×

সাময়িকী

রুদ্র, আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০১৯, ০৪:৪৫ পিএম

রুদ্র, আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও
রুদ্র পরপারে আর আমি পরবাসে। রুদ্র কাছের মানুষ এবং দূরের মানুষ। রুদ্রকে হারিয়েছি। হারিয়েছি রুদ্রের চিঠি, হারিয়েছি রুদ্রের সাথে ছবি। রুদ্র মারা যাবার পর অক্টোবর ১৯৯১ সালে আনওয়ার আহমদ তাঁর কিছুধ্বনি একটি বিশেষ সংখ্যা বের করে, আজ সেটিও নেই। কিন্তু রুদ্রের সাথে স্মৃতিগুলো এখনো হারিয়ে যায়নি। আহ, কত মধুর সেই হারানো দিনের কবিতা, মদাড্ডা এবং রুদ্রের প্রাণ জুড়ানো ভুবন জোড়া হাসি। আমাদের কবিতা লেখার শুরুতে আমরা ঢাকায় নানান বিষয় নিয়ে মাতামাতি করতাম, হৈচৈ করতাম। আড্ডা দিতাম। সেই আড্ডায় রুদ্র থাকলে, সে-ই হয়ে উঠতো আড্ডার মধ্যমণি। বিশেষ করে খুব মন পড়ে বাংলা একাডেমির বইমেলার কথা। ছোট কাগজ থেকে আমরা ২০ ফেব্রুয়ারি টিএসসি সড়ক দ্বীপে ১২টা ১ মিনিটে কবিতা পাঠের আসর করতাম। একবার রুদ্র মাতাল চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে মাতাল। কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারছে না। বারবার চেষ্টা পরে ভেঙে পড়ছে। এদিকে কবি ফারুক মাহমুদ ঘোষণা দিয়েছেন, এবার মঞ্চে কবিতা পড়ার জন্য আসছেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। রুদ্রের মুখস্থ করার যেমন অসাধারণ গুণ ছিল এবং তেমনি চমৎকারভাবে আবৃত্তি করে মঞ্চ মাতিয়ে রাখার ক্ষমতাও ছিল। ‘বাতাসে লাশের গন্ধ...’ পড়লে যেন আকাশের পতাকাও সেই কবিতার সাড়া দিলো। তাঁর নাম ঘোষণা করা সাথে সাথে দর্শক-শ্রোতাদের করতালি। কিন্তু হ্যাঙ্গোভারে রুদ্র দাঁড়াতে পারছে না। তখন আবার ঘোষণা দেয়া হলো যে, রুদ্র একটু অসুস্থ। তিনি পরে কবিতা পড়বেন। সেই কবিতার আসর রাত একটার দিকে শেষ হলে আমরা আর ঘরে ফিরতাম না। আহমদ আজিজ, ইসহাক খান, তুষার দাশ, মোহন রায়হান, আলমগীর রেজা চৌধুরী, ফারুক মাহমুদ, রুদ্র, আমি আমরা আরো অনেকেই (এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না) চলে যেতাম বাংলা একাডেমির ভেতর। সেখানে চলতো গান-কবিতা-আড্ডা-পানাহার। শেষ রাতে ঝিমুনি ধরলে আমরা কেউ বট গাছের নিচে, কেউ বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে, আবার কেউ কোনো বুকস্টলের ভেতরে ঘুমিয়ে পড়তাম। ভোরে উঠে বাংলা একাডেমির মূল গেটের পেছনে খুপরির ভেতর খাবারের দোকানে গরম গরম পরাটা, ডাল, ভাজি আর ঘন দুধের চা। এভাবে আবার শুরু হলো ধারাবাহিক আড্ডা। এখানে রাত্রি যাপনের কারণ হচ্ছে সকাল ৭টা থেকে বাংলা একাডেমির মঞ্চে কবিতা পাঠের আসর। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে আসা শত শত কবিতা বিকেল পর্যন্ত টানা কবিতা পড়া চলতো। রুদ্র মজা করে বলো, বাদ ফজর থেকে আগ আছর পর্যন্ত কবিতা পাঠের আসর। আমরা কবিতা পড়ে নগদ টাকায় সম্মানী গ্রহণ করে ঘরে ফিরতাম। এভাবেই আমরা তারুণের দিনগুলো পার করেছি। শুধু ঢাকাতেই নয়; আমরা কবিতা পড়ার জন্য দল ভেদে বিভিন্ন জেলায় চলে যেতাম। একবার টাঙ্গাইলে কবিতা পড়তে যাই। পুরো বাস মাতিয়ে রাখলো রুদ্র। একবার বাসের রড ধরে ক্যানভাসারের মতো কবিতার খাওজানি, কবিদের চুলকানির শ্রীপুরের তাবিজ-কবজ-মলম বিক্রি করলেন, পরে আবার দুলাল-এর সাথে মিল দিয়ে জারি গানের সুরে বলছে অই দেখা দুলাল/মুক্তি পড়ছে শাল/আমরা যাচ্ছি টাঙ্গাইল/আমরা ফিরবো কাল/দূরে দেখো ধান নদী খাল... তখন পেছন থেকে রফিক আজাদ বললেন, তোর ঝোলার সব মিল শেষ। আর একটি বাকি আছে। বাবা, আর নিচে নামিস না! টাঙ্গাইল গিয়ে রুদ্রকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। সে কার সাথে যেন জংগলে চলে গেছে আদিবাসীদের হাতে বানানো ‘চু’ খাওয়ার জন্য। খ. রুদ্র নিজেকে কবি না বলে ‘শব্দ শ্রমিক’ বলতো এবং কবিতা জন্য পারিশ্রমিক দাবি করতো। ১৯৯৭ সালে আমার সম্পাদনায় ‘প্রচ্ছদ’-এর পঞ্চম সংখ্যায় ‘প্রিয়জনে প্রোথিত পা’ কবিতাটি ছাপা হয়। সেই সময় রুদ্র মিরপুর বেড়াতে আসে কাজী রোজীর বাসায়। তখন রোজী আপা আমার প্রতিবেশী। আমাকে খবর দেয়া হয়। আমি বাসায় ছিলাম না। তখন রুদ্র সেই কবিতার সম্মানী চেয়ে একটা চিঠি লেখেন এবং একটি ভুলের জন্য বাড়তি আরো ৫ টাকা দাবি করে। আর সেই মুদ্রণ প্রমাদটা হচ্ছে রুদ্র দাঁড়ি (।) এবং কমা (,) মাঝামাঝি একটা নতুন বিরতি চালুর চেষ্টা করে। সেটা হচ্ছে ইংরেজি ফুলিস্টপ (.); যা তার একটি বইয়েও আছে। এরকম টুকরো টুকরো স্মৃতির শেষ নেই। যেমন ১৯৯১ সালের ২১ জুন সকাল বেলা রুদ্রের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি আর কাজী রোজী ছুটে যাই তাদের পশ্চিম স্থ বাসায়। গিয়ে দেখি, তসলিমা একটু অন্যরকম ভূমিকা নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। যা খালাম্মাসহ (রুদ্রের মা) মুরব্বিরা চাচ্ছিলেন না। কারণ তালাকপ্রাপ্ত সাবেক স্ত্রী হিসেবে তসলিমার আচরণ দৃষ্টিকটু মনে করছিলেন মুরব্বিরা। আমি সেই বিষয়টি তসলিমাকে অবগত করি এবং পরদিন আমরা যখন ট্রাকে করে রুদ্রের লাশ নিয়ে মোংলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, তখন তসলিমাও ট্রাকে উঠার চেষ্টা করে। কিন্তু ইসহাক খান উঠতে দেননি। আর সেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে তসলিমা লিখলেন : ‘এই দুলালই রুদ্রের ট্রাক থেকে পেছনের রিকশায় বসা আমার দিকে দলাদলা ঘৃণা ছুড়ে দিয়েছিল।’ (দ্র. সাপ্তাহিক বেঙ্গলি টাইমস, জানুয়ারি ০৭, ২০১০, কানাডা।) তাহলে আসল ঘটনাটা খুলেই বলা যাক। তসলিমা নাসরিন তাঁর বহু আলোচিত এবং বিতর্কিত গ্রন্থ ‘ক’-এ লিখেছেন : ‘রুদ্রকে নিয়ে বাণিজ্যে করার ধুম পড়েছে চারদিকে। একদিন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল নামের এক কবি আসে, আমাকে লেখা রুদ্রর চিঠিগুলো যেন তাকে দিই, ছাপবে সে। এই দুলালই রুদ্রর ট্রাক থেকে পেছনে রিকশায় বসা আমার দিকে দলাদলা ঘৃণা ছুড়ে দিয়েছিল।’ (দ্র. ক/তসলিমা নাসরিন, প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০০৩, প্রকাশক : চারদিক, ঢাকা। পৃষ্ঠা নং-১৫৯) রুদ্র ‘ভালো আছি ভালো থেকো/আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও...’র মতো জনপ্রিয় গানের রচয়িতা হওয়া সত্তে¡ও রুদ্র রেডিও-টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার ছিলেন না। তাই বিটিভির কাজী আবুজাফর সিদ্দিকী ২৫টি গান জমা দেয়ার জন্য বলেন। রুদ্র তা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘দুলাল, কবিরা গান লিখলে গানের গুণগত মান এবং ধারার পরিবর্তন হয়।’ (দ্র. রুদ্র এবং তার এলোমেলো চন্দ্রিমার চিত্র/সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল/সাপ্তাহিক ঢাকার চিঠি, ১-১৫ জুলাই ১৯৯১, ঢাকা।) আরো যৎসামান্য শানেনজুল এ রকম : ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় শিল্পী-সুরকার-গীতিকারেরা মিলে ‘বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদ’-এর পক্ষ থেকে ত্রাণ সাহায্য সংগ্রহ করার কর্মসূচি হাতে নেয়। সেই সঙ্গীত পরিষদের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত সঙ্গীত পরিচালক সমর দাস এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান। ১৯৯১-৯৩-এর কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রকাশনা সচিব হন রুদ্র। তাঁর ওপর দায়িত্ব পড়ে ‘মানুষের জন্য মানুষ’ শীর্ষক স্মরণিকা সম্পদনার। (তথ্যসূত্র : রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ/তপন বাগচী, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি, প্রকাশকাল : জুন ১৯৯৮, ঢাকা/পৃষ্ঠা নং-৩৫) এবং আমিও ছিলাম সহযোগী প্রকাশনা সচিব। তখন তাঁর ২৫টি গান আমার হাতে একটা ফটোকপি জমা দেয়। এদিকে রুদ্র মারা গেলে বিদ্যাপ্রকাশ তাঁর সমগ্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। সম্পাদনার দায়িত্ব নেন অসীম সাহা আর প্রুফ দেখার দায়িত্ব ছিল তসলিমার। তখন তসলিমা নাসরিন আমার কাছে সেই গানগুলো চায়, সেই সমগ্রে দেয়ার জন্য। এদিকে আমি ‘প্রয়াত লেখকদের অপ্রকাশিত চিঠিপত্র’ নিয়ে একটি গ্রন্থ সম্পাদনার কাজে হাত দিয়েছি। তার জন্য রুদ্রের একটি চিঠির ফটোকপি চাই তসলিমার কাছে। রুদ্রের লেখা চিঠি তো আমার কাছেও আছে, কিন্তু রুদ্র-তসলিমার চিঠি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। তসলিমা তখন মালিবাগের একটি বাসায় ভাড়া থাকে। আমার অফিস তখন খিলগাঁওয়ের আনসার হেড কোয়ার্টারে। একদিন অফিসে যাবার পথে তসলিমাকে রুদ্রের গানের পাণ্ডুলিপি দেই। কিন্তু তিনি কথা দিয়েও তাঁর কাছে লেখা রুদ্রের চিঠি দেননি। অথচ ঠিকই তাচ্ছিল্যতার সাথে মিথ্যাচার করেছেন! গ. শিখা প্রকাশনী শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এবং সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এই চার কবিরা ‘প্রেম-বিরহের কবিতা’র বক্স বের করে। নাজিব তারিকের মন জুড়ানো প্রচ্ছদে টুকটকে লাল কভারে বইটি শেষ হওয়ার পর জাগৃতি নাম পাল্টিয়ে ‘চার কবির প্রেমের কবিতা’ দুবার দুটি সংস্করণ করে। সেই গ্রন্থের ফ্ল্যাপে আছে : ‘এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন!/বুঝি না আমার রক্তে কি আছে নেশা...’ এভাবে সহজ-সরল উক্তিতে স্বীকার করেছেন ভালোবাসার নেশার কথা। আর সেই নেশা আর ঘোর থেকে সৃষ্টি করেছেন প্রেম ও দ্রোহের কবিতা, স্বপ্ন ও সংগ্রামের কবিতা। জীবনের বিকর্ষণ, বিরহ, বেদনা, বিচ্ছেদও তিনি নিপুণভাবে উপস্থাপন করেন তাঁদের কবিতায়, তাঁর গানে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বিদায় নেয়া তারুণ্যের প্রতীক, এই হচ্ছেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। কানাডায় তথা টরন্টোতে এসেও পেয়ে যাই রুদ্রকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মতিথিতে নানান কর্মসূচি পালিত হয়। টরন্টোর প্রাচীন থিয়েটার প্রতিষ্ঠান ‘প্লিইয়াডিস থিয়েটার’ ৭ মে থেকে ৪ জুন ২০১১ পর্যন্ত রবি ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ গল্প অবলম্বনে জুরি মেহতার অনূদিত ইংরেজি নাট্যরূপ ‘দ্য পোস্ট অফিস’ মঞ্চস্থ করছে। জন ভ্যানবুরেকের পরিচালিত এতে যারা অভিনয় করছেন তারা হলেন কানাডিয়ান শিল্পী প্যাট্রিসিয়া মার্সিইউ, মিনা জেমস, জেনিফার ভিলাভারডি, স্যাম মোসেস, এরল সিথাল, সুগিথ ভারোগিস এবং ডিলন স্কট স্মিথ। উল্লেখ্য, সঞ্জত পরিচালক দেবাশীষ সিনহা এ নাটকে ইংরেজি ভাষান্তরে যুক্ত করেছেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জনপ্রিয় সেই গানটি ‘ভালো আছি ভালো থেকো/আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও’। (দ্র. কানাডায় যাবেন কেন যাবেন/ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। প্রকাশক দি রয়েল পাবলিশার্স, বইমেলা ২০১২, ঢাকা। পৃ./৩৫) প্রিয় রুদ্র, তুমি আছো পরবাসে। আমি আছি পরদেশে। আমাকে আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও, বন্ধু।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App