আবৃত্তিকারের রুদ্রঘর
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২১ জুন ২০১৯, ০৪:২৩ পিএম
যত্নলগ্ন উর্বর প্রেমময় মাটি জল হাওয়া আলো না পেলে যেমন ফুল ফোটে না, বিশ্বাস আস্থা দ্রোহ ও প্রেমসিক্ত শব্দাবলি না পেলেও আবৃত্তিকারের কণ্ঠ সজীব হয় না। উর্বর মাটিতে পাখির ঠোঁট থেকে নিক্ষিপ্ত বীজও জন্মলাভ করে একদিন ছায়াবতী মহাবৃক্ষ হয়ে ওঠে, আবৃত্তিকারের কণ্ঠ থেকেও আনন্দ-বেদনা-দ্রোহজাত কবিতা শ্রোতা ও পাঠকের মর্মমূল নাড়িয়ে দেয়, জাগিয়ে দেয়।
মনে পড়ে, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ কাব্যপাঠক হয়ে উঠেছিলাম মূলত তাঁর কবিতার আবৃত্তি শুনে শুনে। আজো স্পষ্ট মনে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে প্রথম একটি কবিতা গর্জে উঠতে দেখেছিলাম। সেদিন আবৃত্তিকার ইস্তেকবাল হোসেন আবৃত্তি করছিলেন
পৃথিবীতে মানুষ তখনো ব্যক্তিস্বার্থে ভাগ হয়ে যায়নি
ভ‚মির কোনো মালিকানা হয়নি তখনো।
তখনো মানুষ শুধু পৃথিবীর সন্তান।
অরণ্য আর মরুভূমির
সমুদ্র আর পাহাড়ের ভাষা তখন আমরা জানি।
আমরা ভূমিকে কর্ষণ করে শস্য জন্মাতে শিখেছি।
আমরা বিশল্যকরণীর চিকিৎসা জানি
আমরা শীত আর উত্তাপে সহনশীল
ত্বক তৈরি করেছি আমাদের শরীরের।
আমরা তখন সোমরস, নৃত্য আর
শরীরের পবিত্র উৎসব শিখেছি।
আমাদের নারীরা জমিনে শস্য ফলায়
আর আমাদের পুরুষেরা শিকার করে ঘাই হরিণ।
আমরা সবাই মিলে খাই আর পান করি।
জ্বলন্ত আগুনকে ঘিরে সবাই আমরা নাচি
আর প্রশংসা করি পৃথিবীর।
আমরা আমাদের বিস্ময় আর সুন্দরগুলোকে বন্দনা করি।
[ইশতেহার]
সেই প্রথম রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ইশতেহার কবিতার আবৃত্তি শ্রবণ। শ্রবণ না বলে গমন বা ভ্রমণ অথবা পরিভ্রমণ বলব কিনা বুঝতে পারছি না। বর্ণনাত্মক সেই শব্দপুঞ্জের সঙ্গে নিয়তি-নির্ধারিত হয়ে আমি যেন রুদ্রর অনুগামী। ক্রমশ কবিতার প্রতিটি অক্ষর শব্দ বাক্য রক্তের স্পন্দিত হতে লাগল। আমিও যেন কোনো এক সাঁওতালদ্রোহী সিধুর মতো ধনুক হাতে তীর নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠছি।
অস্তিত্ব রক্ষার নামে আমরা তৈরি করলাম মারণাস্ত্র।
জীবনরক্ষার নামে আমরা তৈরি করলাম
জীবনবিনাশী হাতিয়ার।
আমরা তৈরি করলাম পৃথিবী নির্মূল-সক্ষম পারমাণবিক বোমা।
একটার পর একটা খাঁচা নির্মাণ করেছি আমরা।
আবার সে খাঁচা ভেঙে নতুন খাঁচা বানিয়েছি
খাঁচার পর খাঁচায় আটকে পড়তে পড়তে
খাঁচার আঘাতে ভাঙতে ভাঙতে, টুকরো টুকরো হয়ে
আজ আমরা একা হয়ে গেছি।
প্রত্যেকে একা হয়ে গেছি।
কী ভয়ংকর এই একাকীত্ব!
কী নির্মম এই বান্ধবহীনতা!
কী বেদনাময় এই বিশ্বাসহীনতা!
কী বেদনাময় এই অনিশ্চয়তা!
সেদিন আমার জীবনানন্দ-ঘোর লঘু হয়ে গিয়েছিল। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সমগ্র কবিতার পাঠগ্রহণ করার জন্য আমি উন্মত্ত অধীর হয়ে উঠেছিলাম।
খুব সম্ভব ১৯৯৪ থেকে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সব কবিতার গভীর পাঠ শুরু করি। যে কবিকে বহুবার স্বচক্ষে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে, দেখেছি টিএসসিতে, শাহবাগে এবং দুতিন বার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে তখন কবিকে খুব কাছে থেকে দেখেও স্পর্শ করা হয়নি। স্বল্প-পরিচয়ের বাধা পার হয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার বাসনা দীপ্ত হয়নি। তখনো তাঁর কবিতার নিবিড়পাঠ নেয়া হয়নি।
মনে পড়ে, ১৯৯১-এর ২১ জুন দুপুরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আমতলার ছায়ায় বসেছিলাম। সেদিন ভাপসা গরমে ঢাকার বৃক্ষসকলও চরম ক্লান্ত অবসন্ন ছিল। আচমকা কবির মৃত্যুর খবর আসে কেন্দ্রে। বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কেন বুকের মধ্যে চিনচিনিয়ে ব্যথা ক্রমশ গভীরতর হয়ে উঠছে। একটু একটু শোনা কবির গল্পগুলো দুঃখগুলো ক্রমাগত আমাকে বেদনাহত করে তোলে।
আর সবার মতো আমিও জানি, কবির জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর। জন্মস্থান কবিপিতার কর্মস্থল বরিশালে।
আবৃত্তিকারের রুদ্রঘর
ষ ১৩-এর পাতার পর
পৈতৃক বাড়ি বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামে। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরেরও কম সময়ের জীবনে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে কী কী রেখে গেছেন সেই সম্পদ সন্ধান করতে গিয়ে বুঝি, আমরা কত অবহেলায় অবলীলায় রুদ্রকে একটু আড়ালেই রেখেছি।
১৯৭৫-পরবর্তী সকল সরকার ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, গণআন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার কবি এবং রাষ্ট্র ও সমাজের সকল বিষবৈষম্যবিরুদ্ধে সোচ্চার কবি রুদ্রর সাতটি কাব্য ছাড়াও গল্প কাব্যনাটক ও গান লিখেছেন তিনি। একে একে সংগ্রহ করি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতাবই উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯), ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম (১৯৮১), মানুষের মানচিত্র (১৯৮৬), ছোবল (১৯৮৬), দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮) এবং মৌলিক মুখোশ (১৯৯০)।
বলতে দ্বিধা নেই, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা আমাকে একজন সাহসী প্রতিবাদী দ্রোহী আবৃত্তিকার হওয়ার জন্য প্রাণিত করে। কিন্তু একে একে কবির জোরালো ঝাঁঝালো সকল কবিতা পাঠের পাশাপাশি বুঝতে পারি, তাঁর লোকায়ত জীবনের চিরায়ত কবিতাবলি পাঠ ও আবৃত্তি করতেই হবে। ‘ইশতেহার’, ‘হাড়েরও ঘরখানি’, ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’, ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’, ‘অভিমানের খেয়া’ ইত্যাদি কবিতা তখন পরম জনপ্রিয়। মুখে মুখে ফেরে রুদ্রর ‘স্বজনের শুভ্রহাড়’, ‘কথা ছিল সুবিনয়’, ‘খতিয়ান, ‘উল্টো ঘুড়ি’, ‘অবেলায় শঙ্খধ্বনি’ ইত্যাদি।
রুদ্রর যে কোনো কবিতা পড়ার পরই মনে হয়, আহা এক্ষুনি যদি কাউকে শোনাতে পারতাম। তখন মোবাইল ফোনের যুগ নয়, ফোনও নিম্নমধ্যবিত্তের নাগালে ছিল না। সুতরাং একেকটি শুক্রবারের আবৃত্তি কর্মশালার ক্লাস এবং আবৃত্তি আড্ডার জন্য অপেক্ষা করতে হতো। এবং সুযোগ পেলেই আমরা তখন দলবেঁধে রুদ্রর মানুষের মানচিত্র থেকে সুরে-বেসুরে আবৃত্তি করতাম
অন্ধকার চিরে চিরে বিজুলির ধলা দাঁত উপহাসে হাসে,
আমি বলি ক্ষমা দাও, পরান বন্ধুয়া মোর থাকে। পরবাসে,
দেহের রেকবি খুলে পরানের খিলিপান কে খাওয়াবে তোরে!
গতবার আষাঢ়ও পার হয়ে গেল তা-ও নামে না বাদল,
এবার জোষ্টিতে মাঠে নেমে গেছে কিষানের লাঙল জোয়াল।
আমাদের মাঝে দ্যাখো জমির ভাগের মতো কতো-শতো আল,
এই দূর পরবাস কবে যাবে? জমিনের আসল আদোল
কবে পাবো? কবে পাবো। আলহীন একখণ্ডমানব-জমিন?
পরবাস থাকবে না, থাকবে না দূরত্বের এই রীতি-নীতি।
মহুয়ার মদ খেয়ে মত্ত হয়ে থাকা সেই পার্বণের তিথি
কবে পাবো? কবে পাবো শর্তহীন আবাদের নির্বিরোধ দিন \
[মানুষের মানচিত্র ১]
উত্তর আধুনিক কবিতা বুঝতে বুঝতে আমরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম, তখন রুদ্রর কবিতা আমাদের নতুন করে প্রশ্রয়-আশ্রয় দেয়। তাঁর কবিতা-পরিভ্রমণে আমরা ক্লান্ত হই না। চিরচেনা লোকায়ত ধরার উজান থেকে ফিরে আবার ভাটিয়ালি হই। কবির প্রত্যাশা প্রতিশ্রুতি এবং আন্তরিক বেদনার সঙ্গে আমরা একাত্ম হয়ে বলতে থাকি চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।
জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে
জীবন সুন্দর
আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্দুর
সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর
আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা
তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!
[চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়]
খুব বেশি বুদ্ধিশ্রান্ত হয়ে আমরা আবৃত্তি করতে পারি না। দুর্বোধ্যতার চাপ বুকে নিয়ে, চিন্তার অস্পষ্টতা নিয়ে, আবেগের অভাব নিয়ে, অস্বচ্ছ কথার জড়া নিয়ে আবৃত্তি করা যায় না। রুদ্রর কবিতা আমাদের পরিশ্রমকে লঘু করে দিয়ে আবেগে প্রতিজ্ঞায় আস্থায় ভালোবাসায় বিশ্বাসে উজ্জীবিত করে তোলে। আমরা সহজেই বলতে পারি
তবু তো কোনোদিন একদিন বৈশাখী রাতে জীবন এসে বলেছিল
হাড়ের খুলির মাটি কোনো এক বর্ষার পর ঠিকই পাললিক হবে,
খরার মাঠের বুকে দেখো ঠিক মেলে দেবে ফসলের সোনালি পালক।
[মাংশভুক পাখি]
শুধু দ্রোহ নয়, শুধু মুখস্থ চেতনার কথা নয়, শুধু স্লোগান নয়, কবিতায় আমরা আরো কিছু চাই। যা চাই তাই বুঝি অকাতরে দিয়ে যান রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। অথবা কবির সকল চাওয়ার যোগফল হয়ে উঠি আমরা সরল সহজ শুদ্ধ সুন্দর সুদূরপিয়াসী আবৃত্তিযোদ্ধা ও প্রেমভিক্ষু-সকল।
আকাশের দেহ থেকে ঝ’রে পড়ে সন্ধ্যার আঁধার
এসো কথা বোলে উঠি, আমরা ভালোবাসার কথা বলি,
এই নিঃশব্দের দেয়াল ভেঙে এসো আজ স্বপ্নের কথা বলি।
[ধাবমান ট্রেনের গল্প]
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সকল কবিতাই আমাদের পাঠ্য হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতা পাঠের পরই আমরা আবৃত্তির জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠি। আবৃত্তির মঞ্চ জীবনঘনিষ্ঠ কবিতামাধুর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে রুদ্রর কবিতায়।
নির্দ্বিধায় বলা যায়, রুদ্রর কবিতা অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে আবৃত্তিমুখী করে তুলেছে। রুদ্রর কবিতা অসংখ্য পাঠককে কাব্যপাঠে উৎসাহী করেছে। রুদ্রর কবিতা আমাদের সাহসী করে তুলেছে। সকল ভণ্ড প্রতারক স্বৈরাচারী এবং স্বৈরাচারের কাছে নতজানু পরাস্ত লোভাতুর মুখগুলোকে চিনিয়ে দিয়েছে।
আবৃত্তি শুধু কণ্ঠধ্বনির অনুরণন নয়, আবৃত্তি জ্ঞান ও বোধের সজীব উচ্চারণ। আবৃত্তি ঘুমভাঙানিয়া, স্বপ্নজাগানিয়া আত্মার ধ্বনিতরঙ্গ সকল। রুদ্রর কবিতাঘর ও চেতনাঘোর থেকে আমরা তাই সেই প্রত্যাশাপ্রোজ্জ্বল অভিযাত্রার দৃঢ় সংকল্পের কথা জানাতে চাই
যাকে তুমি মৃত্যু বলো, যাকে তুমি বলো শেষ, সমূল পতন
আমি তার গভীরে লুকোনো বিশ্বাসী বারুদের চোখ দেখে বলি
এইসব মৃত্যু কোনো শেষ নয়, কোনো বিনাশ, পতন নয়
এইসব মৃত্যু থেকে শুরু হয় আমাদের সূর্যময় পথ,
এই ফাঁসির মঞ্চ থেকেই আমাদের যাত্রার শুরু।
[ফাঁসির মঞ্চ থেকে]