×

সাময়িকী

বাংলা গদ্যের এক উৎকৃষ্ট শিল্পী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০১৯, ০৪:০১ পিএম

বাংলা গদ্যের এক উৎকৃষ্ট শিল্পী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা গদ্যের এক উৎকৃষ্ট শিল্পী। গদ্য রচয়িতা হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল পঞ্চাশের দশকে। সেই থেকে তিনি অনবরত লিখে চলেছেন। এতটা সময় তাঁর কলম সক্রিয় থেকেছে এবং থাকবেও আরো বহু দিন। দেশ-বিদেশের সাহিত্যের অনুপম ব্যাখ্যাতা ও বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতির উঁচুমানের বিশ্লেষক হিসেবে তিনি উল্লেখযোগ্যতার দাবিদার হয়েছেন বহুদিন আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের উত্তম ছাত্র (এম এ পাস ১৯৫৬) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছাত্রত্ব ঘোচানোর পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষক হন এবং দীর্ঘ চল্লিশ বছর নিরবচ্ছিন্ন নিয়মিত শিক্ষকতা শেষে অবসর গ্রহণ করেন (১৯৯৬)। কিন্তু পরপরই ইংরেজি বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে এবং ২০০৭ সালে ইমেরিটাস প্রফেসর রূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ও শিক্ষা জীবনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা পুরো ষাট বছরের। এই ছয় দশকে তাঁর শিক্ষকতার, গবেষণার, লেখালেখির, সম্পাদনার, বিদ্যাচর্চার নানাবিধ আয়োজনের এত সাফল্য অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না। স্কুল জীবন থেকেই তিনি লেখায় অনুরাগী হন। দেওয়ালপত্র লেখার মধ্য দিয়ে বড় লেখার সূচনা হয় তাঁর লেখার জীবনের শুরুতে। গল্প, রম্য রচনা, আলোচনা ইত্যাদি লিখতে লিখতে তিনি বড় প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ হিসেবে এবং উত্তম গদ্য লিখিয়ে রূপে বিকশিত হন। বাংলাদেশের চিন্তার জগতে তিনি এক দাপুটে ও প্রভাবশালী লেখক এবং এ মুহূর্তে তাঁর চেয়ে বড় গদ্যলেখক কেউ নেই। পত্রপত্রিকা সম্পাদনার কাজ তাঁর অনুরাগের প্রকাশ। ছাত্র জীবনেই শুরু করেছিলেন সে কাজ। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার তালিকা হবে দীর্ঘ এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লেখক সংঘের ‘পরিক্রম’, মুক্তধারার ‘সাহিত্যপত্র’, নিজের প্রকাশনা থেকে নতুন দিগন্ত এবং ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা’। দীর্ঘ ষোলো বছর তিনি অতি সুনামের সঙ্গে এই গবেষণা পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগে ইংরেজি জার্নাল বের করত। ইংরেজির সঙ্গে বাংলা পত্রিকা তাঁরই উদ্ভাবনা। এক সময় ইংরেজি-বাংলা উভয় গবেষণা পত্রিকা তিনিই সম্পাদনা করেছেন। পত্রপত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এক সুদক্ষ বনাম লিখিয়ে হিসেবে বিকশিত হন। কলাম তাঁকে শিল্পময় গদ্য রচনার স্থান করে দেয়। যৌবনে লিখেছেন ‘পুশনী’ পত্রিকায় ঢাকায় থাকি নামের সুরম্য কলাম। ‘পরিক্রম’ পত্রিকায়ও তিনি কলাম লিখেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘উপর কাঠামোর ভেতরেই’। সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পান দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ‘সময় বহিয়া যায়’ কলামের জন্য সব কলামেই দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সম্পদ, রাজনীতি, অর্থনীতি, নাগরিক জীবনে জনদুর্ভোগ, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, বিশেষ করে সামাজিক শ্রেণি বৈষম্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। শেষেরটিই বেশি করে এসেছে তাঁর কলাম লিখনে। তাঁর সব কলামের লেখা সাহিত্যগুণ ও সমাজ চিত্রবীক্ষণের জন্য জনপ্রিয় হয়েছে এবং পরে গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। কিন্তু কলামের জন্য তিনি দেশের সুপরিচিত ও সুখ্যাত হয়েছেন তা নয়, তিনি প্রণয়ন করেছেন অজস্র গ্রন্থ বেশির ভাগই প্রবন্ধের সংকলন। নানা বিষয়ের প্রবন্ধ, যেগুলো গুণেমানে আকর্ষণীয় ও চিন্তা উদ্রেককারী। তাঁর গদ্য ভঙ্গিও অনুপম। চিন্তাকে শিল্পমণ্ডিত করে স্বাদ গদ্যের নির্মাণ তিনি পূর্ণ লেখক। এ প্রসঙ্গে তাঁর গদ্য রীতির কথা বলতে হয়। ইংরেজি পড়ার সুবাদে তিনি বাংলা গদ্যকে অধিক রীতিবৈশিষ্ট্য পূর্ণ করার ক্ষমতা অর্জন করেন। তাঁর ইংরেজি সাহিত্য পড়ারও প্রণোদনা বাংলা চর্চা করার জন্য। এতে যে তাঁর দীর্ঘ সাধনা সফল হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেবল ছোট প্রবন্ধে নয় দেশকাল মিলিয়ে বিশাল পরিসরের সমাজ-প্রেক্ষাপট আলোচনায়ও তাঁর নৈপুণ্য সুবিদিত। এক কথায় তিনি দেশের বড় লেখক, বড় চিন্তাবিদ, ঘোর বিরোধী তিনি। তিনি চান ব্যবস্থা এমন হোক, যাতে দেশের মানুষের উঁচু-নিচ ভেদাভেদ ঘুচে যাবে। এতেই সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষ আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত হবে, অর্থাৎ মানবিক মর্যাদায় সবাই সমশ্রেণিভুক্ত হবে। এই কথাটি গুরুত্ব দিয়ে তিনি তাঁর সব বইতে বলেছেন। ‘অন্বেষণ’ থেকে শুরু করে এ যাবৎকাল তিনি যে কয়েক ডজন বই লিখেছেন সেগুলো তাঁকে দেশ ও মানুষের মঙ্গলকামী মানুষ রূপে চিরজীবী রাখবে। ৮৩ বছরের পূর্ণ জীবনে তাঁর প্রতি অভিবাদন। দুই. লেখক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন। বাকস্বাধীনতা, মানবিক অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্দোলনের পুরোধা তিনি। দীর্ঘকাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য যাঁদের নিরলস অবদানে সমৃদ্ধ তিনি তাঁদের অন্যতম। তিনি মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ, প্রগতিশীল ও মুক্তমনা। নতুন দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ১৯৮০-এর দশকে ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সাপ্তাহিক প্রতিবেদন লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্মস্থান শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈইখালী গ্রামে। তাঁর বাবার নাম হাফিজ উদ্দিন চৌধুরী ও মা আসিয়া খাতুন। বাবার সরকারি চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব কেটেছে রাজশাহীতে ও কলকাতায়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার সেন্টগ্রেগরি স্কুল, নটরডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা করেছেন যুক্তরাজ্যের লিডস এবং লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৫৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কর্তৃক দুবার উপাচার্য হওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। সম্পাদনা করেছেন ‘পরিক্রমা’, ‘সাহিত্যপত্র’, ‘সচিত্র সময়’, ‘সাপ্তাহিক সময়’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা’, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টাডিজ’ প্রভৃতি। এখনো তাঁর সম্পাদনায় গত ১৭ বছর যাবৎ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ত্রৈমাসিক সাহিত্য সংস্কৃতির পত্রিকা নতুন দিগন্ত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অন্বেষণ, দ্বিতীয় ভুবন, নিরাশ্রয় গৃহী, আরণ্যক দৃশ্যাবলি, অনতিক্রান্ত বৃত্ত, প্রতিক্রিয়াশীলতা, আধুনিক ইংরেজি সাহিত্য, শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ, আমার পিতার মুখ, বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক, কুমুর বন্ধন, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ, বাঙালি কাকে বলি, টলস্টয় অনেক প্রসঙ্গের কয়েকটি, গণতন্ত্রের পক্ষ-বিপক্ষ, দ্বিজাতিতত্তে¡র সত্য-মিথ্যা, লেনিন কেন জরুরি, দুই বাঙালির লাহোর যাত্রা, বাঙালির জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি। ছোটগল্প গ্রন্থ : ভালো মানুষের জগৎ ও দরজাটা খোলো। উপন্যাস লিখেছেন তিনটি। অনুবাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত¡, ইবসেনের বুনো হাঁস, হাউসম্যানের কাব্যের স্বভাব, হোমারের ওডেসি। এ ছাড়া সম্পাদনা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আনোয়ার পাশা রচনাবলি (তিন খণ্ড), Dhaka University Convocation Speeches (দুই খণ্ড)। তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লেখক সংঘ পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আবদুর রহমান চৌধুরী পদক, প্রথম আলো কর্তৃক শ্রেষ্ঠ বইয়ের পুরস্কার লেখিকা সংঘ পদক, একুশে পদক ইত্যাদি। ২৩ জুন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৩তম জন্মদিন। জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App