×

সাময়িকী

পিপাসার্ত পাখি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০১৯, ০৩:৩২ পিএম

পিপাসার্ত পাখি
গ্রীষ্মের এক দুপুরে, খাঁ খাঁ রোদ্দুরের দাবদাহে আমার ছয় তলা বাসার রান্নাঘরে রান্না করছি আমি আর খনিজরূপ রাশি রাশি ঘর্মবিন্দু আমার শরীরের লোমক‚প ভেদ করে বিনা ক্লেশে প্রবাহিত হচ্ছে চুলের গোড়া থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি। প্রচণ্ড গরমে পাগলপ্রায় আমি। প্রাকৃতিক গ্যাসে পরিপূর্ণ এই সোনার বাংলায় বহুদিন যাবৎ অনিয়মিত গ্যাস সাপ্লাইয়ের কারণে আমাকে এই ভর দুপুরেই রান্নার কাজটি সেরে ফেলতে হচ্ছে। তা না হলে গ্যাসের জন্য বসে থাকতে হবে সেই রাত দুপুর অবধি। কোন সকালে গ্যাস চলে যায় তার খবরও মেলে না ঘুম থেকে উঠে! ছোট দুটো বাচ্চা রয়েছে আমার, তাদের তো আর না খাইয়ে রাখা সম্ভব নয়! তাই শরীরের নোনাজলের বিনিময়ে খাদ্য তৈরি করছি গা জ্বলা এ বেলায় এসে। এ ছাড়া, আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণও রয়েছে আজকে। বাসায় শ্বশুর, শাশুড়ি আসার কথা আছে। তাদেরও তো ঠিকঠাক যতœআত্তি করতে হবে! কোনো কষ্টের কথা মাথায় না রেখে পাঁচপদ রান্নার আয়োজন জুড়ে বসেছি। ছেলের বউরা তো আর নিজের মেয়ে নয় যে, দোষ ধরবে না কেউ! শতভাগ দায়িত্ব পালনের পরও কখনো কখনো কারো কপালে বিনা দোষেও কলঙ্ক জোটে যায়! সংসারে সবাইতো আর সৌভাগ্যবতী হয় না! এসব হাজারো ভাবনার মাঝে উনুনে ভাতচাপা হাঁড়িতে অদ্ভুত ছন্দে ভাতের বলক ফুটতে আরম্ভ করে দিয়েছে। একটি আশ্চর্য সুন্দর ঘ্রাণ বেরুচ্ছে ভাতের ভেতর থেকে। এ ঘ্রাণটা শুধু রান্না করার সময়ই মেলে। টগবগ টগবগ করে ভাতটা ফুটছে। এরই মধ্যে আমি একটু স্বস্তির জন্য জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হায়, একটুও বাতাসের ছোঁয়া নেই কোথাও! টিভির আবহাওয়া সংবাদে দেখালো সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে আজ। গায়ে ফোসকা পড়ছে মনে হচ্ছে! পাশের ছাদবাগানের তরতাজা পেয়ারা গাছটির চকচকে সবুজ পাতাগুলো বুড়ো মানুষের ঝুলে যাওয়া চামড়ার মতো কুঁচকে গেছে খুব স্বল্প সময়ে। অগণিত ছোট-বড় পেয়ারা ঝুলছে গাছটির নির্জীব ডালপালা জুড়ে। মুহূর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল চোখের সামনে গাছটির অকাল মৃত্যু দেখে। আমি আবারো ভাবনার জগতে হারাতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় দুটো শালিক পাখি উড়ে এসে বসলো মরা গাছটির শাখায়। উড়ে এলো আরো কয়েকটি শালিক, চড়ুই ও পায়রা। ওদের সবারই মুখ হাঁ করা। প্রখর এই রোদে ওরা পিপাসায় ছটফট করে চলেছে। এক যুবকের শখের মাছের এ্যাকুরিয়ামে জাবর কাটছে কয়েকটি সোনালি মাছ। খোলা ছাদের নিচে রাখা এ্যাকুরিয়ামের জলও নিশ্চয়ই ফুটছে তপ্ত উন্মাদনায়, ভাবতেই মাছগুলোর জন্য কষ্টে আমার বুকের ভেতরটা খাসিক কেঁপে যায়। কয়েকটি এ্যাকুরিয়ামের মধ্যে দক্ষিণ দিকের এ্যাকুরিয়ামটির উপরে ছাউনি নেই, সম্পূর্ণই উদোম সেটি। পেয়ারা গাছটির সাথেই লাগা। একটি শালিক তার গলা নিচু করে হলুদ ঠোঁটে এককণা জল ছোঁয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে বারবার। পাশেই বসে আছে তার সঙ্গীটি। সেও ক্লান্ত, অবসন্ন জলপিপাসায়! হঠাৎ আমার এগারো বছরের মেয়ে আঁচল এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। জানালার গ্রিল ধরে আমি মগ্ন দৃৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি পাশের ছাদে। আঁচল আমার গা ঘেঁষতে ঘেঁষতে বললো, - ‘ও মা, পাখিগুলো অমন হাঁ করে আছে কেন? ওরা এমন ছটফট করছে কেন? ওরা কি চায়?’ মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, - ‘ওরা জলপিপাসায় কাতরাচ্ছে, মা। প্রচণ্ড তাপদাহে মানুষের মতো ওদের জীবনও আজ ওষ্ঠাগত। মানুষের পিপাসা পেলে নিজেরা জল ঢেলে খেয়ে নেয়, আর পাখিরা তা পারে না। ওরা কোথাও জলের দেখা পেলে পান করে নেয়, ইচ্ছেমতো যা খুশি তা করতে পারে না, মা! গ্রীষ্মের এই প্রচণ্ড গরমে ওরা হয়তো কোথাও জল না পেয়ে এখানে ছুটে এসেছে। দেখছো না একটি শালিক পাখি একফোঁটা জলের জন্য বারবার এ্যাকুরিয়ামে ঝাঁপ দিতে চাচ্ছে!’ উনুনে চড়ানো ভাত নামিয়ে কড়াইতে কয়েক টুকরো ইলিশ মাছ ছেড়ে দিলাম মচমচে ভাজি করার জন্য। সঙ্গে গোটাকয়েক শুকনো মরিচ। ছোট মেয়ে অন্বেষার ভীষণ পছন্দ এই ইলিশ ভাজা। মাছ ভাজছি আর পাখিদের কথা ভেবে চলেছি নিমগ্নতায়। ওরা কি এভাবে পানীয় জলের অভাবে মরে যাবে! আমি প্রতিদিনই আমার বাসার জানালার ধারে, বারান্দার চতুর্পাশের্^ বাটিতে জল দিয়ে রাখি। কিন্তু পাখিগুলো এদিকপানে আসছে না, ওরা ঐ ছাদেই জলের চেষ্টা করে যাচ্ছে। মনে মনে ডাকছি, বাবা তোরা একটু এ দিকটায় আয় না! তোদের জন্য জল, চাল, ডাল সব যে রেখে দিয়েছে আমার ছোট্ট সোনা মেয়েটি! আমার মেয়েটির মায়ভরা প্রাণ। ব্যর্থ আমি, পাখিরা আমার হৃদয়ের ডাক শুনতে পায় না। মাছ ভাজা প্রায় শেষ হয়ে এলো। সূর্যের তেজ আরো তেড়ে উঠেছে যেন! খণ্ড খণ্ড তেজালো রোদ গলে গলে পড়ছে সূর্যের গা থেকে। পৃথিবীপৃষ্ঠকে অন্য আরেকটি ক্ষুদ্র মৃদু সৌরজগৎ মনে হচ্ছে এখন। চুলায় ডাল চড়িয়ে দিলাম। আম দিয়ে টকডাল, গরমে বেশ উপাদেয় ব্যঞ্জন। মাছ তরকারি, সবজি, শাক রাঁধা শেষ করেছি। ডালটা হলেই আজকের মত মুক্তি। ভেবে খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। - ‘মা, পাখিটা জলের ভেতর পড়ে গেছে, ওমা তুমি কই? মা, মাগো, দেখো না পাখিটা...!’ আঁচল আচমকা চিৎকার করে আমায় ডাকছে কেন! বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। ছুটে গেলাম জানালার কাছে। দেখি মেয়ের চোখে জল! অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ওর ঠোঁটভাঙা অবয়বখানা বুকে জড়িয়ে বললাম, - ‘আঁচল, কি হয়েছে মা? তুমি কাঁদছো কেন, কি হয়েছে, বলো আমায়?’ কিছুই যেন বলতে পারে না আমার অবুঝ মেয়েটি, ঝরঝর করে অঝোর ধারায় দুচোখে তার অশ্রুর বন্যা বয়ে যায়। আমার প্রশ্নের জবাবে শুধু বাম হাতের তর্জনীতে দখিনের এ্যাকুরিয়ামটি দেখিয়ে দেয়। আহা হা হা, সত্যিই কি সকরুণ দৃশ্য! যে পাখিটি পিপাসায় একফোঁটা জলের আশায় বারবার এ্যাকুরিয়ামের জল ছুঁতে চেয়েছিল, সেই শালিক পাখিটি পড়ে গেছে পুরো জলের ভেতরেই! এখন হাজারো চেষ্টায় সে উপরে উঠতে পারছে না। শুধু পাখা ঝাঁপটে দাপাদাপি করে চলেছে এ্যাকুরিয়ামের ভেতর। ডুব সাঁতারে পাখিটির সে কি বেহাল অবস্থা! সঙ্গী পাখিটি এ্যাকুরিয়ামের কাচের কার্নিশে বসে কিচিরমিচিরে আর্তনাদ করে চলেছে বারংবার। শালিকটির দুরবস্থায় কোথা থেকে উড়ে এসেছে আরো কিছু পাখপাখালি, এ যেন পাখিদের শোকসভা! ওরা ওদের ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে, কিন্তু পাখিটির জন্য করতে পারছে না কিছুই। স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের বাইরে দিয়ে ভেতরের সবকিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। পাখিটি ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে হাঁপিয়ে উঠেছে। একবার ডুবছে তো আরেকবার ভাসছে! হাবুডুবু খেতে খেতে হয়তো বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। আমার মেয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, - ‘পাখিটিকে বাঁচাও মা, ও মরে যাচ্ছে, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা! প্লিজ ওকে বাঁচাও!’ আঁচল জানে না কতটা কষ্ট হচ্ছে আমারও! পাখিটির এমতাবস্থায় আমার কেবলই দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের সামনে বাঁচতে চাওয়া এক প্রাণের আকুতি দেখেও কিছু করতে পারছি না, এ আমার কতবড় ব্যর্থতা তা কেমন করে বুঝাই মেয়েকে! - ‘মা, কিছু কর, ওকে বাঁচাও, নইলে আমি মরে যাবো, মা!’ হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়লো আমার মেয়েটি। পাখিটি এখনো বাঁচার প্রত্যাশায় ছটফট করে চলেছে। ক্ষণে ক্ষণেই পাখনা ঝাঁপটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এ্যাকুরিয়ামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। চোখের সামনে এ করুণ দৃশ্য আমি আর দেখতে পারছি না। এক ঝটকায় মেয়েকে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম পাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে গিয়ে বারকয়েক হোঁচটও খেলাম। কিন্তু আমি বেপোরোয়া গতিতে ছুটেই চলেছি। পাখিটিকে বাঁচাতে হবে। হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছলাম পাশের বাড়ির প্রধান ফটকে। দারোয়ান কিছুতেই আমাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিতে চাইলো না। আমি অনুনয় বিনয় করে কোনোরকমে তাকে ম্যানেজ করে গেলাম বাড়িটির তিনতলায় বাড়ির মালিকের ঘরের দরজায়। বেল বাজাতেই সুন্দর চেহারার বয়োজ্যেষ্ঠ এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন। বললেন, -‘কি চাই? কাকে চাই?’ আমি বললাম, -‘কাউকে নয়, চাবি চাই; আপনাদের ছাদের চাবিটি দিন প্লিজ, একটি পাখি...’ আমার কথা শেষ না হতেই ভদ্রলোক ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে। বললো, -‘চাবি দেব মানে? চেনা নাই, জানা নাই, চাবি চাইতে এসেছে; এ কোন ধান্দাবাজ রে বাবা! হারামজাদা দারোয়ান বেটা আজকাল যাকে তাকে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে দেখছি!’ -‘প্লিজ আমায় ভুল বুঝবেন না, আংকেল। আমি ২/১ নম্বর বাড়ির ছয় তলায় থাকি। আপনাদের ছাদের খোলা এ্যাকুরিয়ামের ভেতর একটি শালিক পাখি পড়ে গেছে, ওকে বাঁচাতে হবে, পাখিটি মরে যাচ্ছে আংকেল! আমি সে জন্যই এসেছি। পাখিটির এ অবস্থা দেখে আমার ছোট্ট মেয়েটি কাঁদছে। আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি। দয়া করে চলুন, আসুন পাখিটিকে ঊদ্ধার করি!’ লোকটি আমার কথা শুনে একরাশ ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসলো। হয়তো আমার কথা তার বিশ্বাসই হয়নি! -‘শোন মেয়ে, আজকাল পাশের ঘরে মানুষ মানুষকে মেরে ফেলে যায় তাতেই কারো কোনো মাথাব্যথা হয় না, আর তুমি এসেছো শালিকের খবর নিয়ে? এ যে বড় হাস্যকর! যাও যাও, বাসায় যাও, এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করো না। চাবি দেয়া যাবে না, যাও চলে যাও।’ কঠোর মনের প্রবীণ লোকটি আমার কোনো কথায় গললেন না। আমাকে একপ্রকার তাড়িয়েই দিলেন! আমি পারলাম না, আমি ব্যর্থ হলাম! ভাবতেই এক মুহূর্তে আমার কন্যার সকরুণ মুখটি চোখের মাঝে ভেসে উঠলো। কি জবাব দেবো ওকে আমি? ওর কচি হৃদয় কি মানতে পারবে এই অস্বাভাবিক একটি মৃত্যুকে? পাখিটিইবা কেমন আছে এখন? বেঁচে আছে তো? নাকি...? এমন অগণিত ভাবনা মাথায় করে ঘরে ফিরে এলাম আমি। সঙ্গে করে নিয়ে এলাম একবুক নিরাশা। মেয়েটি এখনো জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। ও কোনো কথা বলছে না। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সুদূর নীলিমার দিকে। থেমে গেছে পাশের ছাদের যাবতীয় শোরগোল। এ্যাকুরিয়ামের ভেতরে পাখিটি আর ঝাঁপটাচ্ছে না। নড়াচড়া থামিয়ে কাচের ভেতরের জলও পালন করছে সাময়িক নীরবতা। আমি উৎসুক হৃদয়ে আর একটিবার শালিক পাখিটির পাখনার ঝাঁপাঝাঁপি খুঁজছি। নাহ, কোনো শব্দ নেই, অস্তিত্ববিহীন ভেসে আছে পাখির শব দেহটি! হৃদয়ের গহীনে এক গভীর অসহায়ত্ব অনুভব করলাম। আমার ছোট্ট মেয়েটি কেঁদে বুক ভাসিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারলো না! আমার এই দমবন্ধ লাগা অনুভব আমাকে কাঁদিয়ে যায় নীরবে। পাখি, ক্ষমা করে দিস এই ব্যর্থ মানুষটিরে! আমি তোকে বাঁচাতে পারিনি! আজ হঠাৎ, কি যেন শোরগোল শুনছি ওই ঘরে, পাশের বাড়ির দাম্ভিক বাড়িওয়ালা লোকটির অন্দরমহলে! আমাদের বাড়ির দারোয়ান রুবেল জানালো, সেই অহংকারী বাড়িওয়ালাটি আর নেই! শরতের আকস্মিক বজ্রপাতে লোকটির আজই মৃত্যু হয়েছে। লোকটির মৃত্যুতে আমি উল্লসিত নই। মৃত্যু আনন্দেরও নয়। শুধু ভাবছি, এই ঘরবাড়ি, অর্থ, বৈভব কোনোকিছুই তো স্থায়ী নয়! তবুও কেন মানুষের এত দম্ভ, হিংসা আর অহঙ্কার? কেউতো কিছুই নিয়ে যেতে পারে না এই পৃথিবী থেকে! তবে কি এসব শুভঙ্করের ফাঁকি নয়?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App