×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতি আছে, রাজনীতি নেই...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০১৯, ০৮:১৬ পিএম

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, প্যারোলে মুক্তি ইত্যাদি প্রশ্নেও বিএনপিতে রয়েছে মতভিন্নতা। ড. কামাল হোসেনকে নিয়েও বিএনপিতে আছে অস্বস্তি। বিএনপির ভেতরের অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ আছে রাজনীতিতেও। তারা আন্দোলনের কথা বলেও কোনো কর্মসূচি ঠিক করতে পারে না। নেতাদের মধ্যেও চিন্তাভাবনার ঐক্য নেই। কেউ তারেককে বাদ দিয়ে চলতে চান, কিন্তু বলতে পারেন না। আবার কেউ মনে করেন তারেক ছাড়া গতি নেই। এই টানাটানির পরিণতি হলো গতিহীন বিএনপি।

রাজনীতি নিয়ে মানুষ ক্রমেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতিতে গতিশীলতা আসার পরিবর্তে স্থবিরতা বেড়েছে। নির্বাচনের অস্বাভাবিক ফলাফল রাজনীতিকে একটি অস্বাভাবিক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। দেশের বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই কারণে স্বস্তিতে নেই। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিপুল বিজয় পেয়েও স্বস্তিতে নেই। কারণ শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না। টানা ক্ষমতায় থাকলে দলের মধ্যেও নানা ‘ভাইরাস’ সংক্রমিত হয়। পাওয়া-না পাওয়ার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। দলের নীতি-আদর্শ থেকে ক্ষমতার দাপট, প্রভাব, অর্থবিত্ত ইত্যাদি বিষয় প্রধান হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে দলকে নিয়ে সমস্যায় পড়বে বেশি মাত্রায়।

আওয়ামী লীগের দলীয় ঐক্য ও সংহতির অভাব নতুন কিছু নয়। এটা একটা পুরনো চালু কথা যে, আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ। এটা নানা সময়, নানাভাবে দেখা গেছে। এখন এটা আরো বেশি সত্য। দল ক্ষমতায় থাকলে সরকার এবং দলের অস্তিত্ব আলাদা রাখা একটি কঠিন পরীক্ষা। দল যদি সরকারের চালিকাশক্তি না হয়ে উল্টো সরকার দলের চালিকাশক্তি হয় তাহলে সমস্যা বাড়ে। দলের মূল নেতৃত্ব সরকারে থাকলে যে ভালো হয় না, সেটা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করে নিজে দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ এইচ এম কামারুজ্জামান মন্ত্রিত্ব বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

তারও আগে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগে এই ভারসাম্য নেই। আওয়ামী লীগে এবং সরকারে এখন শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। শেখ হাসিনাকে দল এবং সরকার একসঙ্গেই চালাতে হবে। তবে দলের সাধারণ সম্পাদককে অন্তত মন্ত্রিসভা থেকে বাইরে রাখা উচিত। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় এবং আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটি দল একজনের পক্ষে সামাল দেয়া সহজ কাজ নয়। এটা বুঝে যদি পদক্ষেপ নেয়া হয় তাহলে সমস্যা কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু তেমন লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। আগামী কাউন্সিলে যদি কোনো পরিবর্তন ঘটে!

একতরফা উপজেলা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারেনি। নৌকা প্রতীকের দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত হতে হয়েছে দলেরই বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে। বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের ‘খবর’ ছিল বলে অনেকেই মনে করেন।

আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে হবে। অভ্যন্তরীণ সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে না পারলে রাজনীতিতে বড় ধরনের ঝড় উঠলে সামাল দেয়া কঠিন হবে। একটি রাজনৈতিক সরকার প্রশাসন বা আমলানির্ভর হয়ে পড়লে সে সরকারের পদে পদে ভুল করার আশঙ্কা থাকে। রাজনীতিতে আপাতত কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস না থাকলেও সব সময় এমন স্থবির অবস্থা থাকবে বলেও মনে করার কোনো কারণ নেই।

আওয়ামী লীগকে এটা মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতিতে তাদের মিত্র কম, শত্রু বেশি। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে মোটা দাগে রাজনৈতিক দল দুটি, আওয়ামী লীগ এবং এন্টি-আওয়ামী লীগ। যাদের এখন আওয়ামী লীগের মিত্র তালিকায় দেখা যাচ্ছে বা রাখা হয়েছে তারা চরম বিপদের সময় পক্ষ বদল করবে না, সেটাও জোর দিয়ে বলা যায় না। কাজেই নিজের দলকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ-পরিকল্পনা এখনই নিতে হবে। মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ এনে চমক দেখানো হয়েছে। সময় চলে যাচ্ছে। নতুন মন্ত্রীরা কাজে-কর্মে এখনো কোনো চমক দেখাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। হানিমুন পিরিয়ড খুব লম্বা হলে মানুষ মানবে না।

মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়া সিনিয়র নেতাদের কর্মহীন রাখাও হয়তো ভালো হবে না। তাদের দল গোছানোর কাজে লাগানো হলে খারাপ হতো না। তারা কতটা বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করেন, তার নীতি-আদর্শের কতটা প্রকৃত অনুসারী তার একটি পরীক্ষা এখন নেয়া যেতে পারে। দশ-পনেরো বছর মন্ত্রিত্ব করে এখন দলকে যারা উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করবেন তারা কতটুকু দলপ্রেমিক তা সহজেই বোঝা যাবে।

দেশের আরেকটি বড় দল বিএনপি গত নির্বাচনে একেবারেই ছোট দলে পরিণত হয়েছে। বলা হচ্ছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ফলাফল অন্য রকম হতো। কিন্তু এটা একেবাবেই কল্পগল্প। মানুষ শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। আওয়ামী লীগের ব্যাপারে কিছু বিরূপতা থাকলেও ক্ষমতা থেকে হঠানোর চিন্তা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল না। থাকলে মানুষ সব কিছু মেনে নিত না, নীরব থাকত না। বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার কোনো মরিয়া চেষ্টা কারো মধ্যে ছিল না। এমন কি বিএনপিও নির্বাচন করেছে দায়সারাভাবে।

এবারের জয় তাদের নয়- এটা বুঝেই বিএনপি নির্বাচনে গেছে। সরকারের বাধা, মামলা-গ্রেপ্তার ইত্যাদি কোনো জনপ্রিয় দলকে দমাতে পারে না। বিএনপিকে স্বীকার করতে হবে, তারা অতীতে রাজনীতিতে যে ভুল করেছিল তার খেসারতই এখন তাদের দিতে হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা বিএনপির একটি বড় ব্যর্থতা। বিএনপি সময় থেকে পিছিয়ে থেকে রাজনীতি করে। তাদের রাজনীতি অতীতাশ্রয়ী। ভারতবিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং আওয়ামী লীগ বিরোধিতা- এই বস্তাপচা কৌশল বিএনপি ত্যাগ করতে না পারায় তারা নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করতে পারছে না। বিএনপি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারে না, মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে না। বিএনপির রাজনীতি হলো ‘যদি লাইগা যায়’র মতো। বিএনপিকে এখন দলীয় রাজনীতিতে পরিবর্তনের কথা ভাবতে হবে। দলের নেতৃত্বেও আনতে হবে পরিবর্তন। জিয়া পরিবার আর বিএনপিকে সুফল দিতে পারবে কিনা সেটা নির্মোহভাবে ভাবতে হবে। খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে। তিনি অসুস্থ। তিনি জেলে। তার পক্ষে আর বিএনপিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া কতটুকু সম্ভব, সেটা ভাবনার বিষয়। তিনি এখন বড়জোর বিএনপির পরামর্শক হতে পারেন।

অন্যদিকে বিএনপি যাকে তাদের ‘ভবিষ্যৎ কা-ারি’ মনে করে সেই তারেক রহমানের দেশে ফিরে দলের দায়িত্ব নেয়ার সম্ভাবনাও কম। কারণ তিনি দণ্ডিত, পলাতক। তার ব্যাপারে দেশ-বিদেশে অনেকের মধ্যেই আছে নেতিবাচক ধারণা। বিএনপির ভেতরেও চলছে নানা ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। অস্থিরতা। দলের ছয়জন সংসদ সদস্যের শপথগ্রহণ ও সংসদে যাওয়া না-যাওয়ার প্রশ্নে বিএনপির ভেতর তৈরি হওয়া সংকট নতুন মাত্রা পেয়েছে। তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তে সংসদে কয়েকজনের যাওয়া এবং দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ব্যাপারে ভিন্ন সিদ্ধান্তে নীতিনির্ধারকদের ভেতর ঝামেলা বাড়িয়েছে। দলের সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির সভায় বাকবিত-ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। তারপর স্থায়ী কমিটিতে দুজনকে (সেলিমা রহমান ও ইকবাল মাহমুদ টুকু) নতুন অন্তর্ভুক্ত করাকেও সবাই স্বাভাবিকভাবে নেবে কিনা সেটাও দেখার বিষয়।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, প্যারোলে মুক্তি ইত্যাদি প্রশ্নেও বিএনপিতে রয়েছে মতভিন্নতা। ড. কামাল হোসেনকে নিয়েও বিএনপিতে আছে অস্বস্তি। বিএনপির ভেতরের অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ আছে রাজনীতিতেও। তারা আন্দোলনের কথা বলেও কোনো কর্মসূচি ঠিক করতে পারে না। নেতাদের মধ্যেও চিন্তাভাবনার ঐক্য নেই। কেউ তারেককে বাদ দিয়ে চলতে চান, কিন্তু বলতে পারেন না। আবার কেউ মনে করেন তারেক ছাড়া গতি নেই। এই টানাটানির পরিণতি হলো গতিহীন বিএনপি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামীতে নিয়ামক হয়ে উঠবে ‘হঠাৎ’ ইস্যু। আকস্মিকভাবে এমন কিছু ঘটে যাবে, যা রাজনীতিতে বড় ধাক্কা দেবে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পরিকল্পনা মতো রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণের অবস্থা ও অবস্থানে এখন নেই। তবে মানুষ অশান্তি ও অস্থিরতার বিরুদ্ধে। মানুষের এই মনোভাব বুঝেই রাজনৈতিক দলগুলোকে অগ্রসর হতে হবে।

বিভুরঞ্জন সরকার: যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App