বিচ্ছেদে পরিণত হয়। কবিতাযুদ্ধে একটা অনুভ‚তি দুজনেরই অপ্রকাশিত ছিলো আর তা ছিল একে অপরের প্রতি ভালোবাসা। তসলিমা এক সময় নিজেই বলেন রুদ্রের প্রতি তার অনুরাগের কথা। মোংলায় বসে রুদ্রর ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ কবিতায় কাকে আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখতে বলা হয়েছিল তা আজও রহস্য। হ্যাঁ, চিঠি লিখেছিলেন তসলিমা, তবে রুদ্রর মৃত্যুর পর। কয়েক বছর আগে তিনি রুদ্রর সেই চিঠির উত্তর লিখেছেন। বিচ্ছেদ মানেই যে একটি সম্পর্কের ইতি সেটা বিভিন্নভাবে দুজন প্রমাণ করে গেছেন, হোক কবিতার ভাষায় কিংবা তীব্র ঘৃণার মাধ্যমে। তাঁরা একে অপরকে প্রতিনিয়ত খুঁজে গেছেন প্রেমে পড়ার মুহূর্তগুলোতে, পাশাপাশি থাকার দিনগুলোতে, অভিমানী সময়গুলোতে কিংবা বিচ্ছেদের পর কবিতার সেতুবন্ধনে। দুজনেই স্মৃতির প্রকোষ্ঠে গল্প লুকিয়েছেন, ফাঁকা একটু সময় পেলে হয়তো দুজনেই সেই গল্পগুলো খুঁজে বেড়ান। আচ্ছা, ঠিক এমন কোনো মুহূর্তেই কি মোংলায় বসে রুদ্র লিখে ফেলেছিলেন, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’? কাকে ভালো থাকতে বলেছিলেন তিনি? অবশ্য এ উত্তরটা দেয়ার জন্য রুদ্র আজ নেই। হয়তোবা তসলিমা বুঝে ফেলেছিলেন আকাশ জুড়ে থাকা আজ এই রুদ্র সেদিন কাকে আকাশের ঠিকানায় চিঠি পাঠাতে বলেছিলেন। যে অনুভ‚তিটুকু সহস্র কবিতায় প্রকাশ হয়নি একে অপরের প্রতি, সে অনুভূতি মিশে আছে যেন এই দুটো লাইনে, ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ।’ ভালোবাসা আজো অমলিন দূরত্বের ব্যবধানে, এ দূরত্ব আকাশের সাথে দূরত্বের চেয়েও বেশি। এ দূরত্ব লুকিয়ে আছে শুধু দুটি হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে, রুদ্র এবং তসলিমা। তসলিমা তার শেষ চিঠি আকাশের ঠিকানাতেই লিখেছিলেন। রুদ্রর দেয়া ডাকনাম ‘সকাল’ নামটি শুনতে পান আজো কল্পনায়। এতেই প্রমাণ হয়, ঘৃণার দুই দেয়ালের কেন্দ্রবিন্দুতে দিনশেষে প্রেমই জাগ্রত ছিল তাঁদের। যতই ক্ষোভ আর অভিযোগ থাক একে অপরের বিরুদ্ধে, রুদ্রর মৃত্যুর পরে ‘রুদ্র ফিরে আসুক’ শীর্ষক লেখায় তসলিমা লিখেন ‘যৌথজীবন আমরা যাপন করতে পারিনি। কিন্তু যত দূরেই থাকি, আমরা পরস্পরের কল্যাণকামী ছিলাম। রুদ্রের সামান্য স্খলন আমি একদিনও মেনে নিইনি, রুদ্রের দুচারটে অন্যায়ের সঙ্গে আমি আপস করিনি পরে সময়ের স্রোতে ভেসে আরো জীবন চেনে, জীবন ঘেঁটে আমি দেখেছি, রুদ্র অনেকের চেয়ে অনেক বড় ছিল, বড় ছিল হৃদয়ে, বিশ্বাসে। রুদ্রের ঔদার্য, রুদ্রের প্রাণময়তা, রুদ্রের অকৃত্রিমতার সামনে যে কাউকে দাঁড় করানো যায় না।’ রুদ্রর জীবন কখনই নিয়ন্ত্রিত ছিল না। শরীরের ওপর যথেষ্ট অত্যাচার, অবহেলা করতেন। তুখোড় ধূমপান ও মদ্যপান, খাবারে অনিয়ম সব মিলিয়ে বাঁধিয়েছিলেন পাকস্থলির আলসার। পায়ের আঙুলে হয়েছিল বার্জার্স ডিজিজ। তবুও খামখেয়ালিপনা যায়নি তাঁর। অসুস্থতা নিয়েও তিনি ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যেতেন। একসময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরলে তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তখন তসলিমা নিয়মিত তাঁকে দেখতে যেতেন। বাংলার আরো অনেক প্রতিভাবান কবি ও সাহিত্যিকের মতো আমাদের এই রুদ্রও চলে যান খুব কম বয়সে। ২১ জুন, ১৯৯১ সালে অকাল প্রয়াণ ঘটে এই কবির। এই স্বল্প সময়েই তিনি বুনে গেছেন অনেক গল্প। জীবনের গল্প, বিদ্রোহের কবিতা, অমোঘ প্রেমের কবিতা, করে গেছেন ঋণী, বেঁধে গেছেন অমোঘ মায়ার জ্বালে। মৃত্যু মানেই যে হারিয়ে যাওয়া না তা তিনি নিজেই লিখে গেছেন ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় বিচ্ছেদ নয় চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে।’ রুদ্র শুধু একজন কবির নাম নয়। রুদ্র একটি গল্পের নাম, যে গল্প জীবন তাঁকে উপহার দিয়েছিল প্রতিটি বাঁকে বাঁকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App